অলিম্পিকে পদক জয়ের স্বপ্ন বাস্তব নাকি অবাস্তব?

দুলাল মাহমুদ

৩ আগস্ট ২০২১

অলিম্পিকে পদক জয়ের স্বপ্ন বাস্তব নাকি অবাস্তব?

অলিম্পিকে একটা পদক জয়ের জন্য ক্রীড়াবিদদের বছরের পর বছর নিরলস সাধনা করতে হয়। থাকতে হয় প্রবল ইচ্ছেশক্তি, নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন ও কঠোর পরিশ্রম করার অদম্য মানসিকতা। তবে এরই সঙ্গে প্রয়োজন হয় আর্থিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক সমর্থন ও সহযোগিতা। বাংলাদেশ কি এসব নিশ্চিত করতে পেরেছে? উত্তরটা সবারই জানা।

চার বছর পর পর অলিম্পিক গেমস আসে অলিম্পিক গেমস যায়। কিন্তু আমাদের পদক জয়ের আশা পূরণ হয় না। এন্ড্রু কিশোরের গানের ভাষায়, 'আশায় আশায় দিন যে গেল, আশা পূরণ হলো না'। কেন আশা পূরণ হয় না? অলিম্পিক গেমসে বাংলাদেশ পদক জিততে পারে, গত প্রায় চার দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে এমনটা যেন রীতিমতো অবিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ পদক জিততে পারবে না, কেন এটা ধরে নেওয়া হচ্ছে?

অলিম্পিক গেমস দূরে থাক, যেকোনো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পদক পাওয়া ছেলের হাতে মোয়া নয়। একটা পদক শুধু কেবল গোলাকৃতি বস্তুবিশেষ নয়, তা গৌরবের প্রতীক, সম্মানের স্বীকৃতি সর্বোপরি একটা দেশের মর্যাদার নিদর্শন। এর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে বলেই একটি পদকের জন্য দেশের সঙ্গে দেশের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আসছে। তা জয়ের জন্য ক্রীড়াবিদদের বছরের পর বছর নিরলস সাধনা করতে হয়। থাকতে হয় প্রবল ইচ্ছেশক্তি, নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন ও কঠোর পরিশ্রম করার অদম্য মানসিকতা। কথায় আছে, কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না।

তবে ব্যক্তিগত নিষ্ঠা ও নিবেদনের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় আর্থিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক সমর্থন ও সহযোগিতা। সবার আগে অর্থ একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। যে দেশ খেলাধুলার পেছনে চাহিদা অনুসারে যথাযথভাবে যত বেশি অর্থ ব্যয় করে, সেই দেশ সাধারণত আনুপাতিক হারে সাফল্য পেয়ে থাকে। একই সঙ্গে আধুনিক অবকাঠামো, নিবিড় প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা, সাংগঠনিক দক্ষতার সমন্বয় অপরিহার্য। এর ব্যত্যয় হলে সাফল্যের আশা অনেকটা মরীচিকার মতো হয়ে যায়। অবশ্য জাতিগত বৈশিষ্ট্য, ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ, শারীরিক গড়ন, খাদ্যাভ্যাস, মানসিক দৃঢ়তা, সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা যায় না। এই ধরনের বিশেষত্বের কারণে বিশেষ বিশেষ খেলায় রয়েছে কোনো কোনো দেশের নিরঙ্কুশ আধিপত্য।

বাংলাদেশের আরিফুল ইসলাম আর জুনায়না আহমেদ অংশ নিয়েছিলেন টোকিও অলিম্পিকের সাঁতারে। ছবি: গেটি ইমেজেস

জীবনের অন্য কোনো ক্ষেত্রেই যেখানে আমরা শীর্ষস্থানে যেতে পারি না, সেখানে চাইলেই কি খেলার মাঠে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা সম্ভব? না, তা মোটেও সহজ নয়। এটা কোনো ম্যাজিক নয় যে, কৌশল প্রয়োগ করে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া যাবে। তারপরও কিছু কথা থেকে যায়। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও অনেক দেশ, অনেক প্রতিযোগী সাফল্য অর্জন করে। সেটাকে স্বাভাবিক কোনো মানদণ্ড হিসেবে ধরা যায় না। তার কোনো ধারাবাহিকতা নেই। হঠাৎ পাওয়া এই সাফল্যকে বিস্ময় বা চমক হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আর এই বিস্ময় বা চমকের জন্য আমরা সাগ্রহে অপেক্ষায় থাকি।

বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়া উৎসব অলিম্পিক গেমস সব ক্রীড়াবিদদের কাছেই স্বপ্নের ঠিকানা। এই গেমসে অংশ নেওয়ার জন্য ক্রীড়াবিদরা মুখিয়ে থাকেন। আর অলিম্পিক গেমসে পদক পাওয়া তো একজন ক্রীড়াবিদের জীবনের পরম সার্থকতা। চলতি অলিম্পিক গেমসের আগে পর্যন্ত পদক জয় করেছে ১৪৯টি দেশ বা দল। এর মধ্যে এ যাবৎ যুক্তরাষ্ট্র যেমন এককভাবে সর্বাধিক ২৫২৩টি পদক জিতেছে, তেমনিভাবে একটি করে পদক পেয়েছে ২৪টি দেশ বা দল। ৭১টি দেশ বা দল কোনো পদক জিততে পারেনি। তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। বাংলাদেশের রয়েছে মন খারাপ করা একটি রেকর্ড। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে যারা অলিম্পিক গেমসে পদক জিততে পারেনি, তাদের শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। যদিও জনসংখ্যা দিয়ে অলিম্পিক গেমসের পদক পরিমাপ করা যাবে না। তারপরও একটা আক্ষেপ তো থাকেই, বাংলাদেশ কেন পদক পায় না?

নাইরোবিতে জুনিয়র বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিতে ওঠা জহির রায়হান হতাশই করেছেন টোকিওতে। ছবি: গেটি ইমেজেস

এর কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না। বাস্তবতা হচ্ছে, অলিম্পিক গেমসে পদক পাওয়া সম্ভব, এই আত্মবিশ্বাস বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের কখনোই ছিল না। কীভাবে সঞ্চারিত হবে আত্মবিশ্বাস? আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান মোটেও সন্তোষজনক নয়। কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়ান গেমসের মতো আসরেই পদক জয় করতে অন্তহীন অপেক্ষায় থাকতে হয়। বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের কাছে 'অলিম্পিক গেমস' হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে মূলত দক্ষিণ এশীয় গেমস। সাত জাতির এই গেমসেও বাংলাদেশের অবস্থান সুসংহত নয়। সেক্ষেত্রে অলিম্পিক গেমসে পদক জয়ের স্বপ্ন দেখাটা অনেকটা বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর মতো নয় কি?

আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের যে পদকগুলো জয় করেছে, তা যে সুপরিকল্পিতভাবে অর্জিত হয়েছে, সেটাও বলা যায় না। সেই মনোভাব, সেই মানসিকতা, সেই সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্রীড়াবিদরা ব্যক্তিগত নৈপুণ্য ও প্রতিভা দিয়ে সাফল্য পেয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পদক এসেছে অপ্রত্যাশিতভাবে। যে পরিবেশ, যে পরিস্থিতি থেকে ক্রীড়াবিদরা উঠে আসেন এবং যে সুযোগ-সুবিধা তাঁরা পেয়ে থাকেন, তাতে বড় কিছু আশা করা যায় না। তেমন অনুকূল পরিবেশ যদি থাকতো, তাহলে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের পদক জয় করাটা অভ্যাসে পরিণত হতো। তা এখনও হয়নি। আর যা হোক, ক্রীড়াঙ্গনে চটজলদি সাফল্য পাওয়া যায় না। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পদক জয় করা সহজসাধ্য নয়।

টোকিওতে না পারলেও অলিম্পিক ঘিরে নতুন করে আশা জাগাচ্ছেন রোমান-দিয়া। ছবি: গেটি ইমেজেস

তবে আশার কথা, বাংলাদেশের পদক জয় করার স্বপ্ন এবারই প্রথম অঙ্কুরিত হয় চলমান টোকিও অলিম্পিক গেমসকে কেন্দ্র করে। আর এই স্বপ্ন দেখিয়েছেন আর্চার রোমান সানা, দিয়া সিদ্দিকীরা। তাঁরা সবার মধ্যে এই স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। এটাকে হালকা করে দেখার অবকাশ নেই। এই স্বপ্নের বীজ থেকে একদিন ফল পাওয়া যাবে। তবে মেধাবী, প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় ক্রীড়াবিদদের নিয়ে দীর্ঘ পরিসরে সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যেতে পারলে একদিন আমাদের অপেক্ষার অবসানও ঘটতে পারে। সেই আন্তরিকতা, সেই নিষ্ঠা, সেই ভালোবাসা নিয়ে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেন। ইতোমধ্যে কারও কারও মধ্যে সেই মনোভাব, সেই উচ্চাশা, সেই সংকল্প দৃশ্যমান। তাতে করে এখন যা অবাস্তব মনে হচ্ছে, তা একদিন সত্যি সত্যিই বাস্তবে রূপ নেবে। অলিম্পিক গেমসের পদক তালিকায় স্থান করে নেবে বাংলাদেশ নামটি।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×