টেড ডেক্সটারের চিরবিদায় এবং ইডেনে দাঁড়িয়ে সেই ইন্টারভিউ

উৎপল শুভ্র

২৭ আগস্ট ২০২১

টেড ডেক্সটারের চিরবিদায় এবং ইডেনে দাঁড়িয়ে সেই ইন্টারভিউ

টেড ডেক্সটার

টেড ডেক্সটারের মৃত্যুর খবরটা শুনেই মনে পড়ে গেল ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারের কথা। ভারত-ইংল্যান্ড কলকাতা টেস্টের আগে সেই সাক্ষাৎকারে সিরিজ নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা তো আছেই, আছে তখনকার মহাআলোচিত বল টেম্পারিং নিয়ে তাঁর ভাবনাও। দক্ষিণ আফ্রিকায় মাত্রই টিভি আম্পায়ারের আবির্ভাব ঘটেছে, ওভার প্রতি বাউন্সার নির্দিষ্ট করে দেওয়ার আইনটাও হয়েছে কিছুদিন আগে। এসব প্রসঙ্গও তাই এসেছিল আলোচনায়।

প্রথম প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ১৯৯৩। ভোরের কাগজ।

ইডেনের সবুজ গালিচায় শেষ আভা ছড়িয়ে দিয়ে এক রাত্রির মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন সূর্যদেব। এক পাশে তখনো নেট প্র্যাকটিস করছে ইংল্যান্ড দল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে দেখছেন দীর্ঘদেহী সুদর্শন এক ভদ্রলোক। মাথায় হ্যাট, বুকে জোড়া হাত। সামনাসামনি এই প্রথম দেখা, তবুও চিনতে অসুবিধে হলো না কোনো। টেড ডেক্সটার, ইংল্যান্ডের নির্বাচকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান। এই পরিচয়ের চেয়ে ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর অর্জনও কম স্মরণীয় নয়। ৬২ টেস্টে ৪৭.৯২ গড়ে ৪৫০২ রান, সঙ্গে উইকেটও আছে ৬৬টি। ৯টি টেস্ট সেঞ্চুরির ৬টিই ১৪০ রানের বেশি। ডাকা হতো 'লর্ড টেড' নামে। ব্যক্তিত্বের সঙ্গে রাজকীয় ব্যাটিংয়েরও ভূমিকা ছিল এতে। পড়ে জানা এসব তথ্য মনে নিয়ে কথা বলতে এগিয়েছিলাম একটু ভয়ে ভয়েই। ডেক্সটারের সহজ ব্যবহারে নিমেষেই অদৃশ্য সে অনুভূতি। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে একটু অবাকই হলেন। ঢাকায় টেস্ট খেলেছেন। মনে করিয়ে দিতেই বললেন, 'যা একটা পিচ ছিল না সেবার! বল হাঁটুর উপরে ওঠেনি একবারও (নিচু হয়ে উচ্চতাটাও দেখালেন)।'

‘রেজাল্ট মনে আছে?'

'টেইম ড্র ছাড়া তো আর কিছু হবার কথা না।'

ইডেন গার্ডেনে দাঁড়িয়েই টেড ডেক্সটারের সঙ্গে পরবর্তী মিনিট পঁয়ত্রিশের এই কথোপকথন।

উৎপল শুভ্র: বিতর্কিত ব্যাপার দিয়েই শুরু করি। ডেভিড গাওয়ার কাল কলকাতায় আসছেন কমেন্টেটর হিসেবে। অথচ দলেই থাকার কথা তাঁর…

টেড ডেক্সটার: আপনি জানেন, আমি ম্যানেজমেন্টের সদস্য। তাই নির্বাচক কমিটির কোনো সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমি একা কিছু বলতে পারব না। দুঃখিত।

শুভ্র: এই সিরিজ নিয়ে কী ভাবছেন?

ডেক্সটার: দেশের মাটিতে ভারত সব সময়ই ভালো খেলে। শুধু ভারত কেন, সবাই তাই। দক্ষিণ আফ্রিকায় তারা ভালো না করতে পারলেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাপারটা অন্যরকম হবে। দুটি ওয়ানডেতেও তো দেখা গেছে তাই।

শুভ্র: এই ইংল্যান্ড দলটিকে বলা হচ্ছে বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রস্তুতি নেয়া দল।

ডেক্সটার: কথাটা মিথ্যে নয়। আমরা প্রচুর পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করেছি এজন্যে। গত মৌসুম শেষে পুরো ছয় সপ্তাহ বিশ্রাম নিয়েছে খেলোয়াড়রা। বোর্ডের সঙ্গে কন্ট্রাক্টের অধীনে থাকায় কোনো রকম ক্রিকেট খেলতে পারেনি তারা। শুধু এই সফরের জন্যে প্রস্তুতি নেয়া ছাড়া আর কিছু করেনি চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়েরা।

এই হাসি-হাসি মুখটা এখন অতীত

শুভ্র: ইংল্যান্ডের বোলিং অ্যাটাক সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? ওয়ানডের জন্যে হয়তো যথেষ্ট ভালোই এই বোলিং, কিন্তু টেস্টে বিপক্ষকে দুবার অল আউট করার ক্ষমতা কি আছে এদের?

ডেক্সটার: কেন, এই বোলিং অ্যাটাক কি ইংল্যান্ডকে টেস্ট জেতায়নি? দেখা যাক এবার কী হয়!

শুভ্র: ফিল টাফনেলকে টেস্টে আপনাদের ম্যাচ উইনিং বোলার ধরা হচ্ছে। অথচ এই সফরে ৩ ম্যাচে তো পেয়েছেন মাত্র ৪টি উইকেট..,

ডেক্সটার: ফিল অবশ্যই ম্যাচ উইনার। এরই মধ্যে ইংল্যান্ডকে ৩টি টেস্ট জিতিয়েছে ও। খুব বেশি বোলারের এই কৃতিত্ব নেই। ওভালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ জিতিয়েছে, এরপর নিউজিল্যান্ড সফরে নিশ্চিত ড্রয়ের দিকে এগোচ্ছে, এমন একটি ম্যাচকে ইংল্যান্ডের জয়ে পরিণত করেছে ও। এই সফরে এখনো তাঁর সেরাটা দেখা যায়নি। তবে মনে রাখা দরকার, স্পিনাররা তাদের আসল সামর্থ্য দেখানোর সুযোগ পায় পাঁচ দিনের ম্যাচে। কারণ তিন দিনের ম্যাচে ব্যাটসম্যানরা জানে, বড় জোর পাঁচ ঘন্টার ইনিংস এটা। তাই চোখ বুঁজে মার শুরু করে স্পিনারদের। কিন্তু টেস্টে 'মারব কি মারব না' এই করতে করতে অবস্থাটা হয়ে যায় অন্যরকম।

শুভ্র: ইয়ান সলসবুরি টিমে এসেছেন অদ্ভুতভাবে। নেট বোলার হিসেবে আনা হয়েছিল, এখন তো তিনি টেস্ট স্কোয়াডেই ঢুকে গেছেন, কীভাবে এটা সম্ভব হলো?

ডেক্সটার: দেরিতে হলেও নির্বাচকেরা মনে করেছে, ওকে দরকার।

শুভ্র: ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা স্পিন খুবই ভালো খেলে। সে ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ স্যালিসবুরিকে ওদের সামনে ঠেলে দেয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?

ডেক্সটার: সলসবুরি তাঁর প্রথম টেস্ট খেলেছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে, লর্ডসে। পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরাও খুব ভালো খেলে স্পিনে। তারপরও মিয়াঁদাদ আর মালিকের মতো ব্যাটসম্যানকে আউট করেছে ও।

যখন নিজে খেলতেন

শুভ্র: গ্রায়েম হিকের জন্যে এই সিরিজটা বোধ হয় অগ্নিপরীক্ষা। ব্যাটসম্যান হিসেবে আপনি কি তাঁকে ওভাররেটেড মনে করেন?

ডেক্সটার: টেস্ট ক্রিকেটে নেমেই সবাই সাফল্য পায় না। তবে হিক নিঃসন্দেহে খুব ট্যালেন্টেড ব্যাটসম্যান। টেস্টে নামার আগেই ওর মতো রান করেনি কেউ ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে। এদিক থেকে ও ইউনিক। টেস্টে মানিয়ে নিতে একটু বেশি সময় নিচ্ছে, এই যা।

শুভ্র: গ্যাটিংকে এই সিরিজের জন্যে সিলেকশন কমিটিতে নেয়া হয়েছে। এটাকে খুব তাৎপর্যবহ মনে করছেন অনেকে।

ডেক্সটার: এটা ভুল কিছুই নয়। সিনিয়র প্লেয়াররা সিলেকশন কমিটিতে থাকেই।

শুভ্র: আগামী অ্যাশেজ সিরিজই অধিনায়ক গ্রাহাম গুচের শেষ সিরিজ হবার কথা। এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

ডেক্সটার: এটা নির্ভর করছে তার ওপরই। তবে আমরা এরপরও তাকে দলে পেতে চাইব। এখনো দারুণ খেলছে সে। তরুণতর কেউ তো দলে তার জায়গাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছে না।

শুভ্র: থার্ড আম্পায়ার পদ্ধতি সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

ডেক্সটার: আমি এটাকে আদর্শ পদ্ধতি মনে করি না। তবে দক্ষিণ আফ্রিকানরা ভ্রান্তি এড়াতে যা করেছে, আমি তার বিপক্ষেও নই। এখন তো হর্স রেসিংয়েও ব্যবহৃত হচ্ছে প্রযুক্তির। টেনিসে লাইন কলের জন্যেও।

শুভ্র: আপনার খেলোয়াড়ি জীবনে হল, গিলক্রিস্টদের মতো ফাস্ট বোলারদের খেলেছেন আপনি। তখন বাউন্সার সম্পর্কে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। কিন্তু এখন ওভারে একাধিক বাউন্সার দেওয়াই বেআইনি। আপনি কি মনে করেন না, ব্যাটসম্যানদের কথাই বেশি ভাবা হচ্ছে এখন?

ডেক্সটার: আমি এই রেস্ট্রিকশনের সমর্থক। আগে এটা দরকার ছিল না। কারণ সবাই ক্রিকেটের ট্র‍্যাডিশনে বিশ্বাস করত। নতুন এই আইন ফিরিয়ে এনেছে তা। তাছাড়া নতুন এই আইন বোলারদের কার্যকারিতা কমায়নি একটুও। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে ইতোমধ্যে ২০ উইকেট নিয়েছে অ্যামব্রোস। পাকিস্তানি জুটিও (ওয়াসিম-ওয়াকার) উইকেট পাচ্ছে নিয়মিত। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভালো বোলিং করেছে ডোনাল্ড। হাই ক্লাস ফাস্ট বোলিং! বোলাররা ব্যাটসম্যানদের চেয়ে স্টাম্পে আঘাত করায় মনোযোগ দিচ্ছে বেশি। আমি জানি, নতুন আইন পছন্দ নয় অনেকের। কিন্তু আমার মতে, এর আগে যা হচ্ছিল (শর্ট পিচ বোলিং), তা ছিল অগ্রহণযোগ্য। ফাস্ট বোলাররা সাফল্য পাচ্ছে এখনো, এতেই প্রমাণ হয়, ভালো কাজ করছে নতুন আইন।

পুল করছেন ডেক্সটার

শুভ্র: ফাস্ট বোলারদের কথা যখন উঠলই, জিজ্ঞেস করা যাক বল ডক্টরিং সম্পর্কে। আপনি কি বিশ্বাস করেন, বল পরিচর্যার মাধ্যমে বেশি বা কম সুইং করানো সম্ভব?

ডেক্সটার: কথা হলো, এখন যেভাবে পুরোনো বলে সুইং করানো হচ্ছে, এটা আগে দেখিনি আমরা এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি জানিও না, কীভাবে এটা করানো হয়। সুইং অবশ্যই ভালো জিনিস, কিন্তু একই সঙ্গে বল নিয়ে কিছু করাটাও নিয়মবহির্ভূত। তাই এমন কিছু করা হলে তা ক্রিকেটের আইন বিরোধী।

শুভ্র: ম্যানেজমেন্টের অংশ হিসেবে নয়, সাবেক টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে আপনাকে এই প্রশ্ন করছি। আপনি কি মনে করেন, পাকিস্তানের গত ইংল্যান্ড সফরে বল ডক্টরিং-য়ের ঘটনা ঘটেছিল?

ডেক্সটার: এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না। আমি তো আর মাঠে ছিলাম না।

শুভ্র: কিন্তু ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা, যেমন অ্যালান ল্যাম্ব তো এমন অভিযোগ করেছেন…

ডেক্সটার: যারা এ ধরনের অভিযোগ করেছে, তাদেরকেই মোটা অংকের জরিমানা করেছে টিসিসিবি (তখনকার ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের নাম)। এ থেকেই বোর্ডের প্রতিক্রিয়া বোঝা যায়। তবে এসব ঘটনার পর বলের অবস্থা সম্পর্কে আরও সচেতন হয়েছি আমরা। আগামী মৌসুম থেকে আম্পায়ারদের বলা হবে যত বেশি সম্ভব বল পরীক্ষা করতে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×