২০১৫ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে গ্যাভিন লারসেনের সাক্ষাৎকার

‘বাংলাওয়াশ না কী যেন বললেন, আমার মনে হয় ওটাই টার্নিং পয়েন্ট`

উৎপল শুভ্র

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

‘বাংলাওয়াশ না কী যেন বললেন, আমার মনে হয় ওটাই টার্নিং পয়েন্ট`

গ্যাভিন লারসেন। ছবি: নেলসন ক্রিকেট

বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের দল...এই তকমা গা থেকে ঝেড়ে ফেলে পরপর দুটি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে ফেলেছে নিউজিল্যান্ড। ২০১৫ বিশ্বকাপে এই সেমিফাইনাল `গেরো` কাটার কাজটা করেছিল ব্রেন্ডন ম্যাককালামের দল। তাতে বাংলাদেশেরও ভূমিকা দেখেছিলেন ১৯৯২ বিশ্বকাপ দলের ব্যতিক্রমী তারকা গ্যাভিন লারসেন। সেটা কীভাবে?

২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার আগে নিউজিল্যান্ডের সেরা বিশ্বকাপ বলতে ১৯৯২-কেই বোঝাত। যা মনে হলে শুরুতে মার্ক গ্রেটব্যাচের ঝড় আর নতুন বলে দীপক প্যাটেলের অফ স্পিনই সবার আগে চোখে ভাসে। মার্টিন ক্রোর আরেকটি মাস্টার স্ট্রোক ছিল, তখনকার ধীরগতির নিউজিল্যান্ড উইকেটে স্লো মিডিয়াম বোলারদের ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করা। বোলিংয়ের ধরনের কারণে রড ল্যাথাম, গ্যাভিন লারসেন ও ক্রিস হ্যারিসের নাম হয়ে গিয়েছিল ডিবলিস্-ডবলিস্-উবলিস্! সেই ত্রয়ীর একজন গ্যাভিন লারসেন ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালের আগের দুপুরে এমসিজির প্রেসবক্সে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ২৩ বছর আগে-পরের দুই বিশ্বকাপের মধ্যে আসা-যাওয়া করেছিলেন।

উৎপল শুভ্র: শেষ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলছে। এ নিয়ে আপনি কতটা গর্বিত?

গ্যাভিন লারসেন: খুবই খুবই গর্বিত। সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে তো বটেই। তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছি, কিন্তু ফাইনাল স্বপ্নই হয়ে থেকেছে। এলওসির (লোকাল অর্গানাইজিং কমিটি) সদস্য হিসেবে আরও বেশি গর্বিত। টুর্নামেন্টটা দারুণ গেছে। যৌথ আয়োজক দুই দেশ ফাইনালে, এর চেয়ে ভালো পাণ্ডুলিপি কেউ লিখতে পারত না!

শুভ্র: এই দল ফাইনালে ওঠার আগে ১৯৯২ বিশ্বকাপ ঘুরেফিরে এসেছে। তবে সেই বিশ্বকাপ তো গর্ব আর বেদনা দুটিই উপহার দিয়েছে আপনাদের। বেদনাটার কি এত দিনে ছুটি হলো?

লারসেন: বলতে পারেন, পিঠের ওপর থেকে একটা বোঝা নেমে গেছে। সেমিফাইনাল ও কোয়ার্টার ফাইনালে আমরা এতবার হোঁচট খেয়েছি যে, মনে হচ্ছিল ফাইনালের সঙ্গে বুঝি নিউজিল্যান্ডের কোনো শত্রুতা আছে। এই দলটা আসলেই স্পেশাল। ভারসাম্য বিবেচনায়, বিস্ফোরক খেলোয়াড়ের সংখ্যা বিবেচনায় নিউজিল্যান্ডের অন্য যেকোনো দলের চেয়ে এটি ভালো। আমি সত্যি বিশ্বাস করি, ওরা শিরোপা জিততে পারে।

শুভ্র: খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ের নয় নম্বরে নেমে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। সেই দলটিই এমন বদলে গেল কীভাবে?

লারসেন: শুরুটা হয়েছে মাথা থেকে। এই ম্যানেজমেন্ট টিমটা দুর্দান্ত। মাইক হেসন (নিউজিল্যান্ডের কোচ) মাঠের বাইরে দারুণ নেতৃত্ব দিয়েছে। আর মাঠের নেতৃত্বও দুর্দান্ত। ব্রেন্ডনের (ম্যাককালাম) ক্যাপ্টেনসিতে অনেক অভিনবত্ব আছে। ও আক্রমণাত্মক, ইতিবাচক এবং সম্ভবত জীবনের সেরা ফর্মে আছে। দলের অন্য খেলোয়াড়েরা ওকেই অনুসরণ করছে। এই দলে দক্ষতা ও ভারসাম্যের অভাব নেই। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, সাফল্যকে ওরা মাথায় যেতে দেয়নি।

শুভ্র: ১৯৯২ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের অমন হইচই ফেলে দেওয়ায় মার্টিন ক্রোর অধিনায়কত্বের বড় ভূমিকা। মার্টিন ক্রোর সঙ্গে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের কি কোনো মিল খুঁজে পান?

লারসেন: দুজনই খুব বুদ্ধিমান, ট্যাকটিক্যালি খুব ভালো, আমি বলব চালাক অধিনায়ক। মার্টিন হয়তো ব্রেন্ডনের মতো এতটা আক্রমণাত্মক ছিল না। ব্রেন্ডনের মন যা বলে ও তা-ই করে। এমন করা ঠিক হবে কি হবে না, এসবের ধার ধারে না। আর ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম আক্রমণ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। যেখানে মার্টিন আরেকটু ভেবেচিন্তে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করত।

শুভ্র: সেই বিশ্বকাপ বিখ্যাত হয়ে আছে ডিবলিস্-ডবলিস্-ওবলিস্ বোলিং আক্রমণের কারণে...এবার তো নিউজিল্যান্ডের সাফল্যের রেসিপি অন্য—ট্রেন্ট বোল্টের মতো ফাস্ট বোলারদের গতির ঝড় তোলা...

লারসেন: অনেক কিছু মিলেই এটা হয়েছে। প্লেয়িং কন্ডিশন, শক্ত ও বাউন্সি উইকেট, আগের চেয়ে বড় ব্যাট, ছোট বাউন্ডারি, এর সঙ্গে টি-টোয়েন্টির প্রভাব যোগ হয়ে খেলাটা এখন অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। এখন আর অফ স্টাম্পের ওপর আমাদের মতো ওই ডবলি-ডাবলি বোলিংয়ের সুযোগ নেই। এখন পুরো ম্যাচেই আক্রমণাত্মক বোলিং করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

শুভ্র: ফাইনাল নিয়ে কি ১৯৯২ বিশ্বকাপ দলের কোনো পরিকল্পনা আছে? যেমন ধরুন, সবাই এমসিজিতে একসঙ্গে বসে খেলাটা দেখলেন...

লারসেন: টুর্নামেন্টের শুরুতে আমাদের একটা পুনর্মিলনী হয়েছে। অকল্যান্ডের সেই গালা ডিনারে অনেক মজা হয়েছে। তবে এখানে কয়জন আসবে আমি জানি না। সংখ্যাটা খুব বেশি হওয়ার কথা নয়।

শুভ্র: কী বলেন, এমন একটা ম্যাচ, সবাই একসঙ্গে বসে দেখবেন না?

লারসেন: (হাসি) যদি জাদুগোলক হাতে থাকত আর আমরা জানতে পারতাম আমাদের দল ফাইনালে উঠবে, তাহলে হয়তো আগে থেকেই পরিকল্পনা করে সবাই দল বেঁধে চলে আসতাম। একসঙ্গে হইচই করে খেলা দেখতাম। ভালো তো লাগতই। এখানে দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতেই তো কেমন লাগছে! নিউজিল্যান্ড দল ফাইনালে! তবে নাইনটি টুর দলের যে যেখানেই থাকুক, খেলা দেখবে। আশা করবে, নিউজিল্যান্ড প্রথম বিশ্বকাপ জিতবে।

শুভ্র: বাংলাদেশের মানুষ তো নিউজিল্যান্ড ফাইনালে ওঠায় খুব খুশি। কারণ কী জানেন, সর্বশেষ দুটি ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশ ৪-০ ও ৩-০ জিতেছে। যেটিকে আমরা বলি ‘বাংলাওয়াশ’! সেই দলই কিনা ফাইনালে! ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ৩-০-তে হেরে আসাটাই কি তাহলে নিউজিল্যান্ড দলের জন্য টার্নিং পয়েন্ট?

লারসেন: ‘বাংলাওয়াশ’ না কী যেন বললেন, আমার মনে হয় ওটাই টার্নিং পয়েন্ট। মাইক হেসন এলেন...সত্যি বললে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট মাঝখানে খুব বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে। এখন আমাদের ক্রিকেট-কাঠামোটা ঠিক আছে। হ্যাঁ, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি অবসর নেওয়ার পর টেস্ট ম্যাচে কে হবে পরের স্পিনার, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। টেস্ট ওপেনারদের নিয়েও। তবে সীমিত ওভারের খেলায় নিউজিল্যান্ড দারুণ দল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।২০১৫ বিশ্বকাপের আগে, উত্তরসূরিদের সঙ্গে গ্যাভিন। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে ওই দুটি ‘বাংলাওয়াশ’ কতটা ধাক্কা ছিল?

লারসেন: কেন, বাংলাদেশ তো ভালো দল! এই বিশ্বকাপে তারা তা প্রমাণও করেছে। যোগ্য দল হিসেবেই কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে। ব্যাপারটা হলো, অন্য দেশে ভিন্ন কন্ডিশনে গিয়ে ক্রিকেট খেলা সব সময়ই কঠিন। এই যে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ ফাইনালে, এতে আমি একটুও বিস্মিত নই। নিজেদের দেশে খেলার সুবিধাটা ওরা পেয়েছে। আমি উপমহাদেশে অনেক খেলেছি, আমাদের দেশে খেলা আর ওখানে খেলার মধ্যে অনেক পার্থক্য।

শুভ্র: কালকের ফাইনালে কী পার্থক্য গড়ে দিতে পারে বলে মনে করেন?

লারসেন: এক্স ফ্যাক্টর আছে, এমন কোনো খেলোয়াড়ই দেখবেন পার্থক্য গড়ে দেবে। আশা করি, সেই খেলোয়াড়টি নিউজিল্যান্ডার হবে। সবাই ব্রেন্ডন ম্যাককালামের কথা বলবে, ও একটা শুরু করে দিলে তো দারুণ হয়! তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এটা হবে উইলিয়ামসন বা টেলর।

শুভ্র: শেষ প্রশ্ন, ১৯৯২ বিশ্বকাপে আপনাদের ওই দল আর ব্রেন্ডন ম্যাককালামের এই দলের মধ্যে খেলা হলে কারা জিতবে?

লারসেন: আগেই তো বললাম, এই দলটি নিউজিল্যান্ডের সব বিশ্বকাপ দলের মধ্যে সেরা। তবে ম্যাচটা যদি সত্যিই হয়, সত্যিই হয়...মার্টিন (ক্রো) কি জাদুকরি কিছু বের করবে মাথা থেকে? না, মনে হয় না আমরা এদের সঙ্গে পারব।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×