শিবনারায়ণ চন্দরপল

অন্যরকম এক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান

উৎপল শুভ্র

১৬ আগস্ট ২০২১

অন্যরকম এক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান

শিবনারায়ণ চন্দরপল

তুলনায় অনেক বিখ্যাত ক্যারিবীয়দের ছাপিয়ে এক সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। প্রায় ২১ বছরের ক্যারিয়ার, খেলেছেন ১৬৪টি টেস্ট, যাতে প্রায় ১২ হাজার রান। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ডাবলিনে নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে শিবনারায়ণ চন্দরপল তাঁর লক্ষ্য হিসেবে বলেছিলেন `আর নয়/দশ বছর খেলা`, হিসাব করে দেখছি, খেলেছেন আরও ১৬ বছর!

প্রথম প্রকাশ: ৩০ মে ১৯৯৯। প্রথম আলো।

ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের মধ্যে তিনি এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। শারীরিক আকৃতি, খেলার ধরন, মেজাজ-মর্জি কোনো কিছুই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানসুলভ নয়। এই ব্যতিক্রমী চরিত্র নিয়েই শিবনারায়ণ চন্দরপল এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের দারুণ গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য। ব্যাটিংয়ে ব্রায়ান লারানির্ভর দল অধিনায়ক ব্যর্থ হলে চন্দরপলের ব্যাটের দিকেই তাকিয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা নিয়ে।

গায়ানার রাজধানী জর্জটাউন থেকে ২০ মাইল দূরে ইউনিটি নামের এক গ্রামে জন্ম চন্দরপলের। এই গ্রাম থেকে আসা ওয়েস্ট ইন্ডিজের আরেক বিখ্যাত টেস্ট ক্রিকেটার সবদিক দিয়েই চন্দরপলের বিপরীত। এক সময়কার ভীতিপ্রদ ফাস্ট বোলার ও বর্তমানে ক্রিকেট লেখক-ধারাভাষ্যকার ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি লম্বা কলিন ক্রফটের পাশে ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির চন্দরপলকে বরং অদ্ভুতই দেখায়। কবে তাঁর কোন পূর্বপুরুষ ভারত থেকে পাড়ি জমিয়েছিল গায়ানায়, তা ঠিক জানেন না চন্দরপল। শুধু জানেন, ক্লাব ক্রিকেটার বাবা আর বড় ভাইকে দেখে ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান।

বয়স যখন আট, বাবা প্রথম ব্যাট তুলে দিয়েছিলেন হাতে। ছোটখাটো এই ছেলেটি একটু অন্যরকম ব্যাটিং প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে, এটি জানাজানি হতে সময় লাগেনি। নয় বছর বয়সেই অনূর্ধ্ব-১৬ দলে খেলতে শুরু করেন। একবার ইস্ট কোস্ট পুলিশ ফোর্সের পক্ষে দলের ৬০ রানের ৪৩-ই এসেছিল চন্দরপলের ব্যাট থেকে। ১৯৯৪ সালে মাইকেল আথারটনের ইংল্যান্ড যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করে, তখন হোম গ্রাউন্ড জর্জটাউনের বৌর্ডাতেই টেস্ট অভিষেক ১৯ বছর বয়সী শিবনারায়ণ চন্দরপলের। ঘরোয়া ক্রিকেটে তো সাফল্য ছিলই, তার সঙ্গে আগের মৌসুমে পাকিস্তানের বিপক্ষে বোর্ড প্রেসিডেন্ট একাদশের হয়ে ১৪০ রানের ইনিংসটিই বেশি দৃষ্টি কেড়েছিল নির্বাচকদের।

সদ্য কৈশোর পেরুনো চন্দরপলের সেই যে অভিষেক হলো, এরপর থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে খেলছেন তিনি নিয়মিতই। আরও ৯/১০ বছর নিয়মিত থাকাটাই এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের লক্ষ্য। তবে এই পরিচিতিটা পাল্টে দেয়ারও একটা স্বপ্ন আছে তাঁর। লেগ স্পিন বোলিংটায় আরেকটু ধার এনে অলরাউন্ডার হিসেবেই পরিচিত হতে চান শিবনারায়ণ চন্দরপল। শুনুন তাঁর মুখেই:

শিবনারায়ণ চন্দরপল

উৎপল শুভ্র: ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে আপনার অভিষেক তো প্রায় কিশোর বয়সে। যখন ডাক পেলেন, সেই অনুভূতিটা নিশ্চয়ই মনে পড়ে আপনার।

শিবনারায়ণ চন্দরপল: তা তো মনে পড়েই। যেকোনো ক্রিকেটারের জন্যই দেশের পক্ষে খেলাটা একটা স্বপ্নের ব্যাপার। ওই তরুণ বয়সে স্বপ্নটা আরও বেশি থাকে।

শুভ্র: ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যখন দলে ডাক পেলেন, তা কি কিছুটা বিস্ময় হয়েই এসেছিল?

চন্দরপল: সত্যি বলতে কি, আমি একদমই আশা করিনি। জর্জটাউন টেস্ট শুরু হওয়ার দিন সকালে আমি জানতে পারি যে, খেলছি। আগের রাতেও আমি ভাবিনি, পরদিন আমার টেস্ট অভিষেক হচ্ছে।

শুভ্র: ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ডাক পাওয়ার খবরটা কিভাবে পেয়েছিলেন?

চন্দরপল: আমার দুই বন্ধু, ওরা আমার সঙ্গে একই ক্লাবে খেলে, খবরটা দিয়েছিল। ওদের একজনের নাম মাইকেল পেরোরো, আরেকজনের নাম রিকার্ড জুভো। ওরাই প্রথম জানতে পারে, আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ডাক পেয়েছি। আমি তখন আমার বাড়িতে, ইউনিটি নামের গ্রামে, জর্জটাউন থেকে যা ২০ মাইল দূরে। ওরাই এসে আমাকে জানায়, জর্জটাউনের হোটেলে যেতে বলা হয়েছে আমাকে।

শুভ্র: টেস্ট অভিষেকের কোন স্মৃতিটা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে এখন?

চন্দরপল: আমি যখন ব্যাট করতে নামি, তখন জিমি (অ্যাডামস) ছিল উইকেটে। ও আমাকে দারুণ সাহস দিয়েছে, পুরোটা সময় গাইড করেছে। আমারও প্রতিজ্ঞা ছিল একটাই...সুযোগ যখন পেয়েছি, তখন এটিকে ফসকে যেতে দিলে চলবে না, কাজে লাগাতে হবে।

টেস্ট অভিষেকে। বয়স তখন মাত্র ১৯। ছবি: চিকো খান

শুভ্র: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তো পাঁচ বছর হয়ে গেল। এই পাঁচ বছরকে আপনি নিজে কিভাবে দেখেন?

চন্দরপল: আমি মনে করি, ঠিকই আছে। শুধু সেঞ্চুরির সংখ্যাটা একটু কম। আরও কিছু সেঞ্চুরি পাওয়া উচিত ছিল আমার (তখন পর্যন্ত ৩৫ টেস্টে মাত্র ২টি সেঞ্চুরি ছিল চন্দরপলের)। তবে সময় তো আছে, আরও কয়েকটা সেঞ্চুরি পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

শুভ্র: সেঞ্চুরি পান না পান না করতে করতে তো ১৯৯৭ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট-ওয়ানডে দুটিতেই সেঞ্চুরি পেয়ে গেলেন। সেই সিরিজটিতেই মনে হয় সেরা রূপে দেখা গেছে আপনাকে...

চন্দরপল: হ্যাঁ, ওই সিরিজটি ছিল গ্রেট। এই একটি সিরিজ আর এরপর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ এই দুটিই এখন পর্যন্ত আমার ক্যারিয়ারের সেরা দুটি সিরিজ। এরকম আরও কিছু সিরিজ আমার চাই।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: ভারতের বিপক্ষে এই সিরিজে আপনার ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো দিক ছিল, অফ সাইডে দুর্দান্ত খেলা। এর আগ পর্যন্ত তো মূলত অন সাইড প্লেয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন আপনি। এই পরিবর্তনটা কিভাবে করলেন?

চন্দরপল: আমি উইকেটের দুই পাশেই খেলতে পারি। খেলতে পারি সব ধরনের শটই। তবে অফ সাইডে ইচ্ছে করেই বেশি খেলি না, কারণ তাতে ব্যাটের কানায় লেগে ক্যাচ উঠে যাওয়ার ভয় থাকে। আমি তাই আমার শরীরের কাছাকাছি বলগুলোই খেলি, সামান্য বাইরের বলও ছেড়ে দেই। এটাই আমার খেলার ধরন। তবে চাইলে অফ সাইডেও খেলতে পারি আমি।

শুভ্র: আপনি তো বলও করেন। সেটিও আবার কঠিন এক বল...লেগ স্পিন। আপনি নিজেই বলুন তো, বোলার হিসেবে আপনি কেমন?

চন্দরপল: এটা এই মুহূর্তে বলাটা খুব কঠিন। কারণ, অনেকদিন আমি ম্যাচে বল করার সুযোগ পাই না। আমাদের দলে সব সময়ই ফাস্ট বোলারদের রাজত্ব, দু'একজন স্পেশালিস্ট স্পিনারও আছে এখন। তবে আমার বিশ্বাস, আমি খুব খারাপ বল করি না। নেটে নিয়মিতই বল করছি, যাতে অধিনায়ক ডাকলেই সাড়া দিতে পারি। অলরাউন্ডার হিসেবে পরিচিত পাওয়াই আমার স্বপ্ন।

শুভ্র: ব্রায়ান লারার সঙ্গে আপনার অনেক স্মরণীয় পার্টনারশিপ আছে। লারা ৩৭৫ করার সময়ও তাঁর সঙ্গে ছিলেন আপনি। তা লারার সঙ্গে ব্যাট করার অভিজ্ঞতাটা কেমন?

চন্দরপল: সত্যিই বলছি, ব্রায়ানের সঙ্গে ব্যাট করাটা দারুণ এক অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে যখন ও পুরো ফর্মে থাকে, তখন অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানের কাজটাও অনেক সহজ করে দেয়। কারণ, তখন তাকে যা করতে হয়, তা হলো শুধু আউট না হওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করা। কারণ, ব্রায়ান যতক্ষণ আছে, রানের ব্যাপারে ভাবতে হয় না। অন্যপ্রান্ত থেকে ওর ব্যাটিং দেখাটাও খুব আনন্দের।

ব্রায়ান লারার সঙ্গে। লারার সঙ্গে দারুণ কিছু পার্টনারশিপ হয়েছে চন্দরপলের। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: লারার ব্যাটসম্যানশিপ থেকে একটি জিনিস নিজের করে নেয়ার সুযোগ থাকলে কী নেবেন আপনি?

চন্দরপল: (বেশ কিছুক্ষণ ভেবে) ব্রায়ান যেভাবে খেলে, তা আমার চেয়ে একেবারেই আলাদা। আমরা দুজন দুরকম খেলোয়াড়। ও যে রকম শট খেলে, তা আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু চাইলেই তো আমি ওরকম খেলতে পারব না। তাই আমি আমার খেলাই খেলতে চাই।

শুভ্র: ঠিক আছে, তাহলে প্রশ্নটা এভাবে করি, লারার ব্যাটিংয়ের কোন দিকটির সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করেন আপনি?

চন্দরপল: আমি সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করি, ওর বড় ইনিংস খেলার ক্ষমতাকে। ও একবার শুরু করলে হান্ড্রেড, ডাবল হান্ড্রেড, ট্রিপল হান্ড্রেডের আগে থামে না। এটি শুধু এক ম্যাচেই নয়, দেখা গেল একটা বড় স্কোর করার পর পরের ম্যাচেও আবার তা-ই করল ও। এটা অন্য যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই খুব অনুপ্রেরণাদায়ী। আপনারও মনে হবে, ও যদি পারে, তাহলে আমি পারব না কেন? অন্তত আমি এভাবেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করি।

শুভ্র: ছোটবেলায় কোনো 'আইডল' কি ছিল আপনার?

চন্দরপল: না, সেভাবে না। পছন্দের খেলোয়াড় ছিল বেশ কজন, তবে তাঁদের খুব একটা খেলতে দেখিনি। আসলে আমি খেলা শুরু করার আগে সেভাবে ক্রিকেট দেখিনি। কারণ, আমরা থাকতাম জর্জটাউনের অনেক বাইরে।

লারা একবার শুরু করলে হান্ড্রেড, ডাবল হান্ড্রেড, ট্রিপল হান্ড্রেডের আগে থামে না। এটি শুধু এক ম্যাচেই নয়, দেখা গেল একটা বড় স্কোর করার পর পরের ম্যাচেও আবার তা-ই করল ও।

শুভ্র: বোলারদের মধ্যে কাকে আপনি এড়াতে চাইবেন?

চন্দরপল: ওয়াসিম আকরামকে। ওর বিপক্ষে খেলতে আমার বেশ সমস্যা হয়েছে। বল নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। খুবই কঠিন এক বোলার।

শুভ্র: আপনার প্রিয় ব্যাটসম্যান?

চন্দরপল: ব্রায়ানের (লারা) খেলা আমার খুব ভালো লাগে। কার্লের (হুপার) ব্যাটিংও ছিল দুর্দান্ত। কিন্তু ও তো.....

শুভ্র: কার্ল হুপার হঠাৎ করে এভাবে অবসর নিয়ে ফেলায় নিশ্চয়ই আপনার খুব মন খারাপ হয়েছে?

চন্দরপল: তা তো হয়েছেই। তবে আমি জানি না, কেন ও আমাদের ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তাই এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না।

শুভ্র: শচীন টেন্ডুলকারকে কেমন লাগে?

চন্দরপল: শচীন খুব ভালো ব্যাটসম্যান। ও যখন খেলতে শুরু করে, দেখতেও খুব ভালো লাগে। তবে আমাদের বিপক্ষে যখন খেলে, তখন নয়। ও যখন ব্যাটিং করে, তখন আমি মাঠে না থাকতেই বেশি পছন্দ করি।

শুভ্র : তাহলে তো আপনি টেন্ডুলকারের বিপক্ষে বোলিং করতে চান না, এটাই তো বুঝব, নাকি?

চন্দরপল: তা কেন? আই ডোন্ট মাইড। ওর বিপক্ষে বোলিং তো করেছি। চার-ছয় মেরেছে, আই ডোন্ট মাইন্ড। আমি এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছি।

শুভ্র: আপনার ক্রিকেটিং স্বপ্ন কী?

চন্দরপল: ক্রিকেটিং স্বপ্ন...ক্রিকেটিং স্বপ্ন...স্বপ্ন ঠিক নয়, বলতে পারেন টার্গেট। আমি তো এখন ২৪, তাই আরও ৯/১০ বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে খেলতে চাই। ততদিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেন আবার শীর্ষে ফিরে যায়, এটাই আমার স্বপ্ন।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×