সুস্থ এক পৃথিবীর আশায় আছি

সিদ্দিকুর রহমান

২৯ মার্চ ২০২১

সুস্থ এক পৃথিবীর আশায় আছি

এই তো দেড় বছর আগেও সময়টা ছিল পুরো অন্যরকম। বছরের পুরোটা সময় জুড়ে ব্যস্ততায় কাটত। আজ এই দেশে তো কাল অন্য দেশে। এখন বাড়িতে বসে থেকে ওই সময়টা ভীষণ মিস করি। আবার একই সঙ্গে এই যে সময়টা পেয়েছি, সেটাকেও অ্যাপ্রিশিয়েট করি।

চীনের উহান শহর থেকে যখন করোনা ভাইরাসের শুরু হলো, তখন সেভাবে রোগটাকে পাত্তা দিইনি। আশপাশের কোথাও কেউ যে পাত্তা দিচ্ছিল, তাও কিন্তু না। তারপর যখন গত বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে আস্তে আস্তে লকডাউন দেওয়া শুরু হলো সবখানে, মনে হলো এটা আবার কি হচ্ছে! বিষয়টা তখন থেকেই গুরুত্বসহকারে নেওয়া শুরু করি। ওই সময় নিউজিল্যান্ডের একটি টুর্নামেন্টে খেলার কথা ছিল আমার। নিউজিল্যান্ড যাওয়ার সময় খুব ভয় পাচ্ছিলাম এটা ভেবে যে, ওরা ঢুকতে দেবে কিনা। ততদিনে করোনা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। তখনও ভাবিনি, এতটা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাবে সবকিছু। ভেবেছিলাম, কোনো কোনো ভাবে এটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে এটা এমন ভয়াবহ রূপ নেবে, তা ছিল আমার চিন্তারও বাইরে।

নিউজিল্যান্ড থেকে এরপর মালয়েশিয়া ওপেনে খেলতে গেলাম। ওখানে তো টুর্নামেন্ট হবে কিনা, তা নিয়েই সংশয়ে ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওবা টুর্নামেন্ট হলো, যদিও আমরা পরের ছয় মাসের মধ্যেও প্রাইজমানি পাইনি। এর কারণ হয়তো, কোভিডের কারণেই ওরা কোনো কাভারেজ পায়নি। মানুষজন খেলা দেখতে আসতে পারেনি। তারপর থেকে তো এশিয়ান ট্যুরের সব টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে গেল। আমিও ঢাকায় ফিরে এলাম মার্চের প্রথম সপ্তাহে।

 করোনায় সব থমকে যাওয়ার আগে বিশ্বের নানা গলফ কোর্সেই কাটত সিদ্দিকুর রহমানের সময়। ছবি: এশিয়ান ট্যুর

এই তো দেড় বছর আগেও সময়টা ছিল পুরো অন্যরকম। বছরের পুরোটা সময় জুড়ে ব্যস্ততায় কাটত। আজ এই দেশে তো কাল অন্য দেশে। ভিসা, পাসপোর্ট, বিমানের টিকিট, হোটেল রিজার্ভেশন, টুর্নামেন্টের জন্য অনুশীলন-- মনে হতো যেন এতটুকু দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছিনা। এখন বাড়িতে বসে থেকে ওই সময়টা ভীষণ মিস করি। আবার একই সঙ্গে এই যে সময়টা পেয়েছি, সেটাকেও অ্যাপ্রিশিয়েট করি। কারণ আমরা সবাই কেমন যেন ভেতরে ভেতরে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে আমার কথা বলতে পারি, টুর্নামেন্ট খেলতে খেলতে স্কিলের উন্নতি, ফিটনেসের উন্নতি করার সময়ই পাচ্ছিলাম না। আসলে করোনা আসার পর একটা বড় রকমের বদল ঘটে গেছে পৃথিবীতে। এটা থেকে শিক্ষা নিয়েছি, আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।

করোনার শুরুর দিনগুলো অনেক ভয়ঙ্কর ছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম। কারণ করোনায় তখন আশপাশের প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে। ভাবতাম, এটা কি হচ্ছে? আমরা সবাই বেঁচে থাকব তো? অনেকের বাবা-মা মারা যাচ্ছে, ছেলেমেয়েরা মৃত ব্যক্তির কাছে যেতে পারছে না। আতঙ্ক কাজ করছে। যদিও এখন আতঙ্কটা অনেক কমে গেছে।

করোনার সময় সত্যি বলতে পুরো দেড় বছর ঘরে বসে থেকেছি। এরপর গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় প্যারাগন ওপেন টুর্নামেন্টে খেলেছি। সেখানে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। ওটা শেষ করে আবারও সেই অলস সময় কাটানো। আসলে খেলা বন্ধ তো আমাদের গলফারদের রোজগারও বন্ধ। আমার কোনো স্পনসর নেই। নির্দিষ্ট বেতনও নেই। আমার ওপরে অনেক দায়িত্ব। পরিবারের সবাই নির্ভরশীল আমার ওপর। খেলা বন্ধ, কিন্তু জীবন তো থেমে নেই। সবকিছুই চালিয়ে নিতে হচ্ছে। এটা আমার জীবনে করোনার সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা।

প্যারাগন ওপেন দিয়ে যখন খেলায় ফিরলাম, খুবই ভালো লেগেছিল। ভাবলাম, আবারও মনে হয় ব্যস্ততা শুরু হলো। কিন্তু আমাদের দেশে যা হয় আরকি! আর কোনো খবরই নেই অন্য কোনো টুর্নামেন্টের। আমার মনে হয় করোনার কারণে আমরা অনেকটাই খেলা থেকে দূরে সরে গেছি। গলফে এক প্রকার পিছিয়েই যাচ্ছি। অথচ আমরা চাইলে শুরু করতেই পারি খেলা। গলফে আমরা দূরত্ব মেনেই খেলি। যে পরিবেশে খেলি সেখানে প্রচুর অক্সিজেন। গলফে স্বাস্থ্যবিধি মানা সহজই বলা যায়।

ঢাকায় খেলার আগে গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভারতে খেলতে যেতে চেয়েছিলাম। সেখানে পিজিটিআই ট্যুরের টাটা স্টিল ওপেন ও জিভ মিলখা সিং আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্টে খেলার জন্য নামও এন্ট্রি করেছিলাম। কিন্তু যাইনি। যাওয়ার আগে ভয় কাজ করছিল। মন টানেনি। কারণ ভারত এত জনবহুল দেশ। ওখানে নতুন নতুন রোগী বাড়ছিল।  সংক্রমণের সংখ্যাও তুলনামূলক বেশি। কোভিড টেস্ট করে যেতে হতো, আসার সময় আবার টেস্ট করাতে হতো। যদি আমি কোভিড পজিটিভ হয়ে যাই, ওই বিদেশ বিভূঁইয়ে আমাকে কে দেখবে? জানি আমার ইমিউনিটি সিস্টেম ভালো, স্ট্যামিনাও ভালোই। কিন্তু যদি কিছু হয়েই যেত, তখন বিপদ আরও বাড়তে পারত। তাছাড়া ওখানে খেললেই যে অলিম্পিকে সুযোগ পেতাম, সেটাও তো না। প্রাইজমানিও আকর্ষণীয় ছিল না। তাই ভারতে আর যাইনি।

আমাদের বাংলাদেশ গেমসে গলফটা হচ্ছে, কিন্তু বিপিজিএর কোনো টুর্নামেন্ট নেই। এখানে যদি অন্তত ১০-১৫ লাখ টাকার টুর্নামেন্টও হয়, তাহলে আমরা যারা গলফ খেলে বেঁচে থাকি, তারা একটু স্বস্তি পাব।

সারা বিশ্বে এখন ফুটবল, ক্রিকেটসহ অন্য অনেক খেলা হচ্ছে। বাংলাদেশেও ঘরোয়া খেলাধুলা থেমে নেই। এপ্রিলে শুরু হবে বাংলাদেশ গেমস। আমি তারপরও স্বস্তি পাচ্ছি না। এশিয়ান ট্যুরের কথা যদি বলি, তাহলে এই বছরে এটার আর কোনো আশা নেই। কারণ যে দেশগুলোতে টুর্নামেন্ট হবে, সেই দেশগুলোর দরজাই তো আজও বন্ধ। মালয়েশিয়াতে ঘরোয়া ফ্লাইট বন্ধ অনেক দিন। আমার মালয়েশিয়ান ক্যাডি গত এক বছর গ্রামে যেতে পারে না। কুয়ালালামপুর শহর রেড জোনে, ওর গ্রামের বাড়ি গ্রিন জোনে। আটকা পড়ে আছে সে কুয়ালালামপুরে। প্রতি বছর মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, কোরিয়াতে ২-৩টা করে টুর্নামেন্টে অংশ নিই। আমি কোনো আশা দেখছি না, এই দেশগুলোতে টুর্নামেন্ট হওয়ার।

আমাদের বাংলাদেশ গেমসে গলফটা হচ্ছে, কিন্তু বিপিজিএর কোনো টুর্নামেন্ট নেই। এখানে যদি অন্তত ১০-১৫ লাখ টাকার টুর্নামেন্টও হয়, তাহলে আমরা যারা গলফ খেলে বেঁচে থাকি, তারা একটু স্বস্তি পাব। ফেডারেশন যদি চায়, তাহলে ঘরোয়া টুর্নামেন্ট করা সম্ভব।

আমি আশাবাদী একজন মানুষ। করোনামুক্ত এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। করোনার ভ্যাকসিন নেওয়া শেষ হলে সাধারণ জীবন যাপনে ফিরে যেতে পারবো। তবে ভ্যাকসিন দিলেই যে পৃথিবী থেকে করোনা উধাও হয়ে যাবে, সেটাও কিন্তু না। প্রথমত, সারা পৃথিবীর মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, সবাইকে সচেতন হতে হবে।

জানি না, সামনে কী আছে! যদিও আমি সুন্দর একটা দিনের আশায় প্রতি রাতে ঘুমাতে যাই। সুস্থ এক পৃথিবীর আশায় প্রতিদিন ঘুম ভাঙে আমার।  

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×