শিহান করুনাতিলাকার `চায়নাম্যান`

ক্রিকেটের লেন্সে দুনিয়া বোঝার অদ্বিতীয় পাঠ অভিজ্ঞতা

সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ

১৬ আগস্ট ২০২১

ক্রিকেটের লেন্সে দুনিয়া বোঝার অদ্বিতীয় পাঠ অভিজ্ঞতা

শিহান করুনাতিলাকার `চায়নাম্যান` বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল। কল্পিত এক রহস্য স্পিনারকে উপজীব্য করে লেখা এই উপন্যাসে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কার, ইতিহাস...কী প্রতিবিম্বিত হয়নি! যা পড়ে মুগ্ধ ক্রীড়া সাংবাদিক সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ উৎপলশুভ্রডটকমের পাঠকদের সঙ্গে সেই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন।

টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেটধারী মুত্তিয়া মুরালিধরন যে শ্রীলঙ্কার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্পিনার ছিলেন, এই কথা অস্বীকার করার লোক দুনিয়াতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অনেকে হয়তো বলবেন, তিনি দুনিয়ার মধ্যেই সেরা। সেই দাবির পক্ষে পরিসংখ্যানও কথা বলবে। 

কিন্তু যদি কেউ দাবি করে যে, শ্রীলঙ্কায় মুরালির চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী একজন স্পিনার ছিলেন, যিনি কেবল প্রচলিত কৌশল খাটিয়ে বল করতেন তাই না, অবিশ্বাস্য সব নতুন নতুন ধরনের বল আর কৌশলের আবিষ্কারক ছিলেন। তবে কী পরিমাণ অবাক লাগবে?

আরও যদি জানা যায় যে, তিনি টেস্টেও খেলেছেন, বিশ্বের বড় বড় ব্যাটসম্যানকে নাকানিচুবানি খাইয়েছেন, তাহলে? অস্ট্রেলিয়ানদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে স্লেজিং করতেন সেই আশির দশকে, মুরালিকে উৎসাহ দিয়েছেন বিতর্কে ভেঙে না পড়ে চালিয়ে যেতে, জয়া-কালুর উদ্বোধনী জুটির ধারণা তাঁর মাথা থেকেই এসেছিল, এমনকি কেউ কেউ এ-ও বলেন অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় তরুণ শেন ওয়ার্ন তার ফ্লিপার দেখেই এই অস্ত্রটিকে তাঁর তূণেও যোগ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রাজনীতি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, জাতিঘৃণা, বর্ণবাদ, যুদ্ধ, লোভ, লালসা আর প্রতিশোধের কারনে কেবল তাঁর ক্যারিয়ারই থেমে যায়নি, বরং তাঁর নামনিশানা পর্যন্ত মুছে ফেলা হয়! 

অবিশ্বাস্য মনে হয় না? অবশ্য যদি বলা হয়, এই গল্পটা লিখেছেন পাড় মাতাল, বদমেজাজী একজন মানুষ; তবে এই অবিশ্বাস্য গল্প উড়িয়েই দেয়া যায়। কিন্তু যদি বলা হয়, তিনি শ্রীলঙ্কার অন্যতম সেরা ক্রিকেট সাংবাদিক, যার জীবনে ক্রিকেটের চেয়ে জরুরি কিছু ছিল না, যিনি কর্তৃপক্ষকে থোড়াই কেয়ার করেন আর যার ক্রিকেট ও অন্যন্য খেলা বিষয়ক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভান্ডার কয়েক দশকের...তবে গল্পটা পাঠককে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক অদ্ভুত ঘোরের জগতে নিয়ে যায়। 

এই অসাধারণ ঘোরের জগতেই পাঠককে নিয়ে যান শিহান করুনাতিলাকা তাঁর মাস্টারপিস বই দিয়ে, যার নাম: চায়নাম্যান, দ্য লেজেন্ড অব প্রদীপ ম্যাথিউ। ক্রিকেটের লেন্স দিয়ে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি, সমাজ, বছরের পর বছর গৃহযুদ্ধ, ক্রিকেটের প্রতি একদিকে অসীম আবেগ অন্যদিকে সীমাহীন দুর্নীতি। একদিকে ক্রিকেটকে ঘিরে লোভ আর লালসার ছায়া, অন্যদিকে বিরাট স্বপ্নজাল। 

সানডে টাইমস পত্রিকায় রিচার্ড সিমন এই বই সম্পর্কে বলেছেন, করুনাতিলাকা শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের সমস্ত সত্য তুলে ধরেছেন- বর্ণবাদ, জাতের বড়াই, অসীম দুর্নীতি, আত্মঘাতী বোমা হামলা, নেশাদ্রব্য, যৌন ব্যবসা, ঔপনিবেশিক আমলের ছায়া আর উপনিবেশ পরবর্তী জাতি গঠনের ব্যর্থতা। সিমনের কথার সুরেই বলেন শ্রীলঙ্কার অন্যতম সফল ও শিক্ষিত ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত কুমার সাঙ্গাকারা। তিনি বইটি পড়ে চমকে ওঠেন, শিহরিত হন এতে বর্ণিত ঘটনাগুলোর সত্যতায়। 

এই বইয়ের ক্যানভাসটা এতই বড় যে, প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক ও রাজনীতিবিদ শশী থারুর একে আখ্যা দেন-‘দ্য গ্রেট শ্রীলংকান নভেল’ বলে। সালমান রুশদী এর প্রেমে পড়ার কথা স্বীকার করেন, যেটির কারণ লুকিয়ে অনবদ্য ভাষারীতি আর উপস্থাপনার সুষমায়, যা একইসঙ্গে লালিত্য আর কাঠিন্যের ছন্দে বাঁধা। মাইকেল ওনডাটজির মতো লেখক যে ধাঁধায় পড়ে বিহ্বল হয়ে যান। 

ক্রিকেট খেলায় যেমন বলে বলে উত্তেজনা হয়, লেখক সেই ধারাটাই যেন বজায় রেখেছেন পাতায় পাতায়। ক্রিকেট, ফুটবল, অ্যাথলেটিকস, রেসিং এমনকি রাগবি নিয়ে দারুণ দারুণ সব ইতিহাস আর চরিত্র মেলে ধরেছেন কাভার ড্রাইভের বাঙ্মময়তায়, শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘদিন ধরে চলা সিংহলি আর তামিলদের যুদ্ধ আর এর পেছনের মূল কারণ জাতঘৃণা আর দখল ও ক্ষমতার রাজনীতিকে প্রচন্ড ক্ষোভে ইয়র্কার দিয়েছেন, ক্রিকেট বেটিং আর অর্থ ও নারী কেলেঙ্কারিগুলোকে হাজির করেছেন ফ্লাইটেড ডেলিভারির মতো মায়াবী জালে। আর এসব পড়ে পাঠকেরা কখনো মুগ্ধতায় আহা, ক্ষোভে উফ্ কিংবা কৌতুকে হা হা করে হাসতে বাধ্য হবেন সশব্দে বা নিঃশব্দে, ক্রিকেট দর্শকদের মতোই।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে অনেক পাঠক হয়তো লেখকের দেয়া অগণিত দারুণ তথ্যগুলো জেনে বইটা বন্ধ করে সেগুলো শেয়ার করবেন। হিউমারের অংশগুলো প্রিয়জনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করবেন। আবার কেউ কেউ মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে যাবেন, যদিও গড়পড়তা উপন্যাসের চেয়ে বড় এই বইটা শেষ করতে সবচেয়ে নিবিড় পাঠকেরও বেশ সময় লাগবে। 

আর সেজন্যই হয়তো লেখক দারুণ মুন্সিয়ানায় নানা ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন ক্রিকেটের নানা পরিভাষা দিয়ে, নানা ঘটনা দিয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দারুণ কিছু ছবি, সঙ্গে ক্রিকেটের নানা কৌশলের ব্যাখ্যা।

মার্ক টোয়েন যেমন বলেছিলেন, সবচেয়ে সত্য কথাগুলো কৌতুকের আবরণে না বললে ক্ষমতাসীনদের রোষ এড়ানো কঠিন, সেই কৌশল অবলম্বন করে লেখক নানা বিতর্কিত বিষয়ের বিবরণ দিয়েছেন মাতলামি আর ‘গল্পগাথা’ বলে চালিয়ে দিয়ে।

অবশ্য, এই করতে গিয়ে তিনি সহজবোধ্য হন নাই, বরং বিবরণটা নন-লিনিয়ার। ঘটনার আগুপিছু ধরতে গিয়ে পাঠক প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলতে পারেন। আর, পুরো কাহিনীটাই যেহেতু বাস্তব আর কল্পনার দোলাচলে রেখেছেন, এই কারণে দেখা গেছে ক্রিকেটার বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নামগুলো কখনো তিনি পালটে দিয়েছেন। যদিও সচেতন পাঠক ঘটনা পরিক্রমায় আসল চরিত্রগুলো ধরে ফেলতে পারবেন। শ্রীলঙ্কার একই সঙ্গে বিশ্বজয়ী হওয়া আবার অতি সাধারণ টেস্ট দল হয়ে থাকার বিবরণ দিয়েছেন একই কায়দায়, উত্তেজনা, আবেগ ও কঠোর সমালোচনায়। 

মার্ক টোয়েন যেমন বলেছিলেন, সবচেয়ে সত্য কথাগুলো কৌতুকের আবরণে না বললে ক্ষমতাসীনদের রোষ এড়ানো কঠিন, সেই কৌশল অবলম্বন করে লেখক প্রদীপ ম্যাথিউ, শ্রীলঙ্কা আর বিশ্ব ক্রিকেটের নানা বিতর্কিত বিষয়ের বিবরণ দিয়েছেন মাতলামি আর ‘গল্পগাথা’ বলে চালিয়ে দিয়ে। সচেতন দর্শকের মনে হবে এগুলো এতই সত্য যে, তা সরাসরি বলা যেত না। 

অনেকটা সংবাদপত্র আর উপন্যাসের মতো। সংবাদপত্রের চরিত্রগুলো সত্য হলেও কাহিনীগুলো বাস্তব জীবনের উপরিতল মাত্র, অন্যদিকে উপন্যাসের চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও এরা বাস্তব জীবনের সবচেয়ে গভীর চিত্রগুলো তুলে আনে। এই উপন্যাস তৃতীয় বিশ্বের, বহুকাল ঔপনিবেশিক শাসনে থাকা এক দেশের ঢেকে রাখা চিত্রগুলো তুলে আনে নির্মমভাবে। 

প্রদীপ, যিনি নিজের তামিল নাম শিভানাথন পরিবর্তন করে রাখেন ম্যাথিউ, তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, টেস্ট দলে জায়গা পাকা করতে একজন তামিলকে সিংহলিদের চেয়ে দশ গুণ ভালো খেলতে হয় আর তৈলমর্দন করতে হয়। একে তো আমি আট গুণ ভালো তায় আবার মোসাহেবিটা আসে না। ফলে আমাকে ওরা মুছে ফেলেছে। তিনি কি আসলে উপমহাদেশে গরীব, নিচুজাত, উপরের মহলের স্বার্থরক্ষা করতে না পারা লাখো লাখো ক্রিকেটারেরই প্রতীক নন?  

কিংবা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আক্রমণে পরিবারের মানুষদের হারানো প্রদীপের বন্ধু তামিল ‘জঙ্গী নেতার’ গল্প? যিনি এতই স্মার্ট যে, দুনিয়ার বড় বড় খেলা ফিক্সিং করে সেই পয়সায় অস্ত্র আমদানি-রপ্তানি করেন। যার সঙ্গে জড়িয়ে, জাতিগত দাঙ্গার আগুনে বাপের ব্যবসা প্রদীপ বেটিং আর আর্মসের জগতে ডুবে যান। জাতঘৃণা আর স্বজনপ্রীতির আঘাতে ক্রিকেটে ব্রাত্য খেলোয়াড়টি একসময় জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান পৃথিবীর দুরতম কোনায় নিজের সকল পরিচয় মুছে ফেলে। প্রদীপের এই গল্পে জঙ্গি আর যুদ্ধ বাধানোর কাহিনী উঠে আসে, জানা যায়, কিভাবে ক্ষমতা আর অর্থের লোভে বাধানো যুদ্ধে বলি হয় লাখো লাখো মানুষ। 

সব মিলিয়ে চায়নাম্যান এক দারুণ অভিজ্ঞতা। উইজডেনের বিচারে সর্বশ্রেষ্ঠ ফিকশন আর ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা বই। 

ক্রিকেটের গল্প বলতে গিয়ে এই সব কিছু এতোটাই মুন্সীয়ানায় লেখক তুলে ধরেছেন যে, কথার পেছনের কথা, গল্পের গভীরের গল্পটা ভাবতে পাঠককে বাধ্য হতে হয়। লেখক ক্রিকেট তথা খেলাধুলার শক্তি সমন্ধে তাই নিঃসন্দেহ হন। 

এই কারণে তিনি বলেন, খেলাধুলা দুনিয়াকে একতাবদ্ধ করতে পারে, ভাঙতে পারে সব দেয়াল, গুঁড়িয়ে দিতে পারে জাতিঘৃণা, অতীত আর সমস্ত ছক কষা পূর্বাভাসের। জীবন মূল্যহীন, ক্ষণস্থায়ী হলেও খেলাধুলা গুরুত্বপূর্ণ, চিরস্থায়ী। 

দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতির নানা দোলাচলে রেখে গল্পের শেষটা লেখক (কিংবা তিনি না-ও হতে পারেন) করেন দারুণ এক চমক দিয়ে। 

সব মিলিয়ে চায়নাম্যান এক দারুণ অভিজ্ঞতা। উইজডেনের বিচারে সর্বশ্রেষ্ঠ ফিকশন আর ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা বই। 

ক্রিকেট খেলা যারা খুব অপছন্দ করেন অথচ সাহিত্যপ্রেমী, তাঁরাও এই বইটা পছন্দ করবেন। যারা ক্রিকেট পছন্দ করেন, তাঁরা তো মুগ্ধ হবেনই। আর যারা দুইটাই পছন্দ করেন, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তাঁদের জীবনে এ এক অদ্বিতীয়, অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা হবে। 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×