`ক্রনিয়ে অন্তত কৃতকর্মের দায়িত্ব নেওয়ার সাহস দেখিয়েছে`

শন পোলকের একান্ত সাক্ষাৎকার

উৎপল শুভ্র

১৭ মে ২০২১

`ক্রনিয়ে অন্তত কৃতকর্মের দায়িত্ব নেওয়ার সাহস দেখিয়েছে`

শন পোলক। ছবি: গেটি ইমেজেস

বিখ্যাত বাবা পিটার পোলক, তার চেয়েও বিখ্যাত চাচা গ্রায়েম পোলক সম্পর্কে এত বলতে হয়েছে যে, ইন্টারভিউ দিতে বসার আগে প্রথমেই শর্ত দিয়ে দিলেন, ক্রিকেটিং ফ্যামিলি-সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তাতে কী, এর বাইরেও প্রশ্নের অভাব আছে নাকি! বিনা দ্বিধায় সেই শর্তে রাজি হয়ে দিল্লির ‘দ্য ললিত’ হোটেলের সুইমিং পুলের পাশে শন পোলককে নিয়ে বসে গিয়েছিলাম। এরপর আর কি, তাঁর নিজের ক্যারিয়ার, বোলিং পার্টনার অ্যালান ডোনাল্ড, ক্রনিয়ে ও ফিক্সিং-অধ্যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার `চোকার` অপবাদ...কত কিছুতেই না ডালপালা ছড়াল সেই কথপোকথন।

প্রথম প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০১৬। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: আপনার বোলিংয়ে একটা সহজ-সরল ব্যাপার ছিল। লাইন-লেংথ ঠিক রেখে একইভাবে বল করে যাওয়া। যেখানে গ্লেন ম্যাকগ্রার সঙ্গে মিল। আগে-পরে আর কোনো বোলার কি আছেন, যাঁকে দেখে মনে হতো আপনার বোলিং দর্শনেই বিশ্বাসী?

শন পোলক: সব বোলারই তার মতো করে একটা পথ খুঁজে নেয়। আমার এক্সপ্রেস গতি ছিল না। তাই বলের ওপর নিয়ন্ত্রণই ছিল আমার ভরসা। শুধু ম্যাকগ্রা কেন, কার্টলি অ্যামব্রোসও অনেকটা একই রকম ছিল। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে কোর্টনি ওয়ালশও। আমি যেটা ভালো পারতাম, সেটাই করেছি। খুব একটা খারাপও বোধ হয় করিনি।

শুভ্র: পেসাররা তো জোড়া বেঁধে শিকার করেন। ডোনাল্ড-পোলক জুটিও তা-ই করত। ওপেনারদের ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়, পেসারদের জুটি হতে হলেও কি মাঠের বাইরেও বন্ধু হতে হয়?

পোলক: বন্ধুত্ব তো দলের প্রায় সবার সঙ্গেই হয়। এত সময় একসঙ্গে থাকা, সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়ানো..। আমি একদিক থেকে ভাগ্যবান। অ্যালানের (ডোনাল্ড) পর মাখায়া এনটিনি ও স্টেইনের সঙ্গেও আমার জুটি হয়েছে। ওদের সবার বোলিংই ছিল আমার চেয়ে আলাদা। দুটি মিলে তা বেশি কার্যকর হয়েছে।

শুভ্র: আপনাকে যদি বলতে বলি, অ্যালান ডোনাল্ড কেমন বোলার ছিলেন?

পোলক: হি ওয়াজ গ্রেট। এমনিতেই তো আর ওকে ‘হোয়াইট লাইটনিং’ ডাকা হতো না। আমি ওকে গতির ঝড় তুলতে দেখেছি। দেখেছি, ওই গতির সামনে পড়তে হবে ভেবে অনেক দলই কেমন ভয় পাচ্ছে। ম্যাচ শুরুর আগেই তাই একটা সুবিধা পেয়ে যেতাম আমরা। ওর দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একঘরে হয়ে থাকার সময়েই ও নিজের সেরা ফর্মে ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা নিষিদ্ধ না থাকলে ওর ক্যারিয়ারে আরও কয়েকটা বছর যোগ হতো, ওর রেকর্ড আরও দুর্দান্ত হতো।

শুভ্র: যে ভয়ের কথা বললেন, ডোনাল্ডের নির্দিষ্ট কোনো স্পেলের কথা মনে পড়ে যখন ব্যাটসম্যানদের চোখে ভয় দেখেছেন?

পোলক: সবার আগে মনে পড়ছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ট্রেন্টব্রিজ।

শুভ্র: ওই টেস্টে মাইক আথারটনের সঙ্গে ডোনাল্ডের দ্বৈরথ তো বিখ্যাত হয়ে আছে...

পোলক: হ্যাঁ, আথারটন আর (নাসের) হুসেইন ছিল উইকেটে। ডোনাল্ড সেদিন রীতিমতো আগুন ঝরাচ্ছিল।

অ্যালান ডোনাল্ডের সঙ্গে দারুণ এক জুটি গড়েছিলেন শন পোলক। বোলার ডোনাল্ড নিয়েও তিনি প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: আপনি বিদায় নেওয়ার পর ক্রিকেট আগের চেয়ে ভালো হয়েছে, না খারাপ?

পোলক: ঠিক জানি না। এটা তো দেখাই যাচ্ছে, টি-টোয়েন্টির একটা জোয়ার এসেছে। প্রচুর টাকা আসছে। তবে এটি খেলাটার জন্য ভালো হচ্ছে কি না, আমি নিশ্চিত নই। ক্রিকেট খেলাটা তো ব্যাট আর বলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তাই না? সেখানে বেশির ভাগ টি-টোয়েন্টি দেখলে মনে হয়, বোলারদের শুধু সংখ্যা পূরণের জন্যই রাখা হয়েছে। বোলাররা যেন নামেই আছে, ম্যাচের ফল নির্ধারণে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই। আসল লড়াইটা কার ব্যাটিংয়ে কত শক্তি। আমাকে লোকে প্রাচীনপন্থী বলতে পারে, তবে আমার কাছে এখনো টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাট-বলের লড়াইটাই আসল ক্রিকেট। এই টি-টোয়েন্টিটা একটু বেশি বেশিই হয়ে যাচ্ছে।

শুভ্র: আপনি তো ক্রিকেটের যুগ বদলের সন্ধিক্ষণে বিদায় নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন, আইপিএলও...

পোলক: প্রথম আইপিএলটা খেলেছিলাম, তবে সেটি আমার ক্যারিয়ারের শেষে এসে। তখন খেলাটা এত একপেশে ছিল না, বোলারদেরও কিছু করার ছিল। কিন্তু গত কিছুদিন ব্যাটিংটা এমন বিধ্বংসী হয়ে গেছে যে, কী বলব! কখনো মনে হয়, এখন কয়েকটা ম্যাচ খেলতে পারলে খারাপ হতো না! বোলারদের তুলাধোনা হতে দেখি আর ভাবি, আমি ওর জায়গায় থাকলে কী করতাম? কোনো একটা উপায় কি বের করতে পারতাম!

শুভ্র: আপনাকে জিজ্ঞেস না করেই একটা কথা বলে দিচ্ছি, আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ ২০০৩ বিশ্বকাপ। যখন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হিসাবে ভুল করে ‘টাই’ করার পর বিদায় নিতে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে।

পোলক: মজার ব্যাপার কি জানেন, খেলার সময় জয়-পরাজয় নিয়ে এত আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম, খেলা ছাড়ার পর কিন্তু সেসব এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। উল্টো করে যদি বলি, ২০০৩ বিশ্বকাপ ও এর পরের সময়টা বরং আমার জন্য ভালো ছিল। বিরূপ ওই সময়, বিশ্বকাপ থেকে বিদায়, গায়ে ডাকওয়ার্থ-লুইসের একটা দাগ লেগে যাওয়া...আমার কাছে কিন্তু ডাকওয়ার্থ-লুইসের পাতাটাই ছিল না। ওটা ছিল কোচদের কাছে। তবে অধিনায়ক হিসেবে সব দায় তো আমারই। ওই সময়টায় নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। অমন কঠিন সময় আপনাকে ভেঙেচুরে দিতে পারে না, বরং নতুন করে গড়তে পারে। অনেক কিছু শেখা যায়। জীবন শুধুই ফুলশয্যা হলে আপনি নিজের সম্পর্কে জানতে পারবেন না। আক্ষেপের কথা যদি বলেন, আমাদের সব বিশ্বকাপ অভিযানই তো তা-ই। আমরা প্রায় প্রতিবারই জেতার মতো দল নিয়ে নেমেছি, কিন্তু প্রতিবারই সেই একই গল্প।

২০০৩ বিশ্বকাপের সেই দুঃস্বপ্ন! শন পোলক তখন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: ঠিক এই প্রশ্নটাই করতাম এরপর। বিশ্বকাপে এসে দক্ষিণ আফ্রিকার এমন মুখ থুবড়ে পড়ার কোনো কারণ কি আপনি খুঁজে পান?

পোলক: এটা অনেক কিছুর সংমিশ্রণ। বিশ্বকাপ জিততে ভাগ্যের একটু ছোঁয়া লাগে, যা আমরা অনেকবারই পাইনি। বিশ্বকাপ জিততে নির্দিষ্ট একটা সময়ে সামর্থ্যের পূর্ণ প্রকাশ ঘটাতে হয়, যা আমরা পারিনি। একটা নির্দিষ্ট কারণ বলা কঠিন। একদিন না একদিন দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ জিতবেই। তত দিন পর্যন্ত এই বোঝাটা নিয়েই আমাদের পথ চলতে হবে। সংবাদমাধ্যম, সাধারণ জনগণ এটা মনে করিয়ে দেবেই, তাতে চাপ আরও বাড়বে।

শুভ্র: দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের ঘোর অন্ধকারের সময়টায় আপনি অধিনায়ক হয়েছিলেন। হানসি ক্রনিয়ে ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করার পর অধিনায়কত্ব পেয়ে আপনার কী মনে হয়েছিল?

পোলক: খুব কঠিন এক সময়। আমি তখন সহ-অধিনায়ক ছিলাম ঠিকই, কিন্তু অধিনায়ক হবই, এই নিশ্চয়তা তো ছিল না। হলেও আমি ভেবেছিলাম আরও তিন-চার-পাঁচ বছর পর। ক্রনিয়ের ওই ঘটনা দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের ভিত ধরে নাড়া দিয়েছিল। অধিনায়ক হিসেবে আমার কাজ ছিল, সেটিকে পেছনে ফেলে সবাইকে সামনের দিকে তাকাতে বলা। তবে কাজটা খুব কঠিন ছিল। কারণ ওই ঘটনার পর অধিনায়কের অনেক ক্ষমতাই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। দল নির্বাচনে কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগও। তবে সব মিলিয়ে অধিনায়কত্বের সময়টা আমি উপভোগই করেছি। ট্যাকটিকস ঠিক করা, এর সঙ্গে দলের প্রশাসনিক দিক সামলানো—ভালোই লাগত এসব।

শুভ্র: ক্রনিয়ের ওসব কাণ্ডের কথা জানার পর নিজেকে প্রতারিত মনে হয়নি?

পোলক: বিস্ময়টাই বেশি ছিল। তবে আমার মনে হয় না, কোনো ম্যাচ পাতানো ছিল। ক্রনিয়ে সম্ভাব্য গেমপ্ল্যান, একাদশ এমন সব বিষয়ে প্রচুর তথ্য দিয়েছে। এটাও ঠিক হয়নি। আমি এভাবে দেখি, আমরা সবাই রক্ত-মাংসের মানুষ, সবাই ভুল করি। ক্রনিয়ে অন্তত নিজের কৃতকর্মের দায়িত্ব নেওয়ার মতো সাহস দেখিয়েছে। এসবে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। বিশ্ব ক্রিকেটে আরও অনেকেই তা করেনি। এ জন্য আমি ওকে শ্রদ্ধা করি। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে ওর যে অবদান, সেটির জন্যও আমার শ্রদ্ধা আছে।

`ক্রনিয়ে অন্তত নিজের কৃতকর্মের দায় নেওয়ার সাহস দেখিয়েছে` বলে তাঁর প্রতি বরং শ্রদ্ধা আছে পোলকের। ছবি: এএফপি

শুভ্র: ক্যালিস-বাউচার এমন আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলেও ক্রনিয়ে সম্পর্কে একটা শ্রদ্ধাবোধ টের পেয়েছি। আপনিও দেখছি তাঁদের দলেই। কেন, একটা লোক, যাঁকে আপনারা আদর্শ মানতেন, তিনি অমন সব কাণ্ড করেছেন, তারপরও শ্রদ্ধাটা আসে কোত্থেকে?

পোলক: ব্যাপারটা এভাবে দেখুন, আপনি যখন দলে নতুন এসেছেন, ক্রনিয়ে তখন অধিনায়ক। আপনি যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের ছাপ রাখার চেষ্টা করছেন, তখন ক্রনিয়ে ও বব উলমার আপনার ক্যারিয়ার গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ডেবুট্যান্ট থেকে একদিন আপনি দলের সিনিয়র খেলোয়াড়, দেশকে ম্যাচ জেতাচ্ছেন...ক্রনিয়ে কাউকে কিছু তথ্য দিয়েছে বলে আপনি এসব কিছু উড়িয়ে দিতে পারেন না। আমরা হতাশ হয়েছিলাম, হতবাকও, কিন্তু আমরা সবাই ভুল করি। হ্যাঁ, এটা ছিল অনেক গুরুতর ভুল। তাতেও বাকি সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায় না।

শুভ্র: ক্রিকেট পরিবারে জন্ম আপনার। ছোটবেলা থেকে অনেক ক্রিকেটারকে দেখেছেন, পরে খেলেছেন অনেকের সঙ্গে, এখনো দেখছেন। তাঁদের মধ্য থেকে যদি সেরা পাঁচ বেছে নিতে বলি...

পোলক: এটা খুব কঠিন। আমি যে সময়ে খেলেছি, ওই সময়ে খেলতে পারার জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। কী সব খেলোয়াড় ছিল! বোলিংয়ের কথা যদি বলি, ওয়াসিম ও ওয়াকার, কার্টলি ও কোর্টনি...স্পিনারদের কথা বললে দুই মুশতাক, ওয়ার্ন, মুরালিধরন...ব্যাটিংয়ের কথা বললে লারা, টেন্ডুলকার, শেবাগ, গিলক্রিস্ট, পন্টিং, দুই ওয়াহ...কাকে ছেড়ে আমি কাকে নেব! লোকে এখনো এসে বলে, নব্বইয়ের শেষের ওই সময়টায় আমাদের খেলা তারা কেমন উপভোগ করত!

পাকিস্তানের টু ডব্লিউস্: শন পোলকের দেখা সেরা বোলিং জুটি। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: আপনি নিজে বিখ্যাত এক পেস জুটির অংশীদার। আপনার দেখা সেরা পেস জুটি কোনটি?

পোলক: বিশ্বের যেকোনো মাঠে যেকোনো উইকেটে বোলিং করতে হবে, এটা ভেবে কোনো জুটিকে বেছে নিতে বললে আমি বলব, ওয়াসিম ও ওয়াকার। একজন ডানহাতি, আরেকজন বাঁহাতি, নতুন বলে সুইং করাতে পারত, পুরোনো বলে রিভার্স সুইং, ফ্ল্যাট উইকেট বলুন বা সিমিংবান্ধব উইকেট—সবখানেই দুর্দান্ত। সবকিছু মিলিয়ে ওরাই সেরা।

আরও পড়ুন:

ক্যালিস-বাউচার: এখনো ক্রনিয়েই ওদের অধিনায়ক

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×