'সেঞ্চুরি করা ছিল প্রতিদিন খাওয়ার মতোই'

উৎপল শুভ্র

২৪ জুলাই ২০২১

'সেঞ্চুরি করা ছিল প্রতিদিন খাওয়ার মতোই'

ছবিটা যে জহির আব্বাসের খেলোয়াড়ি জীবনের, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। ছবি: আইসিসি

স্টাইলিশ ব্যাটসম্যানের কথা উঠলে অবশ্যম্ভাবীভাবেই আসবে তাঁর নামটা। সেই ব্যাটিংয়ে রানের পাহাড় গড়েছেন, সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি। ১৯৯৪ সালে ঢাকায় সার্ক ক্রিকেটে এসেছিলেন দর্শক হয়ে। পাকিস্তানের ড্রেসিংরুমের সামনে দাঁড়িয়েই করেছিলাম এই ইন্টারভিউটা। যাতে জহির আব্বাসের ক্যারিয়ার ছাড়াও কথা হয়েছিল সে সময়ের বিশ্ব ক্রিকেটের নানা বিষয়ে।

প্রথম প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৪। ভোরের কাগজ।

যতদিন তিনি খেলেছেন, যে কারও তৈরি কাল্পনিক বিশ্ব একাদশেই তাঁর নাম ছিল নিশ্চিত। শুধু রান সংখ্যাই নয়, রান করার ধরনের কথা মনে রাখলেও জহির আব্বাস ছিলেন সত্তর  দশকে বিশ্বের সেরা দু-তিনজন ব্যাটসম্যানের মধ্যে। সেই জহির আব্বাস হঠাৎ করেই ঢাকায়। গতকাল সার্ক ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখেছেন পাকিস্তান ড্রেসিংরুমের সামনে বসে। বিসিসিবির আমন্ত্রিত অতিথি নন তিনি, এসেছেন নিজে থেকেই। ইন্টারভিউর শুরুতেই জানা গেল আসার কারণ, 'সার্ক ক্রিকেট দেখতে এসেছি, আসলে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে আসাই উচিত।'

ঢাকায় এটি তাঁর তৃতীয় সফর। ১৯৮৮-তে এশিয়া কাপের সময় এসেছিলেন, অতিথি হিসেবে, ১৯৬৭ সালে এসেছিলেন খেলতে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৯৭ রানের এক ইনিংসে। ঢাকায় টেস্ট খেলতে পারিনি। ১৯৬৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করাচিতে অভিষেক হওয়ার ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় টেস্টে বাদ দেওয়া হয় আমাকে--কারণটা জানালেন তিনিই। জহির আবাস দ্বিতীয় টেস্ট খেলেন চার বছর পর, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, এজবাস্টনে। দলে জায়গা পাকা করতে ভালো একটা স্কোর প্রয়োজন ছিল। তাই কিছু রান করেছিলেন তিনি, নির্দিষ্ট করে বললে ২৭৪।

এটিকেই তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় ইনিংস হিসেবে বেছে নিলেন জহির আব্বাস, 'এজবাস্টনে ২৭৪-ই আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়ে দেয়।' তবে প্রথমেই এ কথা বলেননি। স্মরণীয় ইনিংসের কথা জিজ্ঞেস করায় প্রথম উত্তর, 'যতগুলো খেলেছি সবগুলোই।'

যেগুলোতে রান না করে বা অল্প রানে আউট হয়েছেন?

'হ্যাঁ, সেগুলোও।'

২৭৪ রানের সেই ইনিংসটি তো হয় বিশ বছর আগে খেলা, কিছু মনে করতে পারেন?

'আপনি বলছেন বিশ বছর আগে। আমার তো মনে হচ্ছে এই গতকাল'-- বলেই হাসি।

তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে জহির আব্বাস খুবই সন্তুষ্ট। তবে একটু আফসোস আছে, 'এখনকার তুলনায় পাকিস্তান খুব কম টেস্ট খেলত তখন।' বেশির ভাগই বিদেশি দলগুলোর সঙ্গে, খেলা হতো আনঅফিসিয়াল টেস্ট। আমি ১৯৬৭ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত মাত্র ৭৮টা টেস্ট খেলেছি। এখনকার তুলনায় ১৭-১৮ বছরে ৭৮টি টেস্ট তো কমই বলতে হবে। তাহলে কি একটু আগে জন্মেছেন বলে নিজেকে আনলাকি মনে করেন? 'হ্যাঁ, তা তো একটু করিই' বলেই যোগ করেন, 'কিন্তু আগে জন্মানোতে আমার হাত নেই'। এরপরই হা হা হাসি।

ব্যাট হাতে ক্রিজে যেমন ছিলেন, কথাবার্তায়ও তেমনই প্রাণোচ্ছল আছেন জহির আব্বাস। দু'রঙা চুল ছাড়া ৪৭ বছরের চেহারায়ও তেমন ছাপ ফেলেনি। বর্তমানে কর্মরত আছেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস অর্থাৎ পিআইএতে। ক্রিকেটের সঙ্গে সংযোগ রেখেছেন অন্যভাবে। করাচির 'দ্য নিউজ' পত্রিকায় লেখেন নিয়মিত। তাহলে কি সার্ক ক্রিকেটে আসা লেখার দায়িত্ব নিয়েই?

'না, না, এমনিতেই আসা। হয়তো লিখতেও পারি, ঠিক নেই'...জবাব দিলেন টেস্টে ৪৪.৭৯ গড়ে ৫০৬২ রানের মালিক।

জহির আব্বাস। ছবি: গেটি ইমেজেস

খেলা ছেড়েছেন খুব বেশিদিন হয়নি, তবে তাঁর সময়কার সঙ্গে একটা পার্থক্য ঠিকই খুঁজে পান, 'এখন ব্যাটসম্যানদের খুব বেশি বড় ইনিংস খেলতে দেখি না। হয়তো ৫০-৬০ করল, অথবা সেঞ্চুরি। আমাদের সময় আমরা সব সময় বড় বড় হান্ড্রেড করার চেষ্টা করতাম।'

অতিরিক্ত ওয়ানডে ক্রিকেট এর মূল কারণ বলে একমত হলেন, তবে যোগ করলেন, 'কিছুই করার নেই। দর্শকরা ওয়ানডে পছন্দ করছে। তাই ওয়ানডে হতেই হবে। খেলাটা তো দর্শকদের জন্যই, তাই না?'

ওয়ানডেই এখন ক্রিকেটে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন জহির আব্বাস। যুক্তিও দিলেন, 'ওয়ানডেতে ওয়ার্ল্ড কাপ আছে। টেস্ট ক্রিকেটের কোনো ওয়ার্ল্ড কাপ নেই।'  এত বেশি খেলা খেলোয়াড়দের টেকনিকে ক্ষতি করছে স্বীকার করেও মাথা নাড়লেন, 'কিছু করার নেই। এটা বাণিজ্যিক পৃথিবী। ওয়ানডে হলো সময়ের দাবি।'

বড় বড় হান্ড্রেডের কথা বলছিলেন জহির আব্বাস। যা তিনি নিয়মিতই করেছেন৷ টেস্টে তাঁর ১২ সেঞ্চুরির চারটিই ডাবল (২৭৪, ২৪৫, ২৩৫* ও ২১৫)। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে  একই মাচের দুই ইনিংসে সর্বোচ্চ আটবার সেঞ্চুরি করার রেকর্ডটি তাঁর। এর মধ্যে চারটি ম্যাচের দুই ইনিংসে ছিল ডাবল সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরি, বিশ্ব রেকর্ড এটিও। এই রেকর্ড নিয়েই একটু গর্বের ছোঁয়া তাঁর কথায়, 'আমি খুব আনন্দিত এই গ্রেট রেকর্ড অর্জন করতে পেরে।' তারপর হেসে বললেন, 'আমার নিজের হয়তো গ্রেট রেকর্ড বলা উচিত নয়। তবে এটা রেকর্ড, রীতিমতো বিশ্ব রেকর্ড।'

সেঞ্চুরি করাটা অবশ্য জহির আব্বাসের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করা একমাত্র এশিয়ান ব্যাটসম্যান তিনি। এটি সম্ভব হয়েছে কাউন্টি ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সম্পৃক্তির কারণে। গ্লস্টারশায়ারের পক্ষে কাউন্টিতে অসাধারণ সব কীর্তি আছে তাঁর, একটু লেখা বিশ্ব রেকর্ড দুটি তারই মধ্যে পড়ে।  

সেঞ্চুরি করায় আমাকে একটু বেহিসেবীই বলতে পারেন। আমার জন্য সেঞ্চুরি করা ছিল প্রতিদিন খাওয়ার মতোই একটা ব্যাপার।'

সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি প্রসঙ্গে খুব সহজভাবে বললেন, 'হ্যাঁ, করেছিলাম। খেললাম আর হয়ে গেল। সেঞ্চুরি করায় আমাকে একটু বেহিসেবীই বলতে পারেন। আমার জন্য সেঞ্চুরি করা ছিল প্রতিদিন খাওয়ার মতোই একটা ব্যাপার।'  শততম সেঞ্চুরিটা আরও স্মরণীয় হয়ে আছে তা টেস্টে পেয়েছেন বলে। ১৯৮২-৮৩ মৌসুমে দেশের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে ২১৫ রানের এক ইনিংসের মাধ্যমে। এটা করতে পেরে খুব আনন্দ পেয়েছিলেন, তাই সেঞ্চুরি পরের দুই টেস্টেও।

কাউন্টি ক্রিকেটের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানালেন এক সুযোগে, 'প্রতিদিন খেলা হচ্ছে ওখানে। তার মানে প্র‍্যাকটিস হচ্ছে প্রতিদিন। আর যত প্র‍্যাকটিস হবে, ততই ভালো হবে খেলা।'

কিন্তু সপ্তাহে সাতদিনই খেলাটা কি ক্লান্তিকর নয়? ভেবেছিলাম জহির আব্বাস সম্মতিসূচক মাথা ঝোঁকাবেন। উল্টো বললেন, 'যখন আপনি ভালো করবেন, কোনো কিছুই ক্লান্তিকর মনে হবে না। আমি ওখানে ভালোই করছিলাম আর শারীরিক ক্লান্তির কথা যদি বলেন, আমি তা কখনোই বোধ করিনি।'

খেলা শুরু করার সময় কোনো আদর্শ ছিল না তাঁর, তবে পছন্দের ব্যাটসম্যান তো ছিলই, 'আমি পছন্দ করতাম হানিফ মোহাম্মদ ও রোহান কানহাইকে। ওঁরা ছিলেন গ্রেট ব্যাটসম্যান। তবে কাউকে আদর্শ হিসেবে না নিয়ে আমি আমার মতো উইকেটে থাকতে চেয়েছি।'

জহির আব্বাস উইকেটে থাকা মানেই তো বাউন্ডারির দিকে বল ছোটা। কথা শেষ হওয়ার আগেই হাসতে হাসতে জবাব, 'হ্যাঁ, বলটা তো বানানো হয়েছে সেজন্যেই।'

জহির আব্বাসের ব্যাটিং ছিল চোখের জন্য প্রশান্তি। ছবি: গেটি ইমেজেস

যেসব বোলারকে খেলেছেন, তাঁদের মধ্যে সেরা হিসেবে একজনকে বেছে নিতে পারলেন না। ভারতের স্পিন কোয়ার্ট্রেট বেদী, চন্দ্রশেখর, প্রসন্ন, ভেংকটরাঘবন থেকে শুরু করে বলে গেলেন তাঁর সময়ের বিখ্যাত সব বোলারের নামই। সবচেয়ে সমস্যা হয়েছে কাকে খেলতে? 'আসলে যখন আমি ফর্মে ছিলাম, কাউকে খেলতেই সমস্যা হয়নি। কিন্তু যখন বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, কে না সমস্যায় ফেলেছে! তখন সবাই হয়ে উঠেছে মহা বিপজ্জনক বোলার।'

সত্তরের দশকের পাকিস্তান দলটির সঙ্গে ইমরানের বিশ্বজয়ী দলটির তুলনা করতে গিয়ে বললেন, 'আমাদের ব্যাটিং ছিল দারুণ শক্তিশালী। কিন্তু বোলিং অ্যাটাক ভালো ছিল না। ইমরানের সময় থেকে ভালো খেলার এসেছে দলে এবং ভালো খেলার থাকলে জয় তো আসবেই।' পাকিস্তানের বর্তমান দলটি সম্পর্কেও উঁচু ধারণা তাঁর। বিশ্বের অন্যতম সেরা দল মনে করেন পাকিস্তানকে, 'ওয়ানডে ক্রিকেটে বিশ্বকাপ আছে। আমরা সেটাতে চ্যাম্পিয়ন। টেস্টে তো আর বিশ্বকাপ নেই, তাই বলা মুশকিল। তবে পাকিস্তান অবশ্যই সেরা দু'তিনটি দলের একটি।'

'আমি আশা করি, টেন্ডুলকার যা করছে, বাসিতও তা করতে পারবে। বাসিতের অনেক কিছু পাওয়ার মতো প্রতিভা আছে। সব শটই আছে ওর হাতে। কেন যে ও বড় হান্ড্রেড পাচ্ছে না!'

বর্তমান বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান মনে করেন শচীন টেন্ডুলকারকে। প্রশংসায় অন্যরকম শোনাল তাঁর গলা, 'এই ছেলেটি সত্যিই অসাধারণ। খুব খুবই ভালো খেলছে।' তবে সামর্থ্যের দিক থেকে বাসিত আলীকে খুব একটা পিছিয়ে রাখতে রাজি নন, 'আমি আশা করি, টেন্ডুলকার যা করছে, বাসিতও তা করতে পারবে। বাসিতের অনেক কিছু পাওয়ার মতো প্রতিভা আছে। সব শটই আছে ওর হাতে। কেন যে ও বড় হান্ড্রেড পাচ্ছে না!'

ব্রায়ান লারার কথা বলছেন না দেখে তুলতে হলো তাঁর নাম। 'লারা কতগুলো বিশ্বরেকর্ড গড়বে, এটা আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না। কারণ এটা বলা সম্ভব নয়। সে তো অনেক কিছুই অর্জন করে ফেলেছে। কাগজে-কলমে নয়, তবে দেখিয়েছে।'

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×