‘অনেক গ্রেট প্লেয়ারও এক সিরিজে পাঁচ-ছয়টা শূন্য মেরেছে’

উৎপল শুভ্র

২১ জুন ২০২১

‘অনেক গ্রেট প্লেয়ারও এক সিরিজে পাঁচ-ছয়টা শূন্য মেরেছে’

ইনজামাম-উল হক। ছবি: গেটি ইমেজেস

ইনজামামের বেশ কয়েকটা ইন্টারভিউ করেছি, এর মধ্যে এটা ব্যতিক্রমী। ইনজামামের তখন ঘাের দুঃসময়। বিশ্বকাপে শােচনীয় ব্যর্থতার পর মাত্রই দলে ফিরেছেন। করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিসের পর যখন কথা বলছি, পরদিন বাংলাদেশের বিপক্ষে কামব্যাক টেস্ট এবং ইনজামামকে তুমুল নার্ভাস দেখাচ্ছে। পরদিন, মানে টেস্টের প্রথম দিন পত্রিকার জন্য যখন ইন্টারভিউটা লিখছি, তখনই ইনজামাম শূন্য রানে আউট! কানে বাজছিল ইনজামামের কথাটা, ফর্মে থাকলে অস্ট্রেলিয়াও কোনাে ব্যাপার না, আর ফর্মে না থাকলে বাংলাদেশও খুব কঠিন। সিরিজ শেষ হওয়ার আগেই অবশ্য নাটকীয় পটপরিবর্তনে ইনজামাম পাকিস্তানের অধিনায়ক!

প্রথম প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০০৩। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র : এটা তাে আপনার কামব্যাক সিরিজ। বড় এক চ্যালেঞ্জ...

ইনজামাম-উল হক : হ্যা, এটাই আমার প্রথম কামব্যাক। ১৩ বছর ধরে খেলছি, এর আগে কোনাে দিন বাদ পড়িনি। আমি তাই চাপও অনুভব করছি। তবে সবকিছু সামলে আমি আবার খুব ভালাে পারফর্ম করার চেষ্টা করব।

শুভ্র : বিশ্বকাপে পারফরম্যান্সই (৬ ইনিংসে ১৯ রান) তাে আপনার দল থেকে বাদ পড়ার কারণ। প্রায় ছয় মাস পর এখন যখন পেছনে ফিরে বিশ্বকাপের দিকে তাকান, তখন কী মনে হয়? এমন খারাপ সময় তাে আপনার ক্যারিয়ারে আর আসেনি।

ইনজামাম : তা আসেনি। তবে কথা হলাে, সবার জীবনেই কখনাে না কখনো এমন দুঃসময় আসে। অনেক গ্রেট প্লেয়ারও এক সিরিজে পাঁচ-ছয়টা শূন্য মেরেছে। আমার দুর্ভাগ্য হলাে, ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময়টা এল বড় একটা টুর্নামেন্টের সময়। শুধু তাে আমার ব্যাড প্যাচ নয়, আমার ব্যাড প্যাচটা হয়তাে বেশি ছিল, কিন্তু বিশ্বকাপে ব্যাড প্যাচ ছিল আমাদের পুরাে দলের। সাধারণত কী হয়, একজন-দুজন ব্যাটসম্যান খারাপ করলেও বাকিরা ভালাে করে তা বুঝতে দেয় না। কিন্তু বিশ্বকাপে আমাদের পুরাে ব্যাটিংই ফ্লপ করল, কেউই রান করতে পারেনি। তবে কোনাে প্লেয়ারের যেমন ব্যাড প্যাচ আসে, তেমনি দলেরও আসে, বিশ্বকাপে আমাদের তা-ই এসেছিল সেটি আর আমি মনে রাখতে চাই না, ছয় মাস চলে গেছে, আমি খােলা মনে আবার শুরু করতে চাই।

শুভ্র : '৯২-এর বিশ্বকাপই তাে আপনাকে তারকা বানিয়েছিল আর ২০০৩ বিশ্বকাপ এল দুঃস্বপ্নের রূপ নিয়ে। পুরােপুরিই দু রকম দুটি বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতাই হলাে আপনার।

ইনজামাম : কথা হলাে, আপনি যদি খারাপ জিনিস মনে নিয়ে বসে থাকেন, তাহলে ক্রিকেট খেলতে পারবেন না। একইভাবে, ভালাে করলে সেটিও আপনাকে ভুলে যেতে হবে। সেঞ্চুরি করার পর আপনি যদি সেটি নিয়েই বসে থাকেন, তাহলে ওই সেঞ্চুরিই আপনার শেষ সেঞ্চুরি হয়ে থাকবে। যা চলে গেছে, তা চলেই গেছে। ক্রিকেট হলাে প্রতিদিনের খেলা। একদিন ভালাে করেছেন, পরদিন খারাপও করতে পারেন। ভালাে-খারাপ যা-ই হােক, সব ভুলে গিয়ে আপনাকে নতুন দিন শুরু করতে হবে ।

২০০৩ বিশ্বকাপ খুব বাজে কেটেছিল ইনজামামের, দল থেকে বাদ পড়েছিলেন প্রথমবারের মতো। ছবি: গেটি ইমেজেস।

শুভ্র : বিশ্বকাপের সময় তাে আপনার ওজন কমানাে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অনেকে বলেছেন, হঠাৎ করে বেশি ওজন কমিয়ে ফেলানােই প্রভাব ফেলেছে আপনার ব্যাটিংয়ে!

ইনজামাম : ধুর, একদম ফালতু কথা। আমি তা মনে করি না। এমন তা নয় যে আমি ডায়েট করে ওজন কমিয়েছি, আমি ওজন কমিয়েছি ট্রেনিং করে। রান করতে পারিনি, সেটি অন্য ব্যাপার। ওজন কমানাের সঙ্গে এর কোনাে সম্পর্ক নেই।

শুভ্র : বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে অনেকেই দলে বেশি বয়সী থেলােয়াড়ের ভিড়কে দায়ী করেন। আপনার কী মত?

ইনজামাম : সিনিয়র প্লেয়ার তাে বিশ্বকাপের সময় দলে আসেনি। তারা বিশ্বকাপের আগের সিরিজেও দলে ছিল । যা-ই হােক, সিনিয়রদের কারও কারও যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল, তরুণদের নিয়ে নতুন করে শুরু করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে এখনই রেজাল্ট চাইলে হবে না। কেউ যদি ভাবে এক-দুই সিরিজে বা এক বছরে দল দাঁড়িয়ে যাবে, তাহলে ভুল হবে। কমপক্ষে দু-তিন বছর সময় দিতে হবে। আমি তাে মনে করি তরুণদের জন্য এটি দারুণ এক সুযােগ, বিশেষ করে ব্যাটসম্যানদের সৌভাগ্য যে মিয়াঁদাদ তাদের সঙ্গে আছেন।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ইনজামামের ৩২৯ রানের ইনিংসে ইনজামাম (বাঁয়ে), হানিফ মোহাম্মদের পর যা প্রথম কোনো পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানের ট্রিপল সেঞ্চুরি

শুভ্র : বাংলাদেশের বিপক্ষে এই সিরিজের আগে পাকিস্তানে সর্বশেষ যে টেস্টটি হয়েছে, সেটিতেই তাে আপনার ট্রিপল সেঞ্চুরি (নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে লাহােরে ৩২৯)। ব্রায়ান লারার ৩৭৫ রানের রেকর্ড ভাঙার স্বপ্ন কি কখনাে উঁকি দিয়েছিল মনে?

ইনজামাম : এসব জিনিস তাে আগে থেকে ভেবে করা যায় না। তবে তিন শ পার হওয়ার পর আমার মাথায় এসেছিল, এটি ৩৭৫ রানের রেকর্ড ভাঙার একটা সুযোগ। কিন্তু এর আগেই, আমি ২৯০-এর ঘরে থাকতেই শেষ ব্যাটসম্যান দানিশ (কানেরিয়া) উইকেটে এসে যায় বলে বাধ্য হয়েই আমাকে একটু চালিয়ে খেলতে হয়। আউটও হয়ে যাই সে কারণেই। আল্লাহ চাহে তাে আবার সুযােগ পাব।

জাভেদ মিয়াঁদাদ, সুনীল গাভাস্কার, অ্যালান বাের্ডাররা যা করেছেন, তার চেয়ে ভালাে করার লক্ষ্য কেন থাকবে না? লক্ষ্য বড় থাকলেই না বড় কিছু করা সম্ভব। শুধু ১০ হাজার রান কেন, আমি তাে ১২ হাজার রান করার স্বপ্ন দেখি । অ্যালান বাের্ডারের রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার স্বপ্ন দেখি।

শুভ্র : এর আগের দুটি সাক্ষাৎকারে টেস্টে ১০ হাজার রান আর সুনীল গাভাস্কারের সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙার যে স্বপ্নের কথা বলেছিলেন, সেই স্বপ্ন তাে এখনাে জীবিত আছে, নাকি?

ইনজামাম : স্বপ্ন থাকবে না কেন? আমি তাে মনে করি যেকোনাে ব্যাটসম্যান যখন টার্গেট ঠিক করবে, তখন গ্রেট প্লেয়ারদেরই সামনে রাখা উচিত। জাভেদ মিয়াঁদাদ, সুনীল গাভাস্কার, অ্যালান বাের্ডাররা যা করেছেন, তার চেয়ে ভালাে করার লক্ষ্য কেন থাকবে না? লক্ষ্য বড় থাকলেই না বড় কিছু করা সম্ভব। শুধু ১০ হাজার রান কেন, আমি তাে ১২ হাজার রান করার স্বপ্ন দেখি । অ্যালান বাের্ডারের রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার স্বপ্ন দেখি।

শুভ্র : ইমরান খান অনেকবারই বলেছেন, প্রতিভার দিক থেকে আপনি টেন্ডুলকার বা লারার চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই। কিন্তু আপনার মধ্যে রানক্ষুধার অভাব। আপনি কি একমত?

ইনজামাম : প্রতিভার ব্যাপারে তিনি যা বলেছেন, হয়তাে তা ঠিক। আমার মধ্যে যদি কোনাে কিছুর ঘাটতি থাকে, তাহলে আমি চেষ্টা করব তা কাটিয়ে উঠতে।

শুভ্র : শুরুর সেই দিনগুলাের সঙ্গে আপনার এখনকার ব্যাটিংয়ের কি পার্থক্য খুঁজে পান? নিশ্চয়ই টেকনিক্যাল কিছু পরিবর্তন হয়েছে।

ইনজামাম : টেকনিক্যাল পরিবর্তনের চেয়ে শুরুর সঙ্গে আমি মূল পার্থক্যটা দেখি অন্যখানে। দলে চার-পাঁচ বছর হয়ে যাওয়ার পর আপনি আর নিজের ইচ্ছেমতাে খেলতে পারবেন না। আপনাকে খেলতে হবে দলের প্রয়ােজন বুঝে । শুরুতে আমি আরও অনেক বেশি স্ট্রোক খেলতাম। কিন্তু এখন আর তেমন পারি না। দলের প্রয়ােজনের কথা ভাবতে হয় আগে। কখনাে উইকেটে টিকে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়, কখনাে বা অ্যাটাক করা-দলের যা প্রয়ােজন তা-ই খেলতে হয় এখন।

সতীর্থ ইউসুফের (তখনো তিনি ইয়োহানা) মধ্যে লারা-টেন্ডুলকারের পর্যায়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখেছিলেন ইনজামাম। ছবি: গেটি ইমেজেস।

শুভ্র : আপনার সময়ে ব্যাটিং নিয়ে যেকোনাে কথাতেই টেন্ডুলকার-লারাকে রাখতেই হতাে। বর্তমান সময়ের কোন তরুণ ব্যাটসম্যান এই দুজনের পর্যায়ে যেতে পারে বলে মনে করেন?

ইনজামাম : ইউসুফের (ইয়ােহানা) ব্যাটিং আমার খুব ভালাে লাগে। ওর প্রতিভা আছে, পরিশ্রম করতেও ক্লান্তি নেই। আর এক-দুই বছরের অভিজ্ঞতা যােগ হওয়ার পর ও দারুণ এক ব্যাটসম্যান হবে।

আরও পড়ুন: 

'গাভাস্কারের ৩৪ সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার স্বপ্ন দেখি'

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×