`আধুনিক ওয়ানডে খেলার প্লেয়ারই নেই ইংল্যান্ড দলে`
উৎপল শুভ্র
২৩ ডিসেম্বর ২০২১
শিরোনাম দেখে চমকে যেতে পারেন। তবে সময়টা ২০১৫ সালের মার্চ, এটা বললে হয়তো ডেভিড লয়েডের কথাটা বুঝতে পারবেন। ইংল্যান্ডের পক্ষে সত্তরের দশকে ৯টি টেস্ট ও ৮টি ওয়ানডে খেলেছেন। দ্বিতীয় টেস্টেই অপরাজিত ২১৪ রান, অথচ বাকি ১৪টি ইনিংসে কোনো ফিফটিও নেই। সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারের একটা ব্যাখ্যা মেলে এতে। খেলা ছাড়ার পর আম্পায়ারিং-কোচিং করেছেন, এর পর ধারাভাষ্যে। এই সাক্ষাৎকারটা নেওয়া হয়েছিল ২০১৫ বিশ্বকাপে নেলসনে বাংলাদেশ-স্কটল্যান্ড ম্যাচের সময়।
প্রথম প্রকাশ: ৭ মার্চ ২০১৫। প্রথম আলো।
উৎপল শুভ্র: খেলোয়াড়, আম্পায়ার, কোচ, ধারাভাষ্যকার...আপনার সারা জীবনই তো ক্রিকেটে কাটল। লোকে মাইক হাসিকে ‘মিস্টার ক্রিকেট’ বলে, আমার কাছে ‘মিস্টার ক্রিকেট’ তো আপনিই!
ডেভিড লয়েড: (হাসি) আমি ক্রিকেট খেলাটা খুব পছন্দ করি। এটা একটা বড় সুবিধা। খেলাটা এখনো খুবই উপভোগ করি। বিশেষ করে এই বিশ্বকাপ খুবই উপভোগ করছি। বৃত্তের মধ্যে পাঁচজন ফিল্ডার থাকার কারণে ব্যাটসম্যানরা অবিশ্বাস্য স্বাধীনতা নিয়ে খেলছে। বড় বড় স্কোর হচ্ছে...৪০০-ও তো এখন কোনো ব্যাপার মনে হচ্ছে না!
শুভ্র: কিন্তু খেলাটির জন্য কি তা ভালো? ক্রিকেট বড় বেশি ব্যাটসম্যানদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে না?
ডেভিড লয়েড: না, আমি তা মনে করি না। যারা ভালো বোলার, তারা তো ঠিকই ভালোই করছে। এমনকি স্লো বোলাররাও। ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে দেখুন, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কেমন প্রভাব ফেলছে খেলায়...কারণ সে ভালো। আপনাদের সাকিব আল হাসানও তো...বাঁহাতি স্পিনার, দারুণ ক্রিকেটার। এই বিশ্বকাপে দারুণ কিছু ফাস্ট বোলারকেও দেখছি, গতিময় শক্তিশালী ফাস্ট বোলার। খেলাটা যেভাবে হচ্ছে, আমি কোনো সমস্যা দেখি না। ভালো বোলাররা ঠিকই ভালো করবে। ভালো ব্যাটসম্যানরা বোলারদের চাপে ফেলবে।
শুভ্র: অ্যাডিলেডে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচটা তো এখন এই বিশ্বকাপের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল হয়ে গেল...
ডেভিড লয়েড: বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচটা দুই দলের জন্যই শ্যুটআউট। জিতলেই কোয়ার্টার ফাইনাল। অ্যাডিলেডের ওই ম্যাচটি খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শুভ্র: এই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের দুর্দশা দেখে আপনি কি একটু বিস্মিত?
ডেভিড লয়েড: না, না, একটুও না। ওয়ানডেতে আমি ইংল্যান্ডের কাছে বেশি কিছু আশাই করি না। সাম্প্রতিক অতীতেও তো ওরা জেতা দূরে থাক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করতে পারেনি। অল্প রানে আউট হয়ে গেছে, অনেকবারই পুরো ৫০ ওভার ব্যাটিং করতে পারেনি। বোলাররা বেধড়ক পিটুনি খেয়েছে। বরং এই বিশ্বকাপে অন্য দলগুলোকে দেখুন...নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা, ইন্ডিয়া ওরা দুর্দান্ত প্রাণবন্ত ক্রিকেট খেলছে।
শুভ্র: ১৯৯৯ বিশ্বকাপে তো আপনি ইংল্যান্ডের কোচ ছিলেন। মনে আছে, বিশ্বকাপের অফিশিয়াল অ্যানথেম যখন বাজারে এল, আয়োজক ইংল্যান্ড বিশ্বকাপেই নেই। ওয়ানডেতে ইংল্যান্ড পারে না কেন?
ডেভিড লয়েড: আমার তো মনে হয় আধুনিক ওয়ানডে খেলাটা খেলতে পারে, এমন প্লেয়ারই আমাদের নেই। অন্য দলগুলোকে দেখেন, ওরা বল ছাড়ে না। ওয়ানডেতে তো বল ছাড়ার জিনিস না, মারার জিনিস। বাইরের বল হলে ছেড়ে দেব কেন, আরও জোরে মারব। অন্য দলগুলো তো তা-ই করে। অন্যদের দেখেও ওরা শেখেনি। ডেভিড ওয়ার্নার, অ্যারন ফিঞ্চ, ডি কক, ম্যাককালাম...আপনাদের তামিম ইকবালও তো দারুণ মারে। ঝুঁকি নেওয়া, ভয়ডরহীন মুক্ত মনে খেলার বার্তা এখনো ইংল্যান্ডের কাছে পৌঁছেনি। আমরা ব্যাটিং করার সময় তিন শ করা নিয়ে অনেক ট্যাকটিক্যাল হাতি-ঘোড়া মারি। যেখানে অন্য দলগুলো ৩৪০-৩৫০ এমনকি এখন চার শরও চিন্তা করে। আমরা আসলে এটা মাথায়ই নিতে পারিনি। এটা বলার পরও অবশ্য বিতর্ক থাকবে, বুঝলেও এটা করার মতো খেলোয়াড় আমাদের আছে কি না। ইংল্যান্ডের বোলিংয়ের দিকেও যদি তাকান, চারজন সিম বোলার প্রায় একই রকম। স্পিনারও তেমন নেই। ওই মঈন আলী যা একটু স্পিন করতে পারে। ইংল্যান্ডের বোলিং আক্রমণ তাই খুবই অনুমেয়। ভালো দলগুলোতে অনেক বৈচিত্র্য, পেসারদের মধ্যে, স্পিনারদের মধ্যে। ওদের ফাস্ট বোলাররা খুব জোরে বল করতে পারে, ভালো বাউন্সার দিতে পারে।
শুভ্র: বিশ্বকাপের আগে অধিনায়কত্ব থেকে অ্যালিস্টার কুককে সরিয়ে দেওয়াটা তা হলে কোনো কাজেই আসেনি?
ডেভিড লয়েড: না, না...এতে কী হবে, এই দলে অন্য চারজন খেলোয়াড় আনলেও কিচ্ছু হবে না। এটা খেলোয়াড় পরিবর্তনের ব্যাপার নয়, মানসিকতা বদলানোর ব্যাপার। ইংল্যান্ডের কোচ-খেলোয়াড়দের সাক্ষাৎকারে শুধু পরিসংখ্যান, পরিকল্পনা এসব কথা। সহজাত খেলা, মুক্ত মনে খেলার চিন্তাই নেই। আরে বাবা, এতে থিওরি কপচে কী হবে? মাঠে যাও, উপভোগ করো।
শুভ্র: তারপরও বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচে ইংল্যান্ডই ফেবারিট, তাই না?
ডেভিড লয়েড: না, না, ...ইংল্যান্ড দলে কারা খেলছে এটা আগে জানতে চাই, তার চেয়ে বেশি জানতে চাই টসটা কে জিতছে।
শুভ্র: টসটা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে?
ডেভিড লয়েড: আমি তাই মনে করি। যদি বাংলাদেশ টসে জিতে ব্যাটিং নেয় এবং পরে ভালো করে স্পিনারদের লেলিয়ে দেয়, অ্যাডিলেডে বাংলাদেশই ফেবারিট। ইংল্যান্ডকে বড় স্কোর তাড়া করতে হলে অবিশ্বাস্য ব্যাটিং করতে হবে....কারণ এটা হবে স্পিন-স্পিন-স্পিন। আমি হলে তো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শুধু স্পিনারই নিতাম। পেস বোলিং করাতামই না। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যত বেশি স্পিনার নেওয়া যায়, ততই ভালো। অতীতে ইংল্যান্ড কখনোই স্পিন ভালো খেলেনি। না, আমি ইংল্যান্ডকে মোটেই ফেবারিট মনে করি না।
শুভ্র: গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল। এটি কি বাংলাদেশকে কোনো মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা দেবে?
ডেভিড লয়েড: বাংলাদেশ যদি এই ম্যাচটা (স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে) জিতে যায়, ওদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যাবে। আর ইংল্যান্ড তো যাচ্ছেতাই খেলছে। আত্মবিশ্বাস বলতে কিছু নেই। আমার চোখে অ্যাডিলেডে বাংলাদেশের সম্ভাবনাই বেশি দেখছি আমি।
শুভ্র: বিশ্বকাপ জিতবে কে?
ডেভিড লয়েড: অস্ট্রেলিয়া। টুর্নামেন্টের আগে আমি অস্ট্রেলিয়ার কথা বলেছি। তা থেকে আমি সরছি না।
শুভ্র: এই বিশ্বকাপে নতুন কী আপনার চোখে পড়েছে?
ডেভিড লয়েড: শেষ ১৫ ওভারে যেভাবে রান উঠছে। ব্যাটসম্যানরা ওই সময়টায় অবিশ্বাস্য স্বাধীনতা নিয়ে খেলছে। যদি তুমি মিচেল জনসন, মিচেল স্টার্ক হও; তা হলেই তোমার একটু সুযোগ আছে। নইলে বোলারদের ওই সময় ত্রিশঙ্কু অবস্থা।
শুভ্র: এই যে সারা জীবনই ক্রিকেটের সঙ্গে কাটিয়ে দিলেন, খেলাটিতে কখনো ক্লান্তি আসেনি?
ডেভিড লয়েড: না। তবে ক্রিকেট কিন্তু আমার প্রথম পছন্দের খেলা নয়। আমার প্রথম পছন্দ ফুটবল।
শুভ্র: তা-ই নাকি! তা কোন ক্লাবের সমর্থক আপনি?
ডেভিড লয়েড: অ্যাক্রিংটন স্ট্যানলি। ডিভিশন টুতে খেলে। আমার নিজের শহরের ক্লাব। একবার তো ভেবেছিলাম ক্লাবটা কিনেই নেব। কিন্তু আমার তো অত টাকা নেই (হাসি)।