কেমন ছিলেন মানুষ ম্যারাডোনা

কাশীনাথ ভট্টাচার্য

৩০ অক্টোবর ২০২১

কেমন ছিলেন মানুষ ম্যারাডোনা

আত্মজীবনীতে নাকি মানুষটাকে চেনা যায় না। ডিয়েগো ম্যারাডোনার ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। `এল ডিয়েগো`-এর পাতায় পাতায় মূর্ত মানুষ ম্যারাডোনা। সেই আত্মজীবনীর লেখক মার্সেলা মোরা ই আরাউহোর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাশীনাথ ভট্টাচার্য। যাতে এই বই লেখার ইতিহাসের সঙ্গে উঠে এসেছে আর্জেন্টিনার ফুটবল সংস্কৃতি এবং অতি অবশ্যই বহুমাত্রিক এবং সহজ ব্যাখ্যার অতীত এক মানুষ ডিয়েগো ম্যারাডোনার মনস্তত্ত্বও।

মারাকানার মিডিয়া সেন্টারে ছুটতে ছুটতে এলো উমেইদ ওয়াসিম। পাকিস্তানের ক্রীড়া সাংবাদিকতার ইতিহাসে প্রথম সাংবাদিক যে বিশ্বকাপ ‘কাভার’ করতে গিয়েছিল ব্রাজিলে। ‘কাশীভাই, জলদি চলো, মার্সেলা এসেছে’!

২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে উমেইদের সঙ্গে পরিচয়ের গল্প বলা যাবে অন্যত্র। ‘এল ডিয়েগো’-র লেখক মার্সেলা মোরা ই আরাউহো সম্পর্কে, বইটা সম্পর্কে এক দিন গল্প হচ্ছিল। সেই সূত্রেই তাঁকে দেখে উমেইদের মনে পড়েছিল আমার কথা। কোনো রকমে ল্যাপটপের দরজা বন্ধ করে দৌড়ুই।

আলাপ-পরিচয় সেই মিডিয়া সেন্টারে। পরে, নানা কথা আরও। ইংরেজিতে একটি রিভিউ করেছিলাম ‘এল দিয়েগো’ বই-এর। তাঁকে পাঠানোর পর খুশি হয়ে তিন লাইন লিখেছিলেন, প্রাপ্তি!

গত বছর ডিয়েগো ম্যারাডোনার প্রয়াণের পর অনুরোধ করেছিলাম সাক্ষাৎকারের জন্য। একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম। ব্যস্ত ছিলেন। ‘এখন সময় নেই ভাই। যা যা প্রশ্ন পাঠিয়েছেন, ভেবে ভেবে উত্তর দিতে হবে। হাতে এত কাজ, একটা ছবি শেষ করছি, বই এবং অন্যান্য লেখাও আছে–জানি না কবে সময় দিতে পারব।’ অপেক্ষায় ছিলাম।

প্রায় মাস তিনেক পর সময় পেলেন, উত্তর দিলেন কিছু প্রশ্নের। পরে আরও কিছু। সব মিলিয়ে মাসখানেক সময় নিয়ে ইন্টারভিউ। বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের কাছে মার্সেলা ছিলেন ম্যারাডোনার মুখ। তাই তাঁর মুখ থেকেই শুনে-নেওয়া ম্যারাডোনা সম্পর্কে, সরাসরি, ডিয়েগো-দর্শন!

প্রশ্ন: ‘এল ডিয়েগো’ অনুবাদের দায়িত্ব পেয়েছিলেন যেভাবে, গল্পটা ...

মার্সেলা মোরো ই আরাউহোমার্সেলা মোরো ই আরাউহো: বইয়ের ব্যাপারে প্রকাশকদের সঙ্গে তো বটেই, বহু দিন ধরেই কথা বলছিলাম ডিয়েগোর পরিবার এবং কাছের লোকদের সঙ্গেও। পরে ওঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ‘টিওয়াইসি’-র সঙ্গে কাজ করবেন। প্রোজেক্টের টাকাও দেবে ‘টিওয়াইসি’, যারা আর্জেন্টিনার স্পোর্টস ব্রডকাস্টার। পরে যখন সেই বই ছাপার অধিকার পেল ‘ইউকে’, প্রকাশক আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন। তবে এটাই ডিয়েগো-অনুবাদে আমার প্রথম প্রচেষ্টা নয়! ১৯৯৬-এর বেশ মজার একটা ঘটনা জানানো দরকার। লন্ডনে এসেছিলেন ডিয়েগো। প্রেস কনফারেন্স হবে, যথারীতি হাজির আমিও। ডিয়েগো সেই ঘরে এলেন যখন, মাইকে হঠাৎ আমার নাম শোনা গেল প্রবল হইহট্টগোলের মধ্যে। কিছু বোঝার আগেই একজনের হাত কাঁধে। আমাকে সোজা নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল ডিয়েগোর পাশে। বুঝতে পারি, ডিয়েগোর ইন্টারপ্রেটার হতে হবে। ইংরেজি প্রশ্নগুলো স্প্যানিশে অনুবাদ করা এবং ডিয়েগোর উত্তর ইংরেজিতে জানানোর কাজ। অসুবিধার প্রশ্ন ছিল না, দিব্যি চলছিল। সমস্যা হলো অন্যত্র!

জনৈক সাংবাদিক স্প্যানিশে প্রশ্ন করেছিলেন। আমি সেই দিনের অভ্যাসমতো প্রশ্নটা শুনে ইংরেজিতে ডিয়েগোর জন্য সাজিয়ে দিলাম!

ভুরুটা কুঁচকে গেল একটু। স্প্যানিশে বললেন, ‘আরে বাবা, আমি স্প্যানিশ বুঝি!’

এই ঘটনার প্রায় এক দশক পরে বেরিয়েছিল আত্মজীবনী। তত দিনে আর্জেন্টেনীয় ফুটবল নিয়ে প্রায় বছর পনের লেখালেখি করে ফেলেছি। আর্জেন্টিনার ফুটবলকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত এখনও। মাঠ এবং মাঠের বাইরে আর্জেন্টিনীয় ফুটবলের স্বরূপ, তার সংস্কৃতি, নিয়মকানুন বিশ্বের দরবারে হাজির করার কাজ করে চলেছি।

প্রশ্ন: ইংরেজিতে ‘এল ডিয়েগো’ পড়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। বেশ কিছু জিনিস বিশেষ করে মাথায় থেকে গিয়েছে। যেমন, একটা শব্দের ব্যবহার, ‘ভ্যাকসিনেট’। ডিয়েগো ঠিক কী অর্থে এই ‘ভ্যাকসিনেট’ শব্দটা ব্যবহার করতেন? বিশেষ বিশেষ গোলের ক্ষেত্রেই কি?

মার্সেলা: স্পেনীয় ভাষায় ‘ভ্যাকসিনেট’ শব্দের কাছাকাছি ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ইনজেক্ট’ বা ‘জ্যাব’ (বাংলায় ঠেলা, ধাক্কা, সিরিঞ্জ বা পিচকিরির সাহায্যে প্রবিষ্ট করানো)। আর ডিয়েগো এই শব্দটা ব্যবহার করতেন প্রায়ই। যে কোনও ব্যাপারেই! ধরুন, কোনও মহিলার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে, ডিয়েগো বলতেন, সেই মহিলাকে উনি ‘ভ্যাকসিনেট’ করেছেন! গোলের ক্ষেত্রে তো বটেই। কোনও দলের বিরুদ্ধে গোল দিয়েছেন মানেই ‘ভ্যাকসিনেট’ করেছেন তাদের!

আসলে, আর্জেন্টিনায় কথা বলার রীতিই এমন। তাই লেখাতেও ওই শব্দটাই ধরে রেখেছি আগাগোড়া। কিংবা ধরুন ‘শাউ’ (chau) বা ‘বিয়েখো’ (Viejo)। শাউ শব্দটা ইতালীয় ‘চিয়াও’ (ciao) থেকে। অর্থ, শেষ বা আর কিছু বলার নেই। বিয়েখো বলতে আর্জেন্তিনায় বোঝানো হয় ‘বুড়ো’। কিন্তু স্থানীয় ব্যবহারে অর্থ পাল্টে যায়, বন্ধু (ইংরেজিতে mate) বলা হয়।

ম্যাারাডোনার শব্দব্যবহারও সৃজনশীল, উদ্ভাবনী। অনেক শব্দের ক্ষেত্রে ম্যারাডোনা যা ব্যবহার করেছেন, একেবারেই নিজস্ব। আর্জেন্টিনার কথ্য ভাষায় সচরাচর অনেকেই সেই সব শব্দের এমন ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত নন। তবে, বুঝতে পারেন, অসুবিধা হয় না। চেষ্টা করেছিলাম সেই শব্দগুলোর আক্ষরিক অনুবাদ করতে, ইংরেজি শব্দ খুঁজে খুঁজে বের করতে। পরিশ্রম করতে হয়েছিল, একই সঙ্গে মাথায় ছিল, আর্জেন্টিনীয়রা কীভাবে কথা বলতেন বা বলছেন, ব্যাপারটা যাতে পৌঁছে দেওয়া যায় বিশ্বের কাছে। বিশেষ করে ম্যারাডোনার কথা বলার ধরনটাকে। যাতে আর্জেন্টিনীয়রা ওঁর কথার সঙ্গে যে-মিলটা পেয়ে থাকেন, অন্য ভাষাভাষী মানুষও যেন বুঝতে পারেন। বলতে পারেন, ম্যারাডোনার স্প্যানিশ বলার ধরনকে ইংরেজিতে ধরার চেষ্টা। প্রথম পড়বেন যখন, অবাক হবেন, আবার পড়বেন। কী বলতে চেয়েছেন ম্যারাডোনা বুঝতে চেয়ে। কিন্তু বই পড়া শেষ হবে যখন, কোনও অসুবিধা হবে না আর। আসলে, আর কোনও উপায়ে ম্যারাডোনাকে এভাবে ধরা যেত না!

ওঁর মৃত্যুর পর ‘এল ডিয়েগো’-র আবারও মুখবন্ধ লিখেছি। কিছু দিনের মধ্যেই হয়ত বিশ্বের পাঠক হাতে পাবেন। এ প্রসঙ্গেই জানাই, ‘এল ডিয়েগো’-ই মারাদোনার প্রকাশিত একমাত্র আত্মজীবনী, ‘ডিয়েগোর কথা, ডিয়েগোর মুখে’। ওঁর কথাগুলো ধরে রেখেছি যত্ন করেই। চেষ্টা করেছিলাম ওঁর মতো করেই ইংরেজিতে বলতে, যতটা নির্ভুল সম্ভব।

প্রশ্ন: ঠিক কতটা কঠিন বা জটিল ছিল অনুবাদে ম্যারাডোনার স্বরূপ ফুটিয়ে তোলা?

মার্সেলা: নানাবিধ জটিলতা ছিল। একদিকে ম্যারাডোনা নিজে এবং ওঁর সেই একান্ত নিজস্ব বাচনভঙ্গি, শব্দব্যবহার। দারিদ্র্যে জন্ম ও বেড়ে-ওঠা। রাস্তার ভাষাটা ওঁর ঠোঁটস্থ, কখনও ছেড়ে দেননি। ওঁর কথ্যভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলিকে আর্জেন্টিনায় আমরা বলি ‘লুনফারদো’। এই শব্দগুলো আর্জেন্টিনায় প্রধানত এসেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে। এনেছিল ইতালীয়রা। তারপর সেই ভাষার সঙ্গে কৃষকদের ব্যবহৃত শব্দ জুড়েছিল, একান্ত দেশীয় কিছু শব্দও। আর, প্রথম এই ভাষা ব্যবহারে দড় হয়ে উঠেছিল প্রধানত কয়েদিরা। হাজতের মধ্যে থাকাকালীন নিরাপত্তারক্ষীরা যাতে বুঝতে না পারে, কয়েদিরা নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করছে!

‘লুনফারদো’ ঠিক কেমন জানেন? ‘সিলেবল’ (শব্দাংশ) ভেঙে উল্টে দেওয়া! উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। বইতে ব্যবহৃত হয়েছে ম্যারাডোনার মুখে ‘ব্রোনকা’। আসলে শব্দটা ‘কাব্রোন’। এই ‘ব্রোনকা’ আর্জেন্তিনায় বহুল প্রচলিত শব্দ এখন। ব্যবহৃত হয় রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা বোঝাতে, কারও প্রতি তীব্র বিদ্বেষ থাকলে। ম্যারাডোনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পাল্টেও গেল! যে কোনও অনুভূতি বোঝাতেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়ে দাঁড়াল ‘ব্রোনকা’। মনে হতে বাধ্য, শব্দটার অর্থ বোধহয় ওঁর কাছে অনুপ্রেরণা। ওঁর জ্বালানি, ওঁর চালিকাশক্তি! এখন এই ‘লুনফারদো’ আর্জেন্টিনার বস্তিবাসীদের পাশাপাশি অভিজাত শ্রেণীতেও প্রচলিত। তাই ঠিক করে নিয়েছিলাম, ম্যারাডোনার ভাষা ম্যারাডোনার মুখে যেমন শুনে এসেছি, লেখাতেও সেভাবেই ব্যবহৃত হবে।

ম্যারাডোনার বইয়ের অনুবাদের কাজটা ফুটবলের ভাষার সন্ধানে অদ্ভুত এক যাত্রাপথ। আর ভাষাই যেহেতু কারও চিন্তন প্রক্রিয়াকে খুঁজে নেওয়ার একমাত্র বাহন, সেই ভাষার মাধ্যমেই আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা প্রতিভাবান ম্যারাডোনার মনের কথা তুলে আনার চেষ্টা করেছি। এই বিশ্বে ফুটবলার হিসাবে তিনি সর্বোৎকৃষ্ট। ওঁর গেম রিডিং অবাক করার মতো এবং একান্তই নিজস্ব। মাঠের কোথায় কী ঘটে চলেছে যেভাবে দেখতে পান, মনে হতে বাধ্য, বোধহয় ওপরে অদৃশ্য কোনও জায়গা থেকে দেখছেন। অদ্ভুতুড়ে, অলৌকিক! যে ম্যাচ তিনি খেলেছেন, তাঁর যে কোনো মুভ-এর বর্ণনা নির্ভুল, সংক্ষিপ্ত অথচ বিশেষজ্ঞের। তাই সেই কথাগুলোকে স্প্যানিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের কাজটা ছিল আমার কাছে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। বেশিরভাগ স্পেনীয় শব্দই কিন্তু রাখিনি।

কখনও কখনও বাধ্য হয়েই রাখতে হয়েছে। কারণ, আর্জেন্টিনীয় ফুটবল পরিভাষার তুল্য ইংরেজি প্রতিশব্দ ছিল না। বহু ফুটবলারের সঙ্গে দেখা করেছি, বুঝতে চেয়ে যে, ম্যারাডোনা ঠিক কী বলতে চেয়েছেন। তাঁদের অনেককেই অনু্রোধও করেছিলাম, দেখিয়ে দিতে। ওঁদের কাছে দেখে এসে ইংরেজ বিশেষজ্ঞদের কাছে গিয়ে সেই ‘মুভ’ করে দেখিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, ইংরেজিতে কোন কোন শব্দ ব্যবহারে সেই মুভ-টা ধরে রাখা সম্ভব। তারপর যা উত্তর পেয়েছিলাম, এর কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ পাওয়া যাবে না, নেই। কারণ, আমাদের এখানে কেউ এমন করতে পারেনি, পারে না’!

ম্যারাডোনার গল্প বলা অনাড়ম্বর, রসাশ্রয়ী এবং কবিতাধর্মী। ওঁর সেই বলার ধরনের প্রতি, বলা-কথার প্রতি, যতটা বিশ্বস্ত থাকা যায়, চেষ্টা করেছি।

ব্রাজিল বিশ্বকাপের গ্যালারিতেও আছেন তিনি

প্রশ্ন: ‘এল ডিয়েগো’ লেখা শেষ হয়েছিল যখন, কোচিং-এ ম্যারাডোনা সেভাবে আসেননি। পরে যখন কোচ হলেন, কেমন দেখেছিলেন ম্যারাডোনাকে? কী বলতেন?

মার্সেলা: দেখুন, ম্যারাডোনা কারও কথা কখনও শোনেননি, শুনতেন না। কোনো যুক্তি বা তর্কের ধার ধারতেন না কখনও। ওঁর যা মনে হতো, করতেন। এক সময় তো কার্লোস বিলার্দোকেও ডেকে আনা হয়েছিল, ছিয়াশির সেই বিশ্বজয়ী কোচকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল ওঁর সঙ্গে। কোনও প্রভাব পড়েনি। ম্যারাডোনা শুনলে তো!

জাতীয় দলের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ১৯ নভেম্বর, ২০০৮। নতুন একটা বিয়ে, ফল বেরনো উচিত আগামী বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ, আমরা ভাবছিলাম! কারণও ছিল। ওই সেপ্টেম্বরেই জানা যেত, ২০১০ বিশ্বকাপে আর্জেন্তিনা পৌঁছতে পারবে কিনা।

প্রশ্ন: আর্জেন্টিনার ফুটবল প্রশাসন তো জানত ডিয়েগোর মানসিকতা। তা হলে, কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কেন?

মার্সেলা: কখনও কারণ জানানো হয়নি। আর্জেন্টিনা ফুটবল সংস্থার প্রধান খুলিও গ্রোনদোনা কখনও জানান না, যেমন কাউকে তিনি সরিয়েও দেন না। তবে, অবস্থা এমন করে তোলা হয় যে সংশ্লিষ্ট কোচ সরে যেতে বাধ্য হন। তাঁর পেটোয়া বহু রেডিও ও টিভি সংস্থা আছে। তিনি বলেই থাকেন যে, সব পড়েন, সব শোনেন, সারা রাত ধরে! যাই হোক, তখন খুব একটা ভালো খেলছিল না জাতীয় দল। এমনকি আর্জেন্টিনার যুব দলগুলোও। ম্যারাডোনাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেই সময়। আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম শুরুতে আশাবাদীই ছিল। খুব যে সমালোচনা হয়েছিল, এমনও নয়। সবাই বেশ ভালোভাবেই নিয়েছিল। কিন্তু, ম্যারাডোনা কী করলেন? ওঁর দায়িত্বে প্রথম ম্যাচ স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে, গ্লাসগোয়। কান্নাকাটি করে ভাসালেন! কেন? তাঁর মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা, হাসপাতালে ভর্তি। যাঁর কারণে সেই সের্খিও ‘কুন’ আগুয়োরোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে শিবির থেকে, কোচের মেয়ের পাশে থাকবেন বলে। সাংবাদিক সম্মেলনে মারাদোনা বলে গেলেন কেন তাঁর ফুটবলারদের মানবিক হতে হবে, যত্নবান মানুষ হতে হবে, ইত্যাদি। ট্যাকটিকস, প্রথম ম্যাচের প্রথম এগার বা ষোলজন কারা, কিছুই বলেননি। সত্যিই, খেলা নিয়ে একটাও কথা ছিল না সেই সাংবাদিক সম্মেলনে!

প্রশ্ন: মনে আছে, আর্জেন্টিনার সেবার বিশ্বকাপে যাওয়া নিয়েই সংশয়। শেষ ম্যাচে উরুগুয়েতে গিয়ে উরুগুয়েকে হারাতে হবে, পরিস্থিতি জটিল। ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা অবশ্য জিতেছিল সেই ম্যাচ এবং তারপর সাংবাদিক সম্মেলনে ম্যারাডোনার আচরণ এবং বক্তব্য নিয়ে বিরাট হইচই হয়েছিল, ফিফা পর্যন্ত গড়িয়েছিল ব্যাপারটা...

মার্সেলা: একেবারেই তাই। ২০০৯-এর সেপ্টেম্বরের ঘটনা। প্রথমেই যা মনে পড়ছে, ম্যারাডোনার সেই প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে কুন আগুয়েরোকে ছেড়ে-দেওয়া, মেয়ের পাশে থাকার জন্য। নাতি বেঞ্জামিনের জন্ম, তার বয়স সেই সেপ্টেম্বরে প্রায় এক বছর। আর সেই সেপ্টেম্বরে আগুয়েরো দলের ধারেকাছে নেই, যেমন নেই ডিয়েগোর মেয়ের কাছাকাছিও। কোচের সঙ্গেও সম্পর্কে এতটাই দূরত্ব যে, দলেও নেই!

কিন্তু, তার চেয়েও বড় হয়ে উঠল ওঁর আচরণ। ম্যাচটা খুব খারাপ খেলেছিল আর্জেন্টিনা, যদিও জিতেছিল। জেতার পর ডিয়েগো এলেন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলতে। এবং চূড়ান্ত অশ্লীল আচরণ শুরুতেই। এমন অঙ্গভঙ্গি করলেন, কিছু কথা এমন বললেন যে, মহিলা হিসাবে সেই সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির আমরা পালানোর পথ খুঁজছি প্রায়!

পাগলামো তাঁর স্বভাবে। এবং যখন তিনি জিতেছেন, আর কিছুই মাথায় ছিল না। যা-যা বলেছিলেন এবং এমন সেই আচরণ, বলতেও খারাপ লাগবে। হ্যাঁ, সব বলার পর অবশ্য বলেছিলেন, ওখানে উপস্থিত মহিলারা যেন ওঁকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু একটা অসম্ভব রাগ থেকে ছিটকে বেরনো অভিব্যক্তি পেয়েছিলাম সেই দিন। তাঁর দুই মেয়ে দালমা এবং জিয়ান্নিনাকে উৎসর্গ করেছিলেন জয় আর দলের ফুটবলারদের। কিন্তু তারপরই বোমা, ‘এই ঘরে যারা আছে অনেকেই চায়নি, আমার আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে যাক।’ তাদের জন্য বরাদ্দ আবারও ছাপার অযোগ্য কিছু শব্দ এবং দেখার অযোগ্য অঙ্গভঙ্গি। এমন কিছু যা একান্ত পুরুষরাই করে থাকতে পারেন, এতটাই অশ্লীল-অপমান, অমর্যাদাকর তো বটেই।

সবাই-ই বলত, শুনতামও যে, কোচের এমন পাগলামো অর্থহীন। কিন্তু, বারবারই মনে হতো, কোচ যদি পাগলামো করেই থাকেন, আমাদেরও কি পাল্টা পাগলামো করতেই হবে?

আসলে, সেই ছিয়াশি থেকেই বিলার্দো-ম্যারাডোনা জমানায় যেমন শুরু হয়েছিল, দেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম ‘আমাদের দেখতে পারে না, আমাদের ভালো চায় না’ মনোভাব নিয়ে বিরোধিতা, যেন ফিরে এসেছিল সেই ২০০৮-০৯ সময়ে। ওই আপাত-বিরোধিতার আড়ালে নিজেদের সান্ত্বনা খুঁজছিলেন কোচ ম্যারাডোনা তখন। গত ১৮ বছর ধরেই তাঁর ক্ষোভ, পরিষ্কার বলেওছিলেন ম্যারাডোনা সে দিন। সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে, তাই সুযোগ পেয়ে তিনিও পাল্টা দিলেন, তাঁর মতো করে ইত্যাদি। ‘যে-মায়েরা এই সব বেজন্মার জন্ম দিয়েছে তাঁদেরও উৎসর্গ করলাম এই জয়’, এমন কথা সরাসরি শোনার তিক্ততা এখনও থেকে গিয়েছে স্মৃতিতে, অস্বীকার করব না।

প্রশ্ন: যখন সেই ম্যারাডোনার মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলেন ...

মার্সেলা: নৃতত্ত্ববিদ বা সমাজবিজ্ঞানীরা কারণটা বলতে পারবেন, আর্জেন্টিনার ফুটবল-সংস্কৃতি আমাদের কেন এবং কীভাবে একত্রিত রাখে, দেশের বহুবিধ সমস্যার মধ্যেও। তাই ফুটবল আর বিশ্বের সেরা ফুটবলারের এই জুটির মধ্যে আর্জেন্টিনার মানুষ খুঁজে পেয়েছিল তাদের জাতীয় প্রতীক। ডিয়েগো হয়ে উঠেছিলেন আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় সম্পদ। জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ-এর মতো।

ওঁর কফিন রাখা ছিল ঠিক সেখানে, যেখানে এবিতা এবং পেরোন-এর (আর্জেন্টিনার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং ফার্স্ট লেডি) শরীর রাখা হয়েছিল কফিনবন্দি। ওঁরাও বিতর্কিত মানুষ ছিলেন, কিন্তু, ওঁদের মতোই সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়েছিল ডিয়েগোকেও। কারণ, আর্জেন্টিনার মানুষ জানতেন, ডিয়েগোর চেয়ে বেশি আর্জেন্টেনীয় আর কেউ নন।

ওঁর এই ভঙ্গুর মানসিকতা, নানা ব্যাপারে দুর্বলতা, আবার একই সঙ্গে এত সফল, এত প্রতিভাবান এবং এতটাই দুরন্ত থাকার মধ্যে যে বৈপরীত্য, এটাও হয়ত আর্জেন্টিনীয় মানসিকতার প্রতিফলন।

তাই ওঁর সঙ্গে আমরা নিজেদের মিলিয়ে নিতে কখনও দুবার ভাবিনি। ওঁর এই আবেগপ্রবণ মন, বিতর্ক ডেকে-আনা চরিত্র আর চূড়ান্ত সাফল্য–যেন পেন্ডুলাম হয়ে দুলত সারাক্ষণ। যা-যা করেছেন, সবার থেকে ভালো, সবার থেকে বড় আর যখন নেমেছেন, অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে, অন্ধকারের পথে, সেখানেও বোধহয় সবচেয়ে খারাপ তখন!

আমার চিরকালই মনে হয়েছে, এই বৈপরীত্যই আসলে ওঁর বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়তার কারণ। মানুষ ওঁর মধ্যে খুঁজে পেয়েছে অবিশ্বাস্য মনুষ্যত্ব এবং অতি অবশ্যই এক সুপারম্যানকে।

বিশ্বকাপের গ্যালারিতে

প্রশ্ন: ‘আমার আর মারাডোনার পাসপোর্টের রঙ একই’, বিশ্বকাপের আসরে গিয়ে সাধারণ আর্জেন্টেনীয় ফুটবল ভক্তের এই গর্বের জায়গাটা দেখে-শুনে এসেছিলাম। আর্জেন্টিনাতেও নিশ্চয়ই একই রকম?

মার্সেলা: দেখুন, কেন এটা হয়, দেশের গর্বের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখতে চায় সাধারণ মানুষ, ম্যারাডোনার পাসপোর্ট আর নিজের পাসপোর্ট একই রঙের বলে কেন আলাদা করে আনন্দে মেতে উঠতে চায় আর্জেন্টিনা – বলা খুব মুশকিল। হয়ত দেশের একটা নিজস্বতা থাকে, ন্যাশনাল আইডেন্টিটি। খেলা এবং সংস্কৃতি মিলিয়ে। হয়ত, ডিয়েগো সেই ‘আর্জেন্টিনীয়’ হয়ে ওঠার ব্যাপারটার সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গী জড়িত।

নিজের ভেতরের খারাপগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন সবার সঙ্গে, সবার সামনে। নেশায় ডুবে থাকার কথা জানিয়েছেন নিজের মুখেই। আনন্দ পেতে গিয়ে কী কী করতেন, কী ধরনের বস্তুর সাহায্য নিতেন, কোন কোন ওষুধ খেতেন–তা জানাতেও অকপট।

প্রতিভাবান, নিঃসন্দেহ। সব অর্থেই জিনিয়াস। বলপায়ে যা যা করেছেন, শিল্পীরা হাতে তুলি নিয়ে ঠিক তাই-ই করতেন। প্রায় অতিমানবিক ক্ষমতা। আর্জেন্টিনীয় লেখক খুয়ান সাস্তুরাইন লিখেছিলেন, ‘ডিয়েগো যে আসলে শিল্পী। যেখানে কিছুই নেই সেখানেও কিছু একটা উদ্ভাবন করে দেখায়।’

প্রশ্ন: মানুষ ডিয়েগো সম্পর্কে...

মার্সেলা: বস্তির বিদ্রোহী ছেলেটা যে কখনও ‘টাই’ পরে ঘুরতে পছন্দ করেনি। সহস্রাব্দের রূপকথার সেই আদি নায়ক যে নিজের কথা বলতে কখনও ভয় পায়নি। মনের কথাও রাখেনি লুকিয়ে। পাগল ছোট দৈত্য যে মৃত্যুকেও কাটিয়ে বেরিয়ে যায় অনায়াসে! স্লেজগাড়িতে চেপে নরকে ঘুরপাক খেয়ে আসে রোজ। আর আপোস যার কাছে তুমুল যন্ত্রণার অন্য নাম।

ওঁর এই জনপ্রিয়তাকে বিশ্লেষণের চেষ্টাটাও কঠিন। এত বৈপরীত্য আর কার? জনসাধারণের মনে একই সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতেন। আমার তো মনে হয় বিশেষ করে আর্জেন্টিনায় ওঁর এই জনপ্রিয়তার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশ্লেষণ করে বিরাট আকারের বই লেখা সম্ভব। ঈশ্বরসদৃশ আবার রাজনৈতিক মতবাদ নিজের দিকে টেনে আনার কাণ্ডারি, একাধারে সেন্ট আর ড্রাগে নেশাতুর, কখনও শিকারী, কখনও নিজেই শিকার! কোনও একটা জায়গায় তাঁকে ধরে রাখা, আটকে রাখা, বেঁধে রাখা, ফুটবলার মারাডোনার মতোই মানুষ মারাডোনাকেও–স্রেফ অসম্ভব।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×