নেপথ্যের মাশরাফি-৪

`ওপরওয়ালা কখন কী দেবে, তা আপনি জানেন না`

উৎপল শুভ্র

২৩ আগস্ট ২০২১

`ওপরওয়ালা কখন কী দেবে, তা আপনি জানেন না`

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সফলতম অধিনায়কের সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বে ছিল তাঁর অধিনায়কত্ব-দর্শন, শেষ পর্বে অধিনায়কত্বের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ `ম্যান ম্যানেজমেন্ট`। মাশরাফীয় রীতি মেনে যা শুধু আর খেলায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে গেছে জীবনেও।

প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর ২০১৭। প্রথম আলো ঈদ সংখ্যা।

শুভ্র: একবার কোন একটা ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে অদ্ভুত একটা কথা বলেছিলেন। খেলাধুলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে একটা প্রশ্ন হয়েছিল, জবাবে আপনি বলেছিলেন, খেলা কোনো চ্যালেঞ্জই না। আসল চ্যালেঞ্জ ছেলেমেয়েকে মানুষ করা। তাৎক্ষণিকভাবে কীভাবে অমন একটা কথা মনে হলো? 

মাশরাফি: আমি মনে করি, সব বাবা-মায়ের জন্যই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ওটাই। আমি যা হয়েছি, তা আমার আব্বা-আম্মার প্রতিফলন। আমাকে যদি পাঁচটা মানুষ ভালো জানে, আমি চাইব আমার ছেলেমেয়েকেও মানুষ ওভাবে জানুক। একজন বাবার কাছে আপনি জিজ্ঞেস করে দেখবেন, আপনি নিজেও বাবা। একজন রিকশাওয়ালার কথাই ধরুন না, একজন রিকশাওয়ালার জায়গায় সে কিন্তু মহান। সে রিকশা চালিয়ে ২০ বছর ধরে হয়তো ছেলেমেয়েকে মানুষ করছে। কী কারণে? ছেলেমেয়ের কাছে তার একটাই চাওয়া—তুই ভালো কিছু কর। তুই ভালো কিছু হ। আমিও আমার ছেলেমেয়েকে এই শিক্ষাতেই বড় করতে চাই। আমার মতো আমার স্ত্রীও চায় না, ওরা ভোগবিলাসী জীবন যাপন করে বড় হোক। আমাদের চিন্তাভাবনা একটাই, ওরা যেন ভালো মানুষ হয়। এটাই আসল, টাকাপয়সার দিক থেকে ফকির হয়ে থাকলেও কিছু আসে–যায় না। এই একটু আগেও বাসায় বউয়ের সঙ্গে ছেলেমেয়ে নিয়েই আলাপ করে এসেছি। ওদের সঙ্গে কীভাবে কথা বললে ভালো হয়। আমার ছেলেটার বয়স এখন আড়াই বছর। ওর সঙ্গে এখন কীভাবে ঠিক কথা বলতে হবে—এসব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েই আলোচনা বেশি হয়। আমার মেয়ে কি খারাপ কিছু করছে? কাজের মেয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে দেখলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়—কেন এমন করবে? ওর মাত্র ছয় বছর বয়স, ও তো কিছু বোঝে না। ওর বন্ধু, ওর শিক্ষক; যা-ই বলেন, আমার বাসায় ১০-১২ বছরের একটা মেয়ে আছে—টুনি নাম, ও-ই সব। ওর দেখভাল, ওর খাওয়াদাওয়া...সব সে-ই করে। ওরা আবার বন্ধুও। আমার মেয়ে ওর সঙ্গে যখন একটু খারাপ ব্যবহার করে, ওটা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। ওকে যখন বকা দিই, এটা তুমি কেন করলে? ও বলে, ভুল হয়ে গেছে। আমি বলি, তো টুনি আপু চলে যাক বাসায়! ও বলে, না, আমি আর জীবনেও করব না। মেয়ের সঙ্গে কথা বলে আসলে আমি এটাই বোঝার চেষ্টা করি যে, ওর মানসিকতা ঠিক আছে কি না। আমার স্ত্রীও এ রকম। ছেলেমেয়ে কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে কি না, এটা আমরা খুব খেয়াল করি। এসব করতে গিয়ে দেখছি, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ এগুলোই। খেলা তো অনেক পরের জিনিস, এক অর্থে অনেক সহজও। আমাকে যখন ওই প্রশ্নটা করা হয়েছে, আমার মনে হয়েছে, খেলা আর কী চ্যালেঞ্জ, আমি তো দেখি আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওটা। আমার মেয়ে একটা ভুল করছে, এটাই শিখে গেলে জীবনে একটা বাজে জিনিস শিখে গেল।

শুভ্র: অধিনায়কত্ব বা নেতৃত্বের একটা বড় অংশ হচ্ছে সতীর্থ খেলোয়াড়দের নিয়ে একসঙ্গে চলা এবং তাদের পরিচালনা করা। যেহেতু মানুষ নিয়ে কাজ। একেকটা মানুষ একেক রকম, একেকজন একেকভাবে উদ্দীপিত হয়। এখানে আপনার মন্ত্রটা কী?  

মাশরাফি: প্রথমেই বলব, সবাই কিন্তু একটু ভালো ব্যবহার চায়। আপনি একজন সৈনিককে যদি রুটি আর ছুটি দেন, সে আপনার জন্য জীবন দিয়ে দেবে। প্রত্যেক মানুষ ভালো ব্যবহার চায়, একটু আস্থা চায়। অনেকেই জানে, আমি হয়তো কিছুই করতে পারব না। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে যদি খানিকটা মিশি, একটু থাকি, সময় দিই, তাহলে অবশ্যই ওর ভালো লাগতে পারে। তবে এটাও বুঝতে হবে যে, আমার সঙ্গ তার ভালো লাগছে কি না। আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়, আমার ছেলেপেলে যারা আছে, আমার দলে যারা আসে, প্রত্যেককে আমি অত্যন্ত ভালোবাসি। আমার পরিবার ভাবি। সব সময় কাউকে কিছু বলার আগে চিন্তা করি যে ওর মা আছে, বাবা আছে, ভাই আছে। আমার আচরণে ও যদি কষ্ট পায়, যদি ওর কোনো ক্ষতি হয়, অবশ্যই ওর মা-বাবার সেটা খারাপ লাগবে। ছেলে হয়তো বাবার সঙ্গে আলাপ করবে যে, মাশরাফি আমাকে এই বলেছে। ওর বাবা আমাকে কিছু বলবেন না—বলার সুযোগও নেই—কিন্তু তাঁর তো খারাপ লাগবে। এটা আমি সবার আগে ভাবি। অন্যদের কাছ থেকেও এটাই আশা করি। কারণ, আমারও পরিবার আছে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমরা এক জায়গায় আছি। সতীর্থ খেলোয়াড়দের নিয়ে একসঙ্গে চলা এবং তাদের পরিচালনা কথা যদি বলেন, আমি একে খুব সাদামাটাভাবে দেখি—সবার সঙ্গে ভালোভাবে সহজ-সরলভাবে চলা এবং আনন্দ-ফুর্তি করা।

আমাদের দলের জন্য এটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা খুব দ্রুত ‘হোমসিকনেসে’ আক্রান্ত হই। এই যে ইংল্যান্ড পাঁচ-ছয় মাস ধরে ট্যুর করে, আমাদের জন্য এটা কঠিন। ওদের গার্লফ্রেন্ড বা ওদের বউ সঙ্গে থাকলেই হয়। আমাদের তা হয় না। আমাদের বাবা-মা লাগে, বন্ধুবান্ধব লাগে। দেশের আলো-বাতাস লাগে। আমি আমার ১৭ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলছি। এ কারণে বলি, লম্বা ট্যুরে সম্ভব হলে মাঝখানে চার-পাঁচ দিনের জন্য হলেও আমাদের দেশে ফিরতে দেন। পরিবারের সঙ্গে থাকতে দেন। লম্বা ট্যুরে একটা ভয় থাকে আমার। এই জন্য আমি ওদের সঙ্গে মিশি, ঘুরি, কথা বলি। একসঙ্গে আনন্দ-ফুর্তি করার চেষ্টা করি। এই যেমন শ্রীলঙ্কায় আমরা রান্না করে খেয়েছি। সবাই মিলে এবং সবাইকেই কাজ করতে হয়েছে। এমনকি সাকিবও পেঁয়াজ না হলে কিছু একটা কেটেছে। ভালো দিক হলো, আমরা সবাই সবার সঙ্গ পছন্দ করি। এর ভেতরে খারাপ লাগা-ভালো লাগা, গণ্ডগোল যে হয় না, তা নয়। একসঙ্গে চলতে গেলে এটা হয়ই। আবার সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যায়। এমন নয় যে, আমাদের সিনিয়রদের ঢুকতে হয়, ওরা নিজেরাই ঠিক করে ফেলে। এতে ওরাও নেতৃত্ব বিষয়টা শিখছে। ওদের গণ্ডগোল হচ্ছে, ওরাই ঠিক করে নিচ্ছে। আমাদের সুবিধা হলো, আমরা অন্য দেশের মতো না। ব্যক্তিত্বের সংঘাত, এ-ওর সম্পর্কে কথা বলছে...আমাদের মধ্যে এসব দেখবেন না।

 শুভ্র: এর বড় একটা কৃতিত্ব আপনারই পাওনা। দলে এমন পরিবেশ তৈরি করেছেন বলেই এমন হয়েছে। সব সময় তো এমন ছিল না। 

মাশরাফি: ওই ছেলেগুলোকেও এ জন্য অবশ্যই সাধুবাদ দিতে হবে। ওদের এমন মানসিকতা না থাকলে এটা সম্ভব হতো না।

শুভ্র: দলের বাকি সবার চেয়ে বয়সে আপনি বড়, ক্যারিয়ারের দিক থেকেও অনেক সিনিয়র, এটা কি আপনাকে সাহায্য করেছে?

মাশরাফি: বয়সে কমবেশি আছে। তবে তামিম-সাকিবরা কিন্তু নিজেদের নিয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। অন্যায় কিছু হলে ওরা মেনে নেবে না। এমন নয় যে, বয়সে-ক্যারিয়ারে বড় আর অধিনায়ক বলে আপনি অন্যায় কিছু করেও পার পেয়ে যাবেন। নিজে করবেন না, অথচ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেবেন, এ রকম কিছু হবে না।

শুভ্র: শেষ প্রশ্নটি সেই শুরুর প্রসঙ্গ দিয়ে। আপনাকে নিয়ে এখন মানুষের এই যে এত আবেগ, এত ভালোবাসা, এতে কী মনে হয়, মানুষের যা প্রাপ্য দেরিতে হলেও সে সেটা পায়? আপনাকে আমরা যারা ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি, তারা তো জানতামই আপনি কেমন। কিন্তু ২০১৪ সালে আপনি অধিনায়কত্ব না পেলে আমজনতার কাছে বিষয়টি অজানাই থেকে যেত।

মাশরাফি: প্রথমত বলব, ২০১৪-এর আগে আমি যা ছিলাম, এখনো তা-ই আছি। আমার চিন্তাভাবনায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। অনেকে অনেক কিছু বলতে পারে। আমাকে নিয়ে কারও যে বাজে ধারণা নেই, এমনও নয়। আমি তো আর তা বদলাতে পারব না। সব সময় একটা জিনিসই চেয়েছি আমি—যেন মনের আনন্দে খেলি। ২০০১ সালে মনের আনন্দে খেলতে শুরু করেছিলাম। ২০১৭-তেও মনের আনন্দেই খেলছি। মনের আনন্দে কাজ করার মজাই আলাদা। ওই যে রাতের বেলা ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে সকালবেলা উঠে মাঠে যাওয়া...সকালে বিছানা থেকে নামতে আমার খুব কষ্ট হয়, পা দুটো অসাড় হয়ে থাকে, তারপরও ওটাই আমি উপভোগ করি এখনো। এমনকি ঘরোয়া লিগে ক্রিকেটে খেলাও। খেলাটা আমি মনের আনন্দেই খেলছি। এর মধ্যে যে এত কিছু ঘটে গেছে, ওই যে বললাম, আমি বিশ্বাস করি, ওপরওয়ালা আপনাকে কখন কী দেবে, সেটা আপনি জানেন না।

তবে চলার পথে সব সময় একটা বিষয় আমার মাথায় থাকে, আমাকে যদি কেউ ভালোবাসে, তার কাছে যেন কখনো খারাপ না হই। যদি আমাকে কেউ খারাপ জানে, সেটা বিভিন্ন কারণে জানতেই পারে। তার চিন্তাভাবনা হয়তো আমি বদলাতে পারব না। কিন্তু আমার দায়িত্ব হচ্ছে একজন মানুষ হিসেবে ঠিক কাজ করার চেষ্টা করা। সব সময় একজন মানুষ যে ঠিক কাজ করতে পারে তা না, বা ঠিক কাজ মনে করে সে যা করছে সেটাই যে ঠিক, তা-ও সব সময় সত্যি নয় হয়তো। তবে মনের আনন্দে ভালো করে যাওয়ার চেষ্টা করে যাওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। পরে কী হলো না হলো, সেটা পরের ব্যাপার।

সমাপ্ত

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×