শহীদ আফ্রিদির একান্ত সাক্ষাৎকার

ক্রিকেট হলো বড় দিলওয়ালেদের খেলা`

উৎপল শুভ্র

২ মে ২০২১

ক্রিকেট হলো বড় দিলওয়ালেদের খেলা`

শহীদ আফ্রিদি

তারকা হতে একদমই সময় নেননি। `৯৬-এর অক্টোবরে নাইরোবিতে মাত্র দ্বিতীয় ম্যাচে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর প্রথম ইনিংসেই ৩৭ বলে সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ড করে শহীদ আফ্রিদি রাতারাতিই পরিণত হয়েছিলেন বিশ্ব ক্রিকেটের নতুন সেনসেশনে। ১৯৯৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের সময় যখন এই ইন্টারভিউ করি, ওয়ানডের লেবেল ঝেড়ে ফেলে তখন টেস্টেও তিনি নিয়মিত। ইন্টারভিউ করতে গিয়ে ছটফটে স্বভাবের বাইরে তরুণ আফ্রিদির আর যা নজর কেড়েছিল, তা হলো, স্পষ্টবাদিতা আর মনের কথা অকপট বলে ফেলার অভ্যাস। নইলে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই কেউ স্বপ্নের কথা জিজ্ঞেস করায় কেউ বলে দেয়, পাকিস্তানের অধিনায়ক হতে চাই!

প্রথম প্রকাশ: ১৩ মার্চ ১৯৯৯। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: পাকিস্তানের গত ভারত সফরটা তো আপনার জন্যই সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকার কথা। অবশেষে টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আপনি।

শহীদ আফ্রিদি: হ্যাঁ, আগে সবাই বলত, আমাকে নাকি টেস্ট প্লেয়ারের মতো লাগে না। তবে আমি নিজেকে সব সময় ভালো টেস্ট প্লেয়ার হিসেবেই বিবেচনা করে এসেছি। এখন টেস্ট ও ওয়ানডে দুটিই সমান তালে খেলে যেতে চাই।

শুভ্র: আপনার ব্যাটিংয়ে যে মারমার-কাটকাট ভাব, তাতে টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে সামলাতে কি কষ্ট হয় না? চেন্নাইতে ১৪১ রানের ইনিংসটিতে অতগুলো ডট বল আপনি কীভাবে খেললেন?

আফ্রিদি: এই প্রশ্নের জবাবে আমি প্রথমেই বলব, টেস্ট ক্রিকেট এখন বদলে গেছে। এখন এটি হয়ে গেছে ওয়ানডের মতোই। এ কারণেই এখন সব টেস্ট ম্যাচেই আপনি রেজাল্ট দেখতে পাবেন। জয়াসুরিয়ার কথাই ধরুন না, টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই জায়গাতেই তো সে তাঁর নিজের খেলাটাই খেলে। আমিও আমার খেলাটাই খেলতে চাই, তবে উইকেটে থাকতে চাই আরও বেশি সময়।

শুভ্র: টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে আপনার আবির্ভাবের পেছনে কোচ জাভেদ মিয়াঁদাদের অবদানের কথা তো আপনি অনেকবার বলেছেন। মিয়াঁদাদ আসলে কি করেছেন?

আফ্রিদি: আসলে তাঁর সবচেয়ে বেশি অবদান ফিল্ডিংয়েই। জাভেদ মিয়াঁদাদ ফিল্ডিং প্র্যাকটিসটা দারুণ করান। আমাদের সব খেলোয়াড়ের ফিল্ডিং ভালো হয়েছে তাঁর কারণে। তবে ব্যাটিং আমার নিজের কাজ। তার পরও ব্যাটিং নিয়েও কিছু টিপস তো তিনি দেনই, তা কাজেও আসে।

জাভেদ মিয়াঁদাদের সঙ্গে আফ্রিদি, ততদিনে অবশ্য গুরু-শিষ্য পরিচয়টা পেরিয়েই এসেছেন তাঁরা। ছবি: এএফপিশুভ্র: আপনাকে কি নির্দিষ্ট কিছু বলেছেন মিয়াঁদাদ? যেমন ওভাবে খেলো, ওই শটটি খেলো না ইত্যাদি…

আফ্রিদি: (উচ্চস্বরে হেসে) তিনি তো আমার সব শট সম্পর্কেই বলেন, ‌‘এই শট খেলো না।’ (এবার সিরিয়াস) না, আসলে মিয়াঁদাদ আমাকে বারবার যা বলেন তা হলো, 'উইকেটে টিকে থাকো। কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরো, মারার বল এমনিতেই পাবে।' বল সিলেকশন সম্পর্কেই আসলে আমাকে সচেতন করে তুলেছেন তিনি।

শুভ্র: নাইরোবিতে আপনার ওই ৩৭ বলে সেঞ্চুরির পর আমার সব সময়ই মনে হয়েছে, অন্যায় একটা চাপের মধ্যে পড়ে গেছেন আপনি। এরপর থেকে মানুষ আপনার কাছ থেকে সব সময়ই অবিশ্বাস্য কিছু আশা করে, প্রতি বলেই চার-ছয় দেখতে চায়। এই চাপটা কি কখনও কখনও অসহ্য মনে হয় না আপনার?

আফ্রিদি: শুরুতে মনে হয়েছে। তখন সত্যিই খুব চাপ অনুভব করতাম। কিন্তু এখন আমার উপলব্ধি হলো, আমি দেশের পক্ষে খেলছি, প্রতি বলে চার-ছয় মারতে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে দিতে রাজি নই। এখন আমি সহজে আমার উইকেট হারাতে চাই না। আমি এমনভাবে খেলতে চাই…সাঈদ আনোয়ারের উদাহরণ দেই। শুরুতে প্রতি বলেই চার-ছয় মারার চেষ্টা করতেন তিনি, কিন্তু ৩০-৩৫টা ওয়ানডে খেলার পর যখন টেস্ট খেলতে শুরু করলেন, অনেক বদলে গেলেন। এখন সাঈদ আনোয়ার পাকিস্তান ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড।

শুভ্র: আপনার প্রথম পছন্দ কোনটি? টেস্ট না ওয়ানডে?

আফ্রিদি: দুটিই।

শুভ্র: মেরে খেলাটাই তো আপনার সহজাত প্রবণতা। তা নাইরোবির ওই রেকর্ডের আগেও কি কোথাও এমন হারিকেন ইনিংসে খেলেছেন আপনি?

আফ্রিদি: অনেক। ডোমেস্টিক ক্রিকেটে চার দিনের কায়েদে আজম ট্রফিতে আমি ৪৫ বলে সেঞ্চুরি করেছি। ৩৬-৩৭ বলে সেঞ্চুরি করেছি উইলস কাপে (পাকিস্তানের ঘরোয়া একদিনের টুর্নামেন্ট)।

শহীদ আফ্রিদির ব্যাটিংয়ের সমার্থক হয়ে গিয়েছিল এমন ছবি। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: তার মানে নাইরোবির পারফরম্যান্স বাইরের দুনিয়ার জন্য বিস্ময় হয়ে এসেছিল। পাকিস্তানে আপনি আগেই পরিচিত ছিলেন বিগ হিটার হিসেবে?

আফ্রিদি: আসলেই তাই। ডোমেস্টিক ক্রিকেটে যারা খেলত, তারা ভালোই চিনত আমাকে।

শুভ্র: শুরু থেকেই কি আপনি এভাবে ব্যাট করেন?

আফ্রিদি: হ্যাঁ, শুরু থেকেই। তবে এখন আমি আমার খেলা একটু বদলাতে চাই। আমি চাই, বোলাররা আমার উইকেট আদায় করে নিক।

শুভ্র: ব্যাটিংয়ে এই যে বাড়তি মনোযোগ, তা কি আপনার বোলিংকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে?

আফ্রিদি: কিছুটা সমস্যা তো হচ্ছেই। তবে পাকিস্তান দলে আমি নিজেকে অলরাউন্ডার হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। সে জন্য বোলিংয়েও বাড়তি পরিশ্রম করছি।

শুভ্র: আপনার নিজের দৃষ্টিতে লেগ স্পিনার হিসেবে আপনার শক্তি আর দুর্বলতা কী? আপনি তো শেন ওয়ার্ন বা মুশতাক আহমেদের মতো ট্র্যাডিশনাল লেগ স্পিনার নন, বরং বলা যেতে পারে অনেকটা অনিল কুম্বলে টাইপ।

আফ্রিদি: অনেকটা তাই--অনিল কুম্বলের সঙ্গেই মিল আছে আমার। কুম্বলের যেমন শুধু ফ্লিপার-ফ্লিপার-ফ্লিপার, বড় কোনো ব্রেক নেই, আমারই মতো। তবে আমি চেষ্টা করি, উইকেটে সোজা বল করে রান চেক দিতে। তাহলেই উইকেট আসবে। ওয়ানডেতে উইকেট নিতে হয় না, এমনিতেই তা এসে যায়। রান নিতে না পারলে ব্যাটসম্যান চান্স নেবেই, আউটও হবে।

নিজের বোলিংয়ের সীমাবদ্ধতা জানতেন আফ্রিদি। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে…

আফ্রিদি: হ্যাঁ, টেস্ট ক্রিকেটে উইকেট আদায় করে নিতে হয়। তবে আপনার লাইন-লেংথ ভালো হলে আর ভালো জায়গায় বল ফেলে ছোট ছোট ব্রেক করাতে পারলে তো উইকেট পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। উইকেট নেওয়ার জন্য তো আর বলে বলে বিশাল ব্রেকের প্রয়োজন নেই। দুই ইঞ্চি ব্রেকই ব্যাটের কানা নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

শুভ্র: আপনি বর্তমান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন। বড় এক ক্রেজ, স্পনসরদের লাইন আপনার পেছনে, অর্থ, খ্যাতি সবই হাতের মুঠোয়। ক্রিকেট খেলা শুরু করার সময় কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন এমন?

আফ্রিদি: এসব ক্রেজ-টেজ নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি সব সময়ই শুধু খুব ভালোভাবে ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। পাকিস্তানের পক্ষে মাথা উঁচু করে খেলব, মাথা উঁচু করেই বিদায় নেব--এটাই আমার লক্ষ্য।

ক্রিকেট খেলা হলো বড় দিলওয়ালেদের খেলা। যার মনের শক্তি নেই, সে ক্রিকেটে ভালো করতে পারে না।

শুভ্র: কিন্তু আপনাকে ঘিরে এই ক্রেজ নিশ্চয়ই আপনি খুব উপভোগ করেন?

আফ্রিদি: হ্যাঁ, তা তো করিই। আমার এই বয়সে তা করারই কথা। তাছাড়া এনজয় না করলে আপনি ক্রিকেট খেলবেন কীভাবে? ক্রিকেটে তো এসব প্রেশার নিতেই হবে। ক্রিকেট হলো বড় দিলওয়ালেদের খেলা। যার মনের শক্তি নেই, সে ক্রিকেটে ভালো করতে পারে না।

শুভ্র: ‌‘বড় দিল’-এর ব্যাপারে তো আপনার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আপনি পাঠান, পাঠানরা তো যোদ্ধার জাতি।

আফ্রিদি: হ্যাঁ, পাঠানরা খুব সাহসী হয়। আসলে কথা এটা নয়, মাঠে যত দর্শকই হোক, বিপক্ষে যেই থাকুক, আমি ভয় পাই না।

শুভ্র: আপনার প্রিয় ব্যাটসম্যান কে?

আফ্রিদি: সাঈদ আনোয়ার, লারা, মার্ক ওয়াহ, টেন্ডুলকার...এই হলো আমার ফেবারিট ফোর। তবে আইডল ইমরান খান।

শুভ্র: ইমরান খানের সঙ্গে তো অনেকবারই দেখা হয়েছে। বিশেষ কিছু কি বলেছেন আপনাকে?

আফ্রিদি: তিনি যা বলেন, তাঁর সবই স্পেশাল।

শুভ্র: যেমন?

আফ্রিদি: তাঁর সঙ্গে যখনই দেখা হয়, কোনো না কোনো নতুন কথা বলেন আমাকে। যা আমার খুব ভালো লাগে। আমার দৃষ্টিতে ইমরান খান ইজ ইমরান খান, তাঁর কোনো তুলনা নেই।

শুভ্র: আপনার ব্যাটিংয়ের যে ধরন, তাতে তো অনেক কমপ্লিমেন্টই পাওয়ার কথা। এর মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় কোনটি?

আফ্রিদি: চেন্নাইতে (১৯৯৯ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে) আমি যে ১৪১ করেছিলাম, এরপর ওয়াসিম ভাই (ওয়াসিম আকরাম) বলেছিলেন, ‌‘আমি টেস্ট ক্রিকেটে এমন ইনিংসই আর দেখিনি। আজ তুমি লোকের মুখ বন্ধ করে দিয়েছ। যারা বলত তুমি টেস্ট ক্রিকেটের প্লেয়ার নও, তাদের জবাব দিয়ে দিয়েছ।’ শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম, একজন অধিনায়ক আমাকে এমন বলছে।

শুভ্র: এমটিভিতে তো আপনাকে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে দেখেছি। বোম্বে থেকেও নাকি সিনেমায় অভিনয় করার অফার পেয়েছেন, তাহলে কি একদিন শহীদ আফ্রিদিকে সিনেমায় দেখা যাবে?

আফ্রিদি: না, কখনোই না। বোম্বে থেকে আমি অনেক অফার পেয়েছে। কিন্তু আমি ক্রিকেটার, অভিনেতা নই।

শুভ্র: অবসরে কী করতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ?

আফ্রিদি: সুইমিং, টেবিল টেনিস, মিউজিক।

শুভ্র: এত কিছুর পরও কখনো কখনও কি এমন মনে হয় যে, কিছু হারাচ্ছেনও আপনি? চাইলেও আরেকজন তরুণের মতো ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারছেন না?।

আফ্রিদি: কখনো কখনো সত্যিই মনে হয়। পাকিস্তানে আমাদের কোনো প্রাইভেসি নেই। আমি সবচেয়ে বেশি মিস করি বন্ধুদের সঙ্গে খোলা মাঠে বসে আড্ডা দেয়াটা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার আগে আমি নিয়মিত ওদের সঙ্গে কোনো পার্ক বা রেস্তোরাঁয় বসতাম, গল্প করতাম, মজার মজার জোক বলতাম। এখন আর তা পারি না। এটা সত্যিই খুব মিস করি।

শুভ্র: সাফল্য কি একটু বদলে দিয়েছে আপনাকে?

আফ্রিদি: আমার মনে হয়, একটু হয়তো বদলেছে। তবে আমার বন্ধুরা বলে আমি একটুও বদলাইনি। আমি সেই আগের শহীদই আছি।

শুভ্র: ক্রিকেট থেকে বিশেষ কিছু পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন?

আফ্রিদি: আমি পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হতে চাই। এটিই আমার স্বপ্ন।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×