ড্যারেন স্যামির সাক্ষাৎকার
‘আমি ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের উত্তরাধিকার’
উৎপল শুভ্র
২০ ডিসেম্বর ২০২১
পরে দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে অধিনায়ক হিসেবে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন নিজেকে। ড্যারেন স্যামির এই ইন্টারভিউ অবশ্য এরও আগে। ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সময় মিরপুর একাডেমি মাঠে নেওয়া এই ইন্টারভিউয়ে স্যামির নেতৃত্বগুণের চেয়েও বেশি মূর্ত হয়ে উঠেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর জানাশোনা এবং শ্রদ্ধাবোধ।
প্রথম প্রকাশ: ৩ মার্চ ২০১১। প্রথম আলো।
উৎপল শুভ্র: মাত্র সাত বছর আগেও যে সেন্ট লুসিয়ায় কোনো টেস্ট ক্রিকেটারই ছিল না, সেই সেন্ট লুসিয়ারই ড্যারেন স্যামি এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক! আপনার কাছে এর অর্থ কী?
ড্যারেন স্যামি: আমার কাছে এর অর্থ...এক কথায় বিরাট ব্যাপার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দীর্ঘ ইতিহাসের উত্তরাধিকার এই অধিনায়কত্ব। পেছনে ফিরে গেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক ফ্র্যাঙ্ক ওরেল থেকে শুরু করে কত বড় বড় নাম... আমি ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের উত্তরাধিকার। এটা অনেক বড় একটা সম্মান। এর অর্থ, মানুষ আমার মধ্যে নেতৃত্বগুণ দেখেছে। আমি তাদের আস্থার প্রতিদান দিতে চাই।
শুভ্র: বড় সম্মান, আবার একই সঙ্গে বড় দায়িত্বও, তাই না?
স্যামি: তা তো বটেই। কাজটা অবশ্যই সহজ নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক মানে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের গৌরবময় ঐতিহ্যের জিম্মাদার। দায়িত্বটা কঠিন, তবে একই সঙ্গে এত গর্বের যে আমি এর জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারি।
শুভ্র: ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই প্রজন্মের ক্রিকেটারদের সম্পর্কে একটা সাধারণ অভিযোগ হলো, তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন নয়। আপনাকে তো অন্য রকম মনে হচ্ছে...
স্যামি: না, না, এটা ঠিক নয়। আমাদের তরুণ খেলোয়াড়েরা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের ইতিহাস সম্পর্কে যথেষ্টই সচেতন। এমন কথা ওঠার একটাই কারণ, মানুষ যেমন প্রত্যাশা করে, আমাদের পারফরম্যান্স তেমন হয়নি। তবে এ ব্যাপারে আমার মনে একটুও সংশয় নেই, প্রত্যেকে নিজের সেরাটা উজাড় করে দিতেই মাঠে নামে। শুধু নিজেদের কথা ভেবেই নয়, ক্যারিবিয়ান জনগণের কাছে ক্রিকেটটা কী, এ ব্যাপারেও সবাই সচেতন।
শুভ্র: সেন্ট লুসিয়ায় গিয়ে যা জেনেছি, এটি ফরাসি উপনিবেশ ছিল বলে ক্যারিবিয়ানের অন্য দ্বীপগুলোর মতো সেখানে ক্রিকেট জনমানসে সেভাবে ছায়া ফেলেনি। সেন্ট লুসিয়ার কেউ যেখানে এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে খেলেনি, আপনি কীভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখলেন?
স্যামি: আমি ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের পাগল। যখন বেড়ে উঠছি, তখনো ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ব ক্রিকেটে দাপটে রাজত্ব করছে। আমার প্রিয় বোলার কার্টলি অ্যামব্রোস তখন দলে, প্রিয় ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লারাও। ওদের দেখেই আমার মনে স্বপ্নটা বাসা বাঁধে, আমিও একদিন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার হব। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা। থেকে এটাও জানি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতলে সেটি ক্যারিবিয়ান জনগণকে কেমন আনন্দে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
শুভ্র: সেন্ট লুসিয়া থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক! স্বপ্নচারীর পক্ষেও তো ভাবা কঠিন...
স্যামি: এখনো স্বপ্নের মতোই মনে হয়। তবে একটা কথা বলি, অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলারও অনেক আগে, স্কুলে পড়ার সময়ই আমি সেন্ট লুসিয়া থেকে প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার হতে চেয়েছি। ২০০৪ সালে সেই স্বপ্ন সত্যি হওয়াটা ছিল বিরাট একটা সম্মানের ব্যাপার। এরপর এখন অধিনায়ক... এটা আরও বড় অর্জন।
শুভ্র: ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়কত্বটা কি একটু বিস্ময় হয়েই এসেছিল? দলেই তো নিয়মিত ছিলেন না সব সময়...
স্যামি: আমি যখনই সুযোগ পেয়েছি, নিজেকে উজাড় করে তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যাপ্টেন হব, আমি কখনো দেখিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের অংশ হয়ে থাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল আমার হ্যাঁ, খবরটা পেয়ে একটু বিস্মিতই হয়েছিলাম। তবে দায়িত্ব যখন পেয়েছি, এটাকে ভালোভাবেই কাজে লাগাতে চাই।
শুভ্র: যতটুকু দেখেছি, আপনি খুব আমুদে হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকেন, মজা করেন। ক্যাপ্টেন হওয়ার পর নিজেকে একটু বদলেছেন নাকি?
স্যামি: (হাসি) না, না একটুও বদলাইনি। আমার স্বাভাবিক চরিত্রের সঙ্গে মুখ গোমড়া করে থাকাটা একদম যায় না। আমার মা-বাবা আমাকে যেভাবে বড় করেছেন, সেটির বড় ভূমিকা আছে। এতে। মা-বাবার মতো বেড়ে ওঠার সময় যাদের চারপাশে পেয়েছি, তারা সবাই খুব আমুদে মানুষ। আমিও হাসিখুশি থাকতেই পছন্দ করি।
শুভ্র: ২০০৪ সালে সেন্ট লুসিয়াতে দেখেছি সবার মুখে মুখে আপনার নাম। আপনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যাপ্টেন হওয়ার পর তো কয়েক দিন ধরে উৎসব হওয়ার কথা...
স্যামি: (হাসি) তা হয়েছে। পুরো জাতি এটা নিয়েই মেতে ছিল। রেডিও টিভিতে টক শোর পর টক শো হয়েছে, রাস্তায় একে অন্যকে অভিনন্দন জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিশেষ সংবর্ধনা দিয়ে আমাকে রাষ্ট্রদূত ঘোষণা করেছেন, কূটনৈতিক পাসপোর্ট দিয়েছেন। এত বছর যে সেন্ট লুসিয়া একজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারও পায়নি, সেখানে এক সেন্ট লুসিয়ান ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যাপ্টেন! পুরো দেশই খুব গর্বিত এ নিয়ে।
"অধিনায়ক হিসেবে আমি অনেকের অনুরাগী। তবে আমার স্টাইলটা হলো নিজে হৃদয় দিয়ে খেলা আর সতীর্থদের জন্য এমন একটা মানসিক অবস্থা তৈরি করা, যাতে তারা মাঠে নেমে সেরা খেলাটা খেলতে পারে।"
শুভ্র: সাত বছর ধরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে খেলছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের মূল সমস্যাটা কি ধরতে পেরেছেন?
স্যামি: ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে এখনো দারুণ সব প্রতিভা আছে। কিন্তু সেই প্রতিভা ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে রূপ পাচ্ছে না। এটা হলে আমরা আবার দাপুটে রূপে দেখা দেব। কিন্তু মুখে বলে তো লাভ নেই, ক্রিকেট মাঠে এর প্রমাণ দিতে হবে। অনেক দিন ধরেই আমরা তা পারছি না।
শুভ্র: না পারার কারণটা কী?
স্যামি: ম্যাচে আমরা সব সময়ই সুযোগ তৈরি করি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সেই সময়গুলো কাজে লাগানোর মতো মনঃসংযোগে ঘাটতি আছে আমাদের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন করলে এর অনেক বড় মূল্য দিতে হয়। এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটকে আবার আগের গৌরব ফিরিয়ে দেওয়ার বিশাল দায়িত্ব এই প্রজন্মের ক্রিকেটারদের ওপর।
শুভ্র: আপনার নেতৃত্বের ধরনটা কীভাবে বর্ণনা করবেন? কাউকে কি আদর্শ মানেন?
স্যামি: অধিনায়ক হিসেবে আমি অনেকের অনুরাগী। ফ্র্যাঙ্ক ওরেল আছেন, অস্ট্রেলিয়া সফরে (১৯৬০ ৬১) যেভাবে উনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন, সেটি কে ভুলবে! স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড...স্টিভ ওয়াহর কথাও বলি-মানসিকভাবে দারুণ শক্ত এক অধিনায়ক। অধিনায়ক হিসেবে যাঁরা সফল হয়েছেন, সবার কাছ থেকেই শেখার আছে। তবে আমার স্টাইলটা হলো নিজে হৃদয় দিয়ে খেলা আর সতীর্থদের জন্য এমন একটা মানসিক অবস্থা তৈরি করা, যাতে তারা মাঠে নেমে সেরা খেলাটা খেলতে পারে।
শুভ্র: অনেক ধন্যবাদ। বাংলাদেশ ছাড়া বাকি ম্যাচগুলোর জন্য শুভকামনা...
স্যামি: বাংলাদেশ ছাড়া মানে...ও হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি (অট্টহাসি)।