‘হ্যাডলি-ক্রোর সময়ে খেলেছি বলে নিজেকে ভাগ্যবান মানি’

উৎপল শুভ্র

২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

‘হ্যাডলি-ক্রোর সময়ে খেলেছি বলে নিজেকে ভাগ্যবান মানি’

ইয়ান স্মিথ

প্রায় এক যুগের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে প্রায় তিন দশক আগে। এখনো অটুট তাঁর একটি বিশ্ব রেকর্ড। ১৯৯০ সালে অকল্যান্ডে ১৩১ রানে ৭ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ব্যাটিং করতে নেমে করেছিলেন ১৩৬ বলে ১৭৩ রান। এখনো যা টেস্ট ক্রিকেটে ৯ নম্বর ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। রিচার্ড হ্যাডলির বলে উইকেটকিপিং করেছেন। খেলেছেন মার্টিন ক্রোর সঙ্গেও। হ্যামিল্টনে নেওয়া এই ইন্টারভিউটা ছিল বোলিং-ব্যাটিংয়ে এই দুই কিউই গ্রেটকে নিয়েই।

প্রথম প্রকাশ: ২ মার্চ ২০১৯। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: আমি নিশ্চিত, এই প্রশ্নটার উত্তর আপনি কয়েক হাজারবার দিয়েছেন, তারপরও জিজ্ঞেস করছি—রিচার্ড হ্যাডলির বলে কিপিং করার অভিজ্ঞতা কেমন?

ইয়ান স্মিথ: আসলেই অনেকবার এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। প্রথমেই আমি যেটি বলি, এটা ছিল দারুণ সম্মান। অনেক বড় চ্যালেঞ্জও। কারণ রিচার্ড এমন দারুণ একজন বোলার ছিলেন যে, প্রতিটি বলেই কিছু না কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। নতুন বলে কিপিং করাটা আরও কঠিন ছিল, কারণ তাঁর বল পড়ত সিমের ওপর। আমার মনে হতো, আমি যেন মঞ্চের সামনে সেরা আসনটায় বসে দারুণ কিছু দেখছি। আমি গর্বিত যে, রিচার্ড হ্যাডলির সময়ে খেলেছি। রিচার্ড হ্যাডলি ছিলেন আপাদমস্তক একজন পারফেকশনিস্ট। ঘড়ির কাঁটা ১২টার সময় যেমন থাকে, বলের ওপর তাঁর দুই আঙুল তেমন থাকত। মাঝেমধ্যে আমাকে বলতেন, ‘আজ মনে হয়, ১২টা না হয়ে ১টার মতো হচ্ছে। একটু খেয়াল করে বলো তো।’ ওই গতিতে, অত নিখুঁত বোলিংয়ে তাঁর হাতের দিকে নজর রেখে কিপিং করা, ভাবুন একবার! (হাসি)। ধারাবাহিকতা আর পেশাদারত্বের আদর্শ এক উদাহরণ ছিলেন হ্যাডলি, সেটার ফলও পেয়েছেন। হ্যাডলির বলে আমি ৪৪টি ক্যাচ নিয়েছি, যা তাঁর টেস্ট উইকেটের প্রায় ১০ শতাংশ। এটা ভেবে আমার খুব ভালো লাগে।

শুভ্র: আপনি যেমন বললেন, সবচেয়ে ভালো আসনটা থেকে হ্যাডলির বোলিং দেখেছেন। কী তাঁকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছিল?

স্মিথ: রিদম! আমি সবার আগে রিদমের কথাই বলব। আর বলব ক্ষুরধার মস্তিষ্কের কথা। রিচার্ড হ্যাডলি বাউন্সারও দিতে পারতেন, কিন্তু বলতে গেলে দিতেনই না। বাউন্সারে ব্যাটসম্যানকে আউট করার সত্যিকার সুযোগ থাকলেই তিনি তা করতেন। তার মূল শক্তি ছিল সোজা বল করা। রিচার্ড হ্যাডলির বোলিং মানে লাইন, লেংথ আর অ্যাকুরেসি। আর ছিল মাথা। বোলিং রানআপ কমিয়ে ফেলে প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে এনেছিলেন। গতি কিন্তু তেমনই ছিল। সঙ্গে ছন্দ আর প্রায় নিখুঁত ওই বোলিং অ্যাকশন। 

শুভ্র: ওই সময়টাতে বিশ্ব ক্রিকেটে অসাধারণ সব ফাস্ট বোলার ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে তুলনায় হ্যাডলিকে কোথায় রাখবেন? 

স্মিথ: ঠিকই বলছেন। কী একটা সময় ছিল! ওয়েস্ট ইন্ডিজে গার্নার, হোল্ডিং, মার্শাল, রবার্টস; অস্ট্রেলিয়ায় লিলি আর টমসন, অল্ডারম্যান, র‍্যাকেম্যান, হগ; ইংল্যান্ড বোথাম-উইলিস, পাকিস্তানে ইমরান খান...যুগটাই ছিল বিশ্বের ফাস্ট বোলারদের। অলরাউন্ডারদেরও। আমার মনে হয়, তিনি অন্য যে কারও সমকক্ষ। গ্রেট ফাস্ট বোলারদের ওই যুগে তাঁর রেকর্ড দেখুন। তার ওপর যখন মনে রাখবেন, অন্য প্রান্তে তাঁকে সাহায্য করার মতো জেনুইন কোনো ফাস্ট বোলার ছিল না, তখন তাঁর মহিমা আরও বেশি বেড়ে যায়।

মাঠের সেরা আসনে `বসে` রিচার্ড হ্যাডলির বোলিং দেখতে পেরেছেন বলে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবেন ইয়ান স্মিথ

শুভ্র: হ্যাডলির এত সব পারফরম্যান্সের মধ্যে ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে নিউজিল্যান্ডের প্রথম জয়ে ১৫ উইকেটকেই কি সেরা? প্রথম ইনিংসে ৯ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ৬...

স্মিথ: তাঁকে ওই মানের বোলিং করতে অনেকবারই দেখেছি। হয়তো সেসবের পুরস্কার পাননি। গ্যাবার উইকেট বোলারবান্ধব ছিল। তবে সেই কন্ডিশনের তিনি সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছিলেন, অন্যরা যা পারেনি। বোলিংও করেছিলেন অনেক গতিতে। সেদিন আমার একটাও ক্যাচ ছিল না। কিন্তু হয়তো ছয় বলে চার-পাঁচবারই বল ব্যাট বিট করে আমার গ্লাভসে আসছিল। অসাধারণ বোলিং!

শুভ্র: মার্টিন ক্রোও সেই টেস্টে ১৮৮ করেছিলেন। ব্যাটিং-বোলিংয়ে দুই গ্রেট মিলে নিউজিল্যান্ডের সেরাটাই দেখিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন, তাই না?

স্মিথ: হ্যাঁ। এখন পর্যন্ত নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের দুজন সেরা খেলোয়াড় একসঙ্গে নিজেদের শিল্পের সর্বোচ্চ প্রদর্শনী রেখেছেন। এর বেশি কিছু আর কী চাইতে পারেন! আমার মনে হয়, হ্যাডলি ৯ উইকেট পাওয়ার পরই ক্রো মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, আমাদের বড় স্কোর করতে হবে, এই টেস্ট জিততে হবে, হ্যাডলির ৯ উইকেট পারফরম্যান্সের সঙ্গে মিল রেখে কিছু করতে হবে। পরের দিন পত্রিকায় রিচার্ড হ্যাডলিই সব শিরোনাম নিয়ে নিয়েছেন, সেটাই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মার্টিন ক্রোর ১৮৮-ও একই রকম পেশাদার ও দেখতে একই রকম আকর্ষণীয় ছিল। 

শুভ্র: এই ১৮৮-কেই কি মার্টিন ক্রোর সেরা ইনিংস মনে করেন, নাকি ওয়েলিংটনের ২৯৯?

স্মিথ: ২৯৯ অসাধারণ ছিল। কারণ ওই টেস্টে হার এড়াতে আমাদের ওই রানের ভীষণ দরকার ছিল। ওকে ব্রিসবেন টেস্টের সাত মাস আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও ১৮৮ করতে দেখেছি। ব্রিলিয়ান্ট, অ্যাবসলিউটলি ব্রিলিয়ান্ট। বৈরী কন্ডিশনে দারুণ বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ওকে অনেক খেটেখুটে ৬০-৭০ করতেও দেখেছি। (বোলিংয়ে) হ্যাডলি যা ছিলেন, আমাদের জন্য (ব্যাটিংয়ে) সে-ও ছিল তেমন। 

শুভ্র: দুজনকেই তো খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁদের প্রস্তুতিতে কোনো মিল কি ছিল? 

স্মিথ: প্র্যাকটিসকে দুজনই খুব সিরিয়াসলি নিত। নেটে রিচার্ড হ্যাডলির মুখোমুখি হওয়াটা মার্টিন ক্রোর খুব পছন্দ ছিল। আর নেটে হ্যাডলিকে খেলার চেয়ে ভালো প্রস্তুতি তো আর হয় না। হ্যাডলির বলে নেটেও আউট না হওয়া ছিল গর্ব করার মতো ব্যাপার। একইভাবে হ্যাডলি চাইতেন নেটে ব্যাটসম্যানদের আউট করতে। সেটা তাঁকে আত্মবিশ্বাস জোগাত। ওই নেট সেশনগুলোই দুজনকে ভালো পারফরম্যান্সের জন্য প্রস্তুত করে দিত। আসলে দুজনই এমন অসাধারণ ক্রিকেটার যে, ওই সময়ে খেলেছি বলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মানি।   

মার্টিন ক্রোকেই নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবার উপরে রাখেন ইয়ান স্মিথ

শুভ্র: মার্টিন ক্রোই কি আপনার চোখে নিউজিল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান? 

স্মিথ: আমার তা-ই মনে হয়। সংখ্যা হয়তো আর সেটা বলে না। এখনই কেন উইলিয়ামসন ও রস টেলর এগিয়ে গেছে। যত দিনে শেষ করবে, আরও অনেক এগিয়ে যাবে। কিন্তু এই সময়ের দলগুলোর বোলিংয়ের সঙ্গে তখনকার বোলিংয়ের তুলনাই চলে না। কন্ডিশন, সরঞ্জাম, ব্যাট এসবও আসে। তবে আমি মার্টিন ক্রোকে সব সময়ই সবচেয়ে উঁচুতে বসিয়ে রাখব। ওয়াসিম আকরামের মতো বোলার তো আর এমনিতেই বলেনি, ও যাঁদের বিপক্ষে বল করেছে, তাঁদের মধ্যে ক্রো-ই সেরা।

শুভ্র: মার্টিন ক্রোর মৃত্যু পুরো ক্রিকেট–বিশ্বকেই দুঃখে ভাসিয়েছে। তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু হওয়ায় আপনার দুঃখটা তো আরও বেশি। সময় কি সেই দুঃখে একটু প্রলেপ দিতে পেরেছে?

স্মিথ: ওর কথা প্রায়ই মনে পড়ে। ক্রিকেট মাঠে তো সব সময়ই। কারও খেলা দেখলে হয়তো মনে হয়, আরে, অনেকটা ওর মতো। কখনো–বা কোনো রেকর্ডের প্রসঙ্গে ওর নাম টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে। মার্টিন ক্রোর সঙ্গে অনেকবার একই রুমে থেকেছি, বিশ্বজুড়ে খেলেছি। কারও পক্ষেই ওকে ভোলা সম্ভব নয়। ওর ট্রেডমার্ক শটগুলো এখনো আমার চোখ ভাসে। মাটি কামড়ানো কাভার ড্রাইভ, অন ড্রাইভ...সুন্দর সব শট। মার্টিন ক্রো সুন্দর সব শট খেলত। ওর ব্যাটে সবই খুব সুন্দর লাগত। 

শুভ্র: ক্রিকেট নিয়ে চিন্তাভাবনাতেও তো ক্রো অনন্য ছিলেন। সব সময় নতুন কিছু ভাবতেন...

স্মিথ: আসলে ক্রিকেটটা ওর হৃদয়ে ছিল, মস্তিষ্কে ছিল। ১৯৯২ বিশ্বকাপে দীপক প্যাটেলকে দিয়ে ওপেন করিয়ে কেমন চমকে দিয়েছিল সবাইকে! খেলা ছাড়ার পর ধারাভাষ্যকার হলো। একসময় স্কাই ক্রিকেটের নির্বাহী প্রযোজক। সেখানেও নিজের উদ্ভাবনী চিন্তার ছাপ রেখেছিল। ও মানুষকে বিনোদন দিতে চেয়েছিল। ও সব সময় চেয়েছে খেলাটা আরও এগিয়ে যাক। ১৯৯২ বিশ্বকাপে কী করল! অফ স্পিনার দীপক প্যাটেলকে দিয়ে বোলিং ওপেন করিয়ে চমকে দিল সবাইকে। ওর উদ্ভাবিত ক্রিকেট ম্যাক্সই তো বলতে গেলে টি-টোয়েন্টির পূর্বসূরি।

ইয়ান স্মিথ
নিউজিল্যান্ড (১৯৮০–৯২)

  ম্যাচ  রান সর্বোচ্চ গড় ১০০/৫০ ক্যাচ স্টাম্পিং
টেস্ট  ৬৩ ১৮১৫ ১৭৩ ২৫.৫৬ ২/৬ ১৬৮ 
ওয়ানডে ৯৮ ১০৫৫ ৬২* ১৭.২৯ ০/৩  ৮১

   
 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×