ফিক্সিং নিয়ে রমিজ রাজার সাক্ষাৎকার

‘রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করব’

উৎপল শুভ্র

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

‘রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করব’

রমিজ রাজা ও কলঙ্কিত তিন

নৈতিকতাকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে এসেছেন বলেই ফিক্সিং অধ্যুষিত পাকিস্তান দলে খেলেও কোনো কালিমা লাগেনি তাঁর গায়ে। ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত ক্রিকেটারদের ব্যাপারেও অবস্থান একেবারে পরিষ্কার। এ নিয়েই রমিজ রাজার এই ইন্টারভিউয়ের দুটি পর্ব। ২০১১ সালের মার্চে প্রথম পর্ব মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ আসিফ ও সালমান বাটের স্পট ফিক্সিং নিয়ে। ডিসেম্বরে যখন আবার কথা বলি, এই তিনজনই তখন জেলে। যাতে খুশিই হয়েছিলেন রমিজ রাজা।

উৎপল শুভ্র: দুই প্রান্ত থেকে আসিফ-আমিরকে বোলিং করতে দেখাটা ছিল দারুণ এক অভিজ্ঞতা। ওদের এই পরিণতি দেখে আপনার খারাপ লাগে না?

রমিজ রাজা: না, আমার একটুও খারাপ লাগে না। অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হবে, সভ্য জগতের এটাই রীতি। পাকিস্তানের ক্রিকেটে এটাই সমস্যা। অতীতে বড় বড় তারকারা ছাড় পেয়ে গেছে ওরা গ্রেট ক্রিকেটার বলে। এ কারণেই ১৫-১৬ বছর পর সেই একই সমস্যা আবার আমাদের আক্রান্ত করেছে। যদি আপনি এটাকে অন্যায় মনে করেন, এ ব্যাপারে একটুও ছাড় দেওয়া যাবে না। আমি বিশ্বাস করি, অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে। বিশেষ করে ক্রিকেটে...কারণ আপনি রোল মডেল। আপনি দেশের রাষ্ট্রদূত। এত দিন খেলে, এত দেশ ঘুরে কারও ন্যায়-অন্যায় না বুঝতে পারার কোনো কারণ নেই।

শুভ্র: আপনি তো পাকিস্তান ক্রিকেটের সবচেয়ে অন্ধকার সময়টায় খেলেছেন। নব্বই দশকের ওই দলের হাতেগোনা দু-তিনজন খেলোয়াড়ের গায়েই শুধু কালি লাগেনি। আপনি তাঁদের একজন। কীভাবে এটি সম্ভব হলো?

রমিজ: ওদের সঙ্গে আমার খুব একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। ওদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল পেশাদারি, ৯টা-৫টা, এরপর আমি আমার নিজের বন্ধুমহলে চলে যেতাম। আমার বন্ধুরা ছিল আলাদা। থ্যাংক গড, ওদের কারও সঙ্গেই আমার সে রকম বন্ধুত্ব হয়নি। এ জন্য আমাকে মূল্যও দিতে হয়েছে। কারণ যখন আপনি দলছুট থাকবেন, নানাভাবে আপনাকে ভুগতে হবে। তবে যখন পেছন ফিরে তাকাই, এখন কোথায় আছি ভাবি, সে জন্য আমার কোনো অনুতাপ হয় না।আমিরের সেই নো বল। ছবি: এএফপি

শুভ্র: কিন্তু ওই দলে কুকীর্তিতে জড়িত ওই সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলাটা কতটা কঠিন ছিল?

রমিজ: আমি আসলে বোকার স্বর্গে বাস করছিলাম। ড্রেসিংরুমে আমিই একমাত্র কণ্ঠস্বর ছিলাম, যে কিনা বলে গেছে তোমরা সবাই নিষ্পাপ, আমি তোমাদের বিশ্বাস করি। এত কিছু যে হয়ে যাচ্ছে, আমার কোনো ধারণাই ছিল না। আমি এসব জানতে পেরেছি পরে...যখন তদন্ত শুরু হলো, ওদের অনেকে আমার কাছে এসে সব স্বীকার করল। তখন অতীতের অনেক ম্যাচের দিকে তাকিয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে অনেক কিছুই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

শুভ্র: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা (রমিজ রাজা ব্যবসায় প্রশাসনে মাস্টার্স করেছেন) কি আপনাকে সৎ থাকতে সাহায্য করেছে?

রমিজ: শিক্ষা তো অবশ্যই একটা ব্যাপার। আসলে শিক্ষা জিনিসটা কী...এটা যেকোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা খুঁজে পেতে সাহায্য করে। কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক, এটা শেখায়। প্রতিনিয়তই আপনাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে জায়গায়...ক্যারিয়ারে, বাড়িতে, এমনকি কিছু কেনার সময় এই ব্র্যান্ড কিনবেন না, ওই ব্র্যান্ড...আপনি প্রশ্ন করে বিশ্লেষণ করেন এবং একটা উত্তর খুঁজে নেন। এই বিশ্লেষণী ক্ষমতাঁটা বারবার প্রয়োগ করলে বেশির ভাগ সময়ই আপনি সঠিক সিদ্ধান্তটা নেবেন। আমি এটাকেই শিক্ষার মূল উপযোগিতা দেখি।

ততদিনে মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ আসিফ ও সালমান বাটের জেল হয়ে গেছে। রমিজ রাজার সঙ্গে কথা শুরু হয়েছিল এ নিয়েই।

শুভ্র: কোনো দিন দূর কল্পনাতেও কি ভেবেছিলেন, ফিক্সিংয়ের দায়ে কোনো ক্রিকেটারকে জেলে যেতে হবে?

রমিজ: এটা দুর্ভাগ্যজনক। তবে এমন কিছু যে হতে যাচ্ছে, এটা অনুমিতই ছিল। আগে একটা কথা বলে নিই, ওদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। উল্টো ওদের কী নামে ডাকা উচিত, আমি ভাষা খুঁজে পাই না। মূর্খ, বখাটে, দেশবিরোধী... ওরা দেশের কথা ভাবেনি, দেশের ভাবমূর্তির কথা ভাবেনি, খেলাটার চেতনার কথা ভাবেনি। বাট-আসিফ-আমিরের জেলে যাওয়াটাকে আমি দেখি 'যেমন কর্ম তেমন ফল'-এর আদর্শ উদাহরণ।

শুভ্র: খেলায় প্রতারণা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার আইনটা ইংল্যান্ডে খুব বেশি দিন আগে হয়নি। আপনার কি মনে হয়, অন্য সব ক্রিকেট খেলুড়ে দেশেও এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা উচিত?

রমিজ: অন্য কোনো দেশের কথা বলা কঠিন। একেক দেশের একেক নীতি, এই ব্যাপারটাকে সর্বজনীন করা কঠিন। তবে ক্রিকেট বিশ্বের অবশ্যই এ নিয়ে ভাবা উচিত। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বোর্ড পর্যায়ে বা আইসিসি পর্যায়ে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত।

শুভ্র: কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে যা হলো, সেটি তো ক্রিকেটীয় ট্র্যাজেডি। বিশেষ করে আসিফ-আমিরের মতো গ্রেট প্লেয়ারকে হারানোটা তো ক্রিকেটেরও ক্ষতি...

রমিজ: এই কথাটাতে আমার আপত্তি আছে। আপনি ওদের গ্রেট ক্রিকেটার্স বলবেন, না চোর বলবেন, প্রতারক বলবেন? এই দুটিকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। অতীতে আমরা এই ভুলটাই করেছি। চোরদেরও কিংবদন্তি হিসেবে দেখেছি। আইসিসিও তাদের অনেককে উচ্চ আসনে বসিয়ে বৈধতা দিয়ে দিয়েছে। তবে আমার চোখে ওরা সবসময় চোরই থাকবে। আমার মূল্যবোধের ধারণাটা অন্য রকম। যখন আমি জানব, আমি যে ম্যাচটা জেতার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছি, সেই ম্যাচটাই কেউ হারার চেষ্টা করেছে, আমি তো রাগে অন্ধ হয়ে যাব। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। আমার জীবন দর্শন, সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে অভিজ্ঞতা, এরপর নানা ভূমিকায় খেলাটির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা—সবকিছু মিলিয়ে ওদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। আমি মনে করি, এখানে ক্রিকেটিং ব্যাপারটা কোনো বিবেচনাই নয়। ওদের প্রতারক হিসেবে দেখতে হবে, ক্রিমিনাল হিসেবে দেখতে হবে। আমার চোখে চিরদিন ওরা ক্রিমিনালই থাকবে।

শুভ্র: মোহাম্মদ আমিরের ক্ষেত্রে অনেকে একটু ছাড় দিতে চান। বয়স কম, সহজ-সরল এসব যুক্তি দেওয়া হয়। আপনি কী মনে করেন?

রমিজ: না, আমিরের প্রতিও আমার কোনো সহানুভূতি নেই। হ্যাঁ, অনেককে বলতে শুনি, ওর বয়স খুব কম, ও বুঝতে পারেনি, ওকে এসবে জড়ানো হয়েছে। আমি একদমই তা মনে করি না। ও দুই বছর দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছে, ওর এসব না বোঝার কথা নয়। অনেকে ক্রিকেট বোর্ডকে দোষ দেয়, আমার এতেও আপত্তি আছে। তুমি চুরি কোরো না, প্রতারণা কোরো না, অসৎ হয়ো না, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, এমন কিছু কোরো না—এসব কি ক্রিকেট বোর্ড আপনাকে বলে দেবে? এসব বাড়িতে শেখানো হয়, স্কুলে শেখানো হয়। ক্রিকেট বোর্ড ঠিকমতো আমাদের এসব শিখিয়ে-পড়িয়ে দেয়নি, এসব বললে তা হবে ফালতু। আমির যদি বোলিং করতে পারে, কীভাবে উইকেট নিতে হয় জানে, এত গ্রেট বোলারই হয়ে থাকে, তাহলে বিশ্ব ক্রিকেটের শীর্ষস্থানীয় একজন বোলার হিসেবে নিজের দায়িত্বটাও তাঁর জানা উচিত ছিল।

শুভ্র: আপনার কথার সঙ্গে একমত হয়েও একটা প্রশ্ন করি। ক্রিকেটারেরা তো সমাজেরই অংশ। আমাদের সমাজে সর্বস্তরে দুর্নীতি, ,ক্রিকেটারেরা ব্যতিক্রম হবেন—এই আশা করাটা কি বাড়াবাড়ি নয়?

রমিজ: দেখুন, টু রংস্ ডোন্ট মেক ইট রাইট। কেউ যদি টাকা চুরি করে, কেউ যদি ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন না করে, তার মানে এই নয় যে, আপনিও তাকে অনুকরণ করবেন। সমাজে ভালো-মন্দ দুই ধরনের মানুষই আছে। আপনাকেই ঠিক করতে হবে, কাকে অনুসরণ করবেন, কাকে করবেন না। অন্যরা চুরি করছে, অন্যরা খারাপ, তাই আমিও তা-ই করব, এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না।

শুভ্র: আসলে খেলাটা আমাদের একটা চূড়ান্ত বিশ্বাসের জায়গা। নইলে মন্ত্রীরা ঘুষ খায় জেনেও আমরা অতটা বিচলিত হই না, যতটা বিচলিত হই কোনো ক্রিকেটার ইচ্ছা করে একটা নো বল করলে...

রমিজ: একদম ঠিক কথা বলেছেন। ক্রীড়াবিদেরা...আমি যদি শুধু ক্রিকেটারদের কথাই বলি, তারা কিন্তু খুব স্বচ্ছ একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উঠে আসে। যদি কেউ রাজনৈতিক কারণে নির্বাচিত হয়ে দলে ঢুকেও পড়ে, কোনো লাভ কিন্তু নেই। বছর না ঘুরতেই সমর্থকেরা তাকে দল থেকে বের করে দেবে। কারণ সে যোগ্য না হলে পারফর্ম করতে পারবে না, পারফর্ম না করতে পারলে বাদ পড়তেই হবে। এমন একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উঠে আসা ক্রিকেটারেরা যখন চোর হিসেবে প্রমাণিত হয়, তখন সেটি আরও বেশি বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। কারণ ক্রিকেটীয় সিস্টেম তো আপনাকে প্রতারণা করতে শেখায় না। এই সিস্টেম এমন স্বচ্ছ, এমন আদর্শ, এমন সৎ যে খেলাটিতে এমন সব খেলোয়াড় কীভাবে তৈরি হয়, সেটিই আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়।

শুভ্র: বাট-আসিফ-আমিরদের জেলে যাওয়াটা তো ক্রিকেট বিশ্বেরই লজ্জা। কিন্তু একজন পাকিস্তানি হিসেবে আপনি কি আরও লজ্জা বোধ করেন না?

রমিজ: অবশ্যই করি। তবে আমাদের এই লজ্জা স্বীকার করতে হবে। উট পাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে অসৎ কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করাটা হবে আত্মঘাতী। আমরা অনেক সময় দেশের সম্মানের কথা ভেবে খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি, অনেক অপরাধ চাপা দিতে চাই। উল্টো আমাদের উচিত নিজেদের ভুল স্বীকার করা। আমাদের ক্রিকেটে আমাদের সমাজে বিদ্যমান এ ধরনের  সমস্যা এ ধরনের অপরাধীদের মোকাবিলা করা। আমি যেমন লজ্জিত, তেমনি প্রকাশ্যে বলতেও কোনো দ্বিধা নেই যে, ওরা ক্রিমিনাল। ওদের জেল খাটতে দেখাটা আমার কাছে বরং খুব তৃপ্তিদায়ক।

কলঙ্কিত তিন: মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ আসিফ ও সালমান বাট

শুভ্র: একটু আগে যে আপনি বললেন, আইসিসি অনেক অপরাধীকে উচ্চ আসনে বসিয়ে বৈধতা দিয়েছে। এটা কি ওয়াসিম আকরামের ‘হল অব ফেমে' স্থান পাওয়াকে ইঙ্গিত করে?

রমিজ: না, আমি কারও নাম বলতে চাই না। কারণ আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। তবে কাইয়ুম তদন্ত কমিশনের কথা সবাই জানে এবং তাতে যারা অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিল, তারা যে অল্পের ওপর দিয়ে পার পেয়ে গেছে, এটাও সবার জানা। শুধু পাকিস্তানই বা কেন, অন্য দেশেও এমন অনেক উদাহরণ আছে...

শুভ্র: অস্ট্রেলিয়ায় যেমন মার্ক ওয়াহ, শেন ওয়ার্ন....

রমিজ: আগেই তো বললাম, আমি কোনো নাম বলব না। আমি যা বলতে চাই, তা হলো এই সমস্যাকে সমূলে উৎপাটন করতে ক্রিকেট সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কেউ যদি অনৈতিক কিছু করে, তাহলে 'ও ক্রিকেটিং গ্রেট' এ কথা বলে চোখ বুজে থাকলে চলবে না। হয় তাঁকে ক্রিকেটিং গ্রেট হিসেবে বিবেচনা করে ওর অপরাধের কথা ভুলে যাও; নয়তো শুধুই ক্রিমিনাল হিসেবে বিবেচনা করো, ক্রিকেট ভুলে যাও।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×