আমৃত্যু উপভোগ করতে চাই এই গৌরবটা

শহিদুল আজম

১৩ এপ্রিল ২০২১

আমৃত্যু উপভোগ করতে চাই এই গৌরবটা

শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্যই নয়, ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি কাভার করতে যাওয়া সাংবাদিকদের জন্যও তা হয়ে আছে অবিস্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতারই প্রাঞ্জল বর্ণনা এই লেখায়। যা পড়ার সময় চোখে ভেসে ওঠে কুয়ালালামপুরের সেই স্বপ্নময় দিনগুলো।

একটি ক্রিকেট প্রতিযোগিতার কাপ জয়ের লড়াইটি কী করে হয়ে যায় দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন? জাতীয় পতাকা উর্ধ্বমুখী করার প্রত্যয়? আর ক্রিকেটের এই প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে কীভাবে একটি জাতি সব ভেদাভেদ ভুলে চলে আসে একই ছাতার নিচে?

নিঃসন্দেহেই এমন ঘটনা বিশ্বে বিরল। খেলাধুলার ইতিহাসে তো অবশ্যই। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি জয়ের লড়াই ঘিরে এমনই গৌরবের এক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। বিশ্ব ক্রিকেটের বোদ্ধারাই শুধু নন, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েছিল পুরো বিশ্বই। একটা খেলাকে কেন্দ্র করে এমন উন্মাদনা হতে পারে! বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ক্রীড়াবিদদের ত্যাগও নজিরবিহীন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে বুক চিতিয়ে দেশের জন্যে লড়াই শুধু নয়, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গড়ে ভারতের মাটিতে প্রথম জাতীয় পতাকা উড়িয়েছেন আমাদেরই সাহসী ফুটবলাররাই। কাজেই খেলা আমাদের জন্যে নিছকই খেলা নয়। এর সঙ্গে নানা আবেগ জড়িয়ে যায়। পতাকার ভালোবাসা ফিরে আসে। সেই ভালোবাসার বিস্ফোরণটা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সেই সময়ের এমন কেউ নেই যে বা যিনি কুয়ালালামপুরের কিলাত কেলাবের বীরত্বের কথা জানেন না।

টেলিভিশনে আইসিসি ট্রফির সেই ফাইনাল সরাসরি সম্প্রচার হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ বেতারে ধারাভাষ্যে জীবন্ত ক্রিকেট যেন চোখে দেখেছেন মানুষ। শেষ পর্যন্ত এক বলে এক রানের অবিশ্বাস্য এক লড়াইয়ে জয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো আইসিসি ট্রফিতে চুমো খেয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। সেটিই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভিত্তি। যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আজকের ক্রিকেট এবং এখন ষোলো কোটি মানুষের স্বপ্ন। জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে, স্বপ্নের পরিধিও বাড়ছে। তাই এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশ কেন বিশ্বকাপ জয় করে না? বলে-কয়ে কেন প্রতিটি দলকে প্রতিদিন হারাতে পারে না? কেন প্রতিটি ম্যাচে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা সেঞ্চুরি হাঁকায় না। বোলাররা প্রতি ম্যাচেই কেন পান না পাঁচ উইকেট! কত আফসোস, কত হতাশা। কত সহজেই না দেখে ফেলছি স্বপ্ন, অভিমান হয়ে যাচ্ছে কত দ্রুত।

কিন্তু দুই যুগ আগেও সেটি ছিলো দুর্লভ, খুবই কঠিন স্বপ্ন। আশার বেলুন উড়িয়ে কত রাত-দিন পার করেছি। কতবার আশা ভেঙেছে, কিন্তু স্বপ্ন হারিয়ে যায়নি। আত্মবিশ্বাস লুপ্ত হয়নি। আর তাই হয়তো ১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল কিলাত কেলাব মাঠে গর্জে উঠেছিল বাংলাদেশ অসীম সাহসিকতায়। গৌরবের সোনালী ইতিহাস এভাবেই রচিত হয়। ওই প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। এর ধারাবাহিকতায় টেস্ট মর্যাদা অর্জন এবং ক্রিকেট হয়ে গেল দেশের এক নম্বর খেলা।

আইসিসি ট্রফিতে অধিনায়ক আকরাম খানের অনানুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে লেখক (ডানে)

ইন্টারনেটের দুনিয়ায় এখন সার্চ দিলেই বাংলাদেশের সাফল্যের ফিরিস্তি চলে আসে চোখের সামনে। ভিনদেশি টেলিভিশন চ্যানেল ঘোরালেও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের দেখা মেলে অহরহ। আর্ন্তজাতিক রেকর্ডবুকে বাংলাদেশের দু-একজন ক্রিকেটার হরহামেশাই ঠাঁই করে নিচ্ছেন। উন্নতির ধারাই তো এটি। কিন্তু ভাবা যায় কেমন অবস্থা ছিল দুই যুগ আগে? ১৯৯৭-য়ের ফুটবলের দেশ আর্জেন্টিনা, অখ্যাত পশ্চিম আফ্রিকার মতো দেশের সঙ্গে লড়তেও বাংলাদেশকে কম ঘাম ঝরাতে হয়নি। কিন্তু যে-ই না ফাইনালে কেনিয়াকে ছিটকে ফেলে দিল, এর পরের যাত্রা কেবলই সাহসের। কেনিয়া, হল্যান্ড, আমিরাতের মতো দলগুলোরই হাঁটু কাঁপে বাংলাদেশের সামনে দাঁড়াতে। আইসিসি ট্রফি জয়ের সাহস কতটা উঁচুতে ছিল, এটি বোঝা যায় শতাব্দীর শেষ বিশ্বকাপে। যেখানে টাইগাররা পাকিস্তানের মতো দলকে হারিয়ে দিয়েছিল। সেটিই ছিল ওই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় আপসেট। কিলাত কেলাব মাঠের সেই জয়ের অনুপ্রেরণা এমনই ছিল। বৃষ্টিবিঘ্নিত দুই দিনের সেই ফাইনালে শেষ পর্যন্ত কীভাবে দুই উইকেটে জিতল বাংলাদেশ, কীভাবেই শান্ত শেষ বলে জয়ের রানটি নিলেন, এটি এখন কারও অজানা নয়। অনেকবারই হয়তো বলা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হবে ভবিষ্যতেও।

তবে মাঠ থেকে দেখা সাহসের সেই লড়াই হৃদয়ে খোদাই হয়ে আছে। এতদিন পরও সেই ম্যাচ নিয়ে আমার বুকে যে ঝংকার, যে শিহরণ, এর কোনো তুলনা হয় না। মাঠে যে এগারোজন খেলেন, তাদের পারফরম্যান্সের যোগফলই জয়-পরাজয়ের ভাগ্য নির্ধারণ করে। কিন্তু ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের হয়ে শুধু  এগারোজন ক্রিকেটারই খেলেননি। খেলেছিলেন মালয়েশিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। খেলেছেন সে সময়ে দেশের ১২ কোটি মানুষ। তাই ক্রিকেটারদের নৈপূণ্যে একসঙ্গে হেসেছেন। সমর্থন জুগিয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ যারা দেখেননি, জাতীয় পতাকা নিয়ে যারা বিজয় মিছিল করতে পারেননি, সেই প্রজন্ম সবুজ লাল পতাকাটাকে ভালোবাসতে শিখেছেন আইসিসি ট্রফি বিজয় দিয়ে। আরও পরিষ্কার করে বললে কুয়ালালামপুর আইসিসি ট্রফি লড়াই দেখেই। শুধু একটি ফাইনাল আর কাপ জয়েই সেই সোনালী অধ্যায় শেষ হয়ে যায় না। বরং প্রথম ম্যাচ থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন কত ছোটোখাটঘটনা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। যেমন দ্বিতীয় রাউন্ডে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ। বৃষ্টি হানা দিয়ে বাংলাদেশের স্বপ্নকে তছনছ করে দিয়েছিলো প্রায়।

গায়ের শার্ট খুলে মাঠের কাদা পানি সেঁচার ইতিহাস আর কি কোনো দেশের আছে? নিজের দেশের ক্রিকেট দলকে সমর্থন দিতে গিয়ে বিদেশ বিঁভূইয়ে চাকরি হারানোর ত্যাগের উদাহরণ আর কার আছে? দেশটার জন্যে,পতাকার ভালোবাসায় কখনও কখনও অসম্ভব সাহসী হয়ে ওঠে এদেশের মানুষ।

এই বৃষ্টি অনেক ক্রিকেট ম্যাচের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সেই টুর্নামেন্টের বাংলাদেশ দল কি আর সহজে হাল ছাড়ে! গায়ের শার্ট খুলে মাঠের কাদা পানি সেঁচার ইতিহাস আর কি কোনো দেশের আছে? নিজের দেশের ক্রিকেট দলকে সমর্থন দিতে গিয়ে বিদেশ বিঁভূইয়ে চাকরি হারানোর ত্যাগের উদাহরণ আর কার আছে? দেশটার জন্যে,পতাকার ভালোবাসায় কখনও কখনও অসম্ভব সাহসী হয়ে ওঠে এদেশের মানুষ। একাত্তরের সাহস ১৯৯৭-এর প্রেরণা। কিলাত ক্লাবে জাতীয় পতাকা তুলে ধরার দুই যুগ পূর্ণ হলো। সেদিনের কিশোর আজ হয়তো বার্ধক্যের পথে হাঁটছে। সেদিনের ক্রিকেট যোদ্ধারা আজ অবসরে। সেই প্রতিযোগিতা কাভার করা সংবাদকর্মীদের অনেকেও নেই খেলার মাঠে। কিন্তু সাফল্যের স্মৃতিতে কি আর মরিচা পড়ে! সামনে এগোতে হলে মাইলফলকগুলোতে নিয়মিত ধোয়া-মোছা করতে হয়।

একদা সাহসের সাফল্যের ইতিহাস সব সময়ই অনুপ্রেরণা। তবুও আমাদের কর্তারা কেন জানি, অজানা এক হীনম্মন্যতায় ভোগেন। তারা ভাবেন, অতীতকে স্মরণ করলেই বোধ হয় নিজেদের কৃতিত্ব হারিয়ে যাবে। এই সংকীর্ণতায় হয়তো '৯৭-এর আনন্দের স্মৃতিতে ফিরতে পারেন না। তবে, রেকর্ডবুক মুছে যায় না। ভালোবাসা আর সাহসের গল্পগুলো সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে রাখে। দুই যুগ পরও অভিনন্দন আইসিসি ট্রফিজয়ী সেই টিম বাংলাদেশকে। আহা! কী লড়াইয়ে কী দারুণ অর্জন। মাঠে না খেলেও মনে হয় লড়াইটা আমরাই বোধ হয় করেছি। এমন একটি প্রতিযোগিতা কাভার করার গৌরবটা উপভোগ করতে চাই আমৃত্যু।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×