অশ্রু আর বেদনা নিয়ে শুরু ক্রীড়াঙ্গনের যাত্রা

দুলাল মাহমুদ

২৭ মার্চ ২০২১

অশ্রু আর বেদনা নিয়ে শুরু ক্রীড়াঙ্গনের যাত্রা

স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে ক্রীড়ানুরাগীদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন অনেক খেলোয়াড়, অনেক অতিথি, মনে ছাপ রেখে গেছে খেলার অনেক আয়োজন। এ সব থেকে সেরা ৫০ বাছাই করতে গেলে হিমশিম খেতে হবেই। হয়তো বিতর্কও হবে। তারপরও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে একটা চেষ্টা করে দেখা তো যেতেই পারে। কী বলেন?

অনিশ্চয়তার কালো মেঘে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভাগ্য। ছিন্নভিন্ন তাঁদের জীবন-জীবিকা। নয় মাসের অনেক অশ্রু, অনেক রক্ত, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে স্বস্তি ও আনন্দ নিয়ে আসে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। মুক্ত স্বদেশ তখনও লণ্ডভণ্ড। মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন অনেক ক্রীড়াবিদ। জীবন দিয়েছেন অনেকেই। এলোমেলো হয়ে যায় অনেকের ভূত-ভবিষ্যৎ।

কিন্তু জীবনে যতই দুর্যোগ, দুর্বিপাক ও দুর্ভোগ আসুক না কেন, মানুষ ফিরতে চায় স্বাভাবিক জীবনধারায়। প্রকৃতির নিয়মই এটা। যে কারণে দুঃসহ স্মৃতি নিয়েও ধীরে ধীরে সরব হয়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। তবে মুক্তিযুদ্ধের রেশ তখনও ফুরিয়ে যায়নি। সবার মনে, মননে, মেজাজে তার তরতাজা স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের বিস্ময়কর অবদান হয়ে আছে গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাস। তারই আলোকে ফুটবল খেলা দিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের নবতর পথচলা।

১৯৭২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে ‘রাষ্ট্রপতি একাদশ’ এবং ‘বাংলাদেশ একাদশ’-এর মধ্যে অনুষ্ঠিত ম্যাচে রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দুই দলের খেলোয়াড়েরা

রক্তাক্ত স্বাধীনতার মাত্র ৫৮ দিন পর ক্রীড়াঙ্গনকে সক্রিয় করে তোলাটা যথেষ্ট তাৎপর্যময়। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, বিপন্ন দেশকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে যাওয়া ছিল প্রধান লক্ষ্য। সেজন্য কিশোর-তরুণ-যুবকদের সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন ধারায় ফিরিয়ে আনাটা প্রধান বিবেচ্য হয়ে ওঠে। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন যুদ্ধের ময়দানে। সঙ্গত কারণে তাঁদের মানসিক জগতে বড় ধরনের ওলটপালট হয়ে যায়। অনেকের হাতেই ছিল অস্ত্র। যে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবন থেকে সবে ফিরে এসেছেন, তার মৌতাত কাটিয়ে নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া মোটেও সহজ ছিল না।

যে কারণে সমাজে একটা অস্থিরতা বিরাজ করতে থাকে। সে অবস্থা থেকে তরুণদের স্বাভাবিক জীবনধারায় ফিরিয়ে আনা ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এ জন্য খেলার মাঠ ছিল প্রধান একটি অবলম্বন। খেলার মাঠে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরলে সহজাতভাবেই জাতীয় জীবনে তার একটা প্রভাব পড়ে। মানসিক সুস্থিরতার জন্য এটি নিঃসন্দেহে বড় একটি দাওয়াই। এটা বোধ করি নীতি-নির্ধারকরা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।  

১৯৭২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে ‘রাষ্ট্রপতি একাদশ’ এবং ‘বাংলাদেশ একাদশ’-এর মধ্যে অনুষ্ঠিত ম্যাচে রাষ্ট্রপতি আবু সাইদ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দুই দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ক্রীড়াবিদদের পরিবারকে সাহায্যার্থে ১৯৭২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় চ্যারিটি ফুটবল ম্যাচ। বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি আয়োজিত এ ম্যাচে অংশ নেয় বাংলাদেশ একাদশের মোড়কে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এবং রাষ্ট্রপতি একাদশ। এটি ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ফুটবল ম্যাচ। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে তার প্রতিবাদে সবার আগে রুখে দাঁড়ান ক্রীড়ানুরাগীরা। ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল একাদশ এবং বিসিসিপি একাদশের মধ্যকার চার দিনের ক্রিকেট ম্যাচের শেষ দিনে খেলা ভণ্ডুল করে দিয়ে তাঁরা আন্দোলনে শরীক হন। এরপর আর ঢাকায় কোনো খেলাধুলা আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।

সার্বিকভাবে এ খেলাটি ছিল জনজীবনে স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসার নির্দেশক। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের শেষ ধাপ ছিল মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির ইতিহাসে এমন সময় আর আসেনি। এটি আর্থ সামাজিক অবস্থার পাশাপাশি এ দেশের মানুষের মনোজগতে বড় ধরনের একটা ধাক্কা দেয়। এলোমেলো জীবনে ছন্দ ফেরাতে এই ফুটবল ম্যাচ শুধুই একটা ফুটবল ম্যাচের চেয়েও অনেক বড় মাত্রা পেয়ে যায়।  সরকারও এ ম্যাচটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। যে কারণে গৌরবের এই সন্ধিক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মাঠে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। বঙ্গবন্ধু উত্তোলন করেন লাল-সবুজ পতাকা। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দুই দলের খেলোয়াড়দের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা অন্তরঙ্গভাবে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলেন এবং সবার খোঁজখবর নেন। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের নবযাত্রা তাঁদের উপস্থিতিতে ভিন্ন মাত্রা পায়।

১৯৭২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে ‘রাষ্ট্রপতি একাদশ’ এবং ‘বাংলাদেশ একাদশ’-এর মধ্যে অনুষ্ঠিত ম্যাচে রাষ্ট্রপতি আবু সাইদ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ম্যাচের আয়োজকরা

খেলায় জয়-পরাজয় মুখ্য বিষয় ছিল না। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এত তাড়াতাড়ি যে খেলার মাঠে ফেরা গেছে, এ বিষয়টি সবাইকে দারুণভাবে আপ্লুত করে। সহযোগী অনেক ক্রীড়াবিদ চিরতরে হারিয়ে যাওয়ায় তাঁদের অনুপস্থিতিতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় আবেগ। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। থাকে না বলেই চোখে অশ্রু আর বুকে বেদনা নিয়ে খেলতে নামতে হয়। সহযোগী কিংবা প্রতিপক্ষের অনেক ফুটবলারের কত কত স্মৃতি বুকের মধ্যে ছলছল করতে থাকে। সেই ফুটবলারদের অনেককেই নির্মমভাবে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের অনুসারীরা। কেউ কেউ মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। 

এমন এক প্রেক্ষাপটে এটা নিছক একটি খেলা ছিল না। ছিল মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া ক্রীড়াবিদদের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তার তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী। সেদিন বিপুল সংখ্যক দর্শক মাঠে উপস্থিত ছিলেন। প্রীতি এই ম্যাচে রাষ্ট্রপতি একাদশ ২-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ একাদশকে। গোল করেন বিজয়ী দলের টিপু ও গফুর। 

ফাল্গুনের প্রথম দিনে বাংলাদেশের নবযাত্রার সে ম্যাচটি হয়ে আছে ইতিহাসের অন্যতম সোপান। সেই সোপান বেয়ে শুধু ক্রীড়াঙ্গনই নয়, এগিয়ে যায় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।

দু’দলে যাঁরা ছিলেন:

রাষ্ট্রপতি একাদশ : শহিদুর রহমান সান্টু, মোহাম্মদ নাজির বড় (জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা), মোহাম্মদ জহির, এরশাদুর রহমান, মনোয়ার হোসেন নান্নু (ভুট্টো), জিল্লুর রহমান, কিউ এম রকিব উদ্দিন দিপু অধিনায়ক (কাজী সাত্তার), মো. সলিমুল্লাহ, সরফুদ্দিন আহমেদ, আবদুল গফুর, গোলাম সারোয়ার টিপু-সহঅধিনায়ক (ওয়াজেদ গাজী)। অতিরিক্ত : আবুল কাসেম, সালেহ আহম্মদ, পিয়ার আলী, বদরুল হুদা বাটু, বেলাল মিয়া, আবদুল আলিম, মোহাম্মদ মালা। কোচ: শেখ মো. সাহেব আলী। ম্যানেজার: শহিদ উদ্দিন ইসকান্দার কচি ।

বাংলাদেশ একাদশ : অনিরুদ্ধ (সহ-অধিনায়ক), আইনুল হক, মো. জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), শেখ আশরাফ আলী, আবদুল হাকিম, আলী ইমাম, ফজলে সাদাইন খোকন (মোহাম্মদ কায়কোবাদ), শাহজাহান, কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান খান, তসলিম উদ্দিন (নওশেরুজ্জামান)। অতিরিক্ত : আবদুল মোমেন, আবদুস সাত্তার, নিহার রঞ্জন, সিরাজুদ্দিন সিরু, গোবিন্দ কুণ্ডু, সাইদুর রহমান প্যাটেল, বিমল চন্দ্র, মাহমুদ, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, সুভাষ। কোচ: ননী বসাক। ম্যানেজার: লুৎফর রহমান।

আরও পড়ুন...
ঢাকার মাঠে সবচেয়ে বড় ফুটবল উৎসব 
মোহাম্মদ আলী যখন বাংলাদেশের 
আকাশি-নীলের উত্থান
বক্সাররাই আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পদক জয়ের পথ-প্রদর্শক!
কাজী সালাউদ্দিন: বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টার

 
শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×