কপিল দেবের একান্ত সাক্ষাৎকার

‘রিচার্ডসই আমার এক নম্বর, তবে তিন বছর এমন খেললে কোহলি`

উৎপল শুভ্র

২৩ মে ২০২১

‘রিচার্ডসই আমার এক নম্বর, তবে তিন বছর এমন খেললে কোহলি`

কপিল দেব। ছবি: গেটি ইমেজেস

তাঁর দেখা সেরা ব্যাটসম্যানের স্বীকৃতিটা সব সময়ই পেয়ে এসেছেন ভিভ রিচার্ডস, ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ বিকেলেও পাচ্ছিলেন। তবে তখন তা শর্তসাপেক্ষে। বিরাট কোহলি আর তিন বছর এমন খেলে গেলে সিদ্ধান্তটা বদলে ফেলবেন বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন কপিল দেব। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় কপিল দেবের ইন্টারভিউ নিতে বসে একটু না, ভালোই চমকে গিয়েছিলাম।

উৎপল শুভ্র: প্রায় ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে দারুণ সব ব্যাটসম্যানকে বোলিং করেছেন। এদের মধ্যে যদি সেরা পাঁচজনকে বেছে নিতে বলি...

কপিল দেব: আমার নিজের দেশের কারও কথা তো তাহলে বলতে পারব না। যেমন গ্রেট সুনীল গাভাস্কারের বিপক্ষে, আমি ওর সঙ্গে খেলেছি। এর বাইরে প্রথমেই বলব ভিভ রিচার্ডসের কথা। নিঃসন্দেহে আমাদের সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান। ওকে বোলিং করে আমি খুব মজা পেয়েছি। আমার ক্যারিয়ারের শুরুতে জহির আব্বাসও দুর্দান্ত খেলছিল। অরবিন্দ ডি সিলভাও খুব ভালো ছিল। আর মার্টিন ক্রো ছিল অসাধারণ। গ্রেগ চ্যাপেলকে রাখতে পারছি না, কারণ তাঁর বিপক্ষে সেভাবে বোলিং করা হয়নি। যে একটা পুরো সিরিজে পেয়েছি, গ্রেগ তখন ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের শচীন টেন্ডুলকারকেও রাখব।

শুভ্র: মানে কী, টেন্ডুলকারের বিপক্ষে বোলিং করলেন কোথায়? ঘরোয়া ক্রিকেটে?

কপিল: হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একই দলে খেলেও ওকে না রেখে পারলাম না। আমি যাদের বিপক্ষে বোলিং করেছি তাদের মধ্যে এরাই আমার সেরা পাঁচ—ভিভ রিচার্ডস, জহির আব্বাস, অরবিন্দ ডি সিলভা, মার্টিন ক্রো, শচীন টেন্ডুলকার।

শুভ্র: সিরিয়ালটা কি এমনই থাকবে?

কপিল: ভিভ সবার আগে। বাকিগুলো এদিক-ওদিক হতে পারে।


শুভ্র: টেলিভিশনে দেখছিলাম, আপনি নাকি বলেছেন ভিভ, লারা, শচীনের চেয়েও ভালো বিরাট কোহলি। শুনে একটু বিস্মিতই হলাম। আসলেই কি তাই মনে করেন?

কপিল: এই টুর্নামেন্টে কোহলি যেভাবে খেলছে, তাতে আমি অভিভূত। দু-এক বছর আগেও হয়তো ওকে আমি এত বড় করে দেখতাম না। কিন্তু গত কিছুদিন কী ব্যাটিংই না করছে! প্রতিদিনই বুঝিয়ে দিচ্ছে, বাকি সবার চেয়ে ও কতটা ভালো। আমি যে ওকে ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে তুলনা করছি, এটাই অনেক বড় একটা স্বীকৃতি। দেখুন, একটা প্লেয়ারকে বিচার করবেন সে কতগুলো ম্যাচ জিতিয়েছে তা দিয়ে। কোহলি যেভাবে ম্যাচের পর ম্যাচ জেতাচ্ছে, যে ধারাবাহিকতা দেখাচ্ছে, তা অবিশ্বাস্য।

সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় কপিল বলেছিলেন, `আগামী তিন বছর কোহলি একই রকম ধারাবাহিকতা দেখাতে পারলে কোহলিই আমার এক নম্বর।` কোহলি তো পাঁচ বছর ধরেই তা দেখাচ্ছেন। ছবি: বিসিসিআইশুভ্র: কোহলি টেস্ট-ওয়ানডেতেও ভালো, তবে ওকে নিয়ে ধন্য-ধন্য রবটা বেশি উঠেছে এই বিশ্বকাপে। টি-টোয়েন্টিতে কোনো ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং দেখেই ভিভ রিচার্ডসকে টেনে আনা কি ঠিক?

কপিল: কী বলেন, এই ২০ ওভারের খেলা তো আরও কঠিন। আমি বলব না, কোহলি এখনই ভিভ রিচার্ডসকে ছাড়িয়ে গেছে। এখনো রিচার্ডসই আমার এক নম্বর। তবে আগামী তিন বছর যদি এভাবে খেলতে পারে, আমি নির্দ্বিধায় বলব, আমার দেখা সেরা ব্যাটসম্যানের নাম বিরাট কোহলি।

শুভ্র: আপনি যেমন ভিভ রিচার্ডসকে এক নম্বরে রাখছেন, আপনার সময়ের প্রায় সব বোলারই তা-ই রাখে। তা রিচার্ডসকে বোলিং করার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী ছিল?

কপিল: যে ব্যাটসম্যান ভালো বলেও চার মারতে পারে, সে-ই তো গ্রেট। অন্য ব্যাটসম্যানরা যেখানে বাজে বলের জন্য অপেক্ষা করে, ভিভ ভালো বলকেও অবলীলায় ‘খারাপ’ বানিয়ে দিত। বাজে বল তো মারতই, ভালো বলও। এটাই ওকে আলাদা করে দিত।

শুভ্র: ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে রোমাঞ্চকর কোনো লড়াইয়ের কথা কি মনে পড়ছে?

কপিল: ১৯৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালের কথা মনে পড়ছে, ও কী দারুণই না খেলছিল...১৯৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে ভিভ রিচার্ডসের সেই `অমর` ক্যাচ নেওয়ার পরে। ছবি: পিএ ফটোসশুভ্র: পেছনে দৌড়ে আপনার নেওয়া ওই বিখ্যাত ক্যাচেই তো...

কপিল: ক্যাচের কথা বাদ দেন, ক্যাচ হয়ে যায়। সেদিন ও এত ভালো খেলছিল, মনে হচ্ছিল ম্যাচ শেষ হতে বেশিক্ষণ লাগবে না। এর বাইরে ভারতে ওর বেশ কটি ইনিংস আছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজেও, যখন ওকে বোলিং করাটা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল। ভালো-খারাপ সব বলেই এমন নির্বিচার আক্রমণাত্মক ছিল যে, ভিভের বিপক্ষে ভালো বল করাটা ছিল খুব কঠিন। তার পরও আমি বলব, ভিভকে বোলিং করেই আমি সবচেয়ে বেশি মজা পেয়েছি।

শুভ্র: বিশ্ব ক্রিকেট একবারই একই সময়ে চারজন দুর্দান্ত অলরাউন্ডারকে দেখেছে। ইমরান-কপিল-হ্যাডলি-বোথাম—অমন কারও কি আর দেখা মিলবে? 

কপিল: এখন এত বেশি খেলা, এত বেশি চাপ যে, ভালো অলরাউন্ডার হওয়া খুব কঠিন। ব্যাটিং-বোলিং দুটিতেই সমান মনোযোগ দেওয়ার সময় কই? তার মানে এই না যে, আমাদের পর আর ভালো অলরাউন্ডার আসেনি। শুধু ব্যাটিং-বোলিংয়েই তো অলরাউন্ডার হয় না, ধোনিও খুব ভালো অলরাউন্ডার। আর ক্যালিস? ক্যালিস তো ছিল দুর্দান্ত। 

শুভ্র: বাকি তিন অলরাউন্ডার সম্পর্কে যদি একটু বলতে বলি...

কপিল: প্রথমে ইমরানকে নিয়ে বলি। অসাধারণ নেতা। ক্রিকেটার হিসেবেও দারুণ। আমার প্রথম সিরিজেই ওর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখেছি। ও পাকিস্তান দলকে এক সুতায় গেঁথেছিল। আপনিও নিশ্চয়ই জানেন, পাকিস্তান দলকে একতাবদ্ধ রাখার মতো কঠিন কাজ আর নেই। ইমরান সেটি দারুণভাবে করতে পেরেছে। রিচার্ড হ্যাডলি বোলার হিসেবে ছিল দারুণ। আর বোথাম সবকিছুতেই একই রকম ভালো ছিল। যেমন ব্যাটিং, তেমনি বোলিং, ফিল্ডিংয়েও দুর্দান্ত। সব জায়গাতেই সমান। 

শুভ্র: আপনার চোখে আপনাদের চারজনের মধ্যে এক নম্বর কে?

কপিল: রেকর্ড দেখলে অলরাউন্ডার হিসেবে বোথামকেই সেরা মনে হবে। উইকেট তো নিয়েছেই, ব্যাটিংয়েও অনেক রান করেছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে রান পায়নি। তবে রেকর্ড বলবে, বাকি যে কারও চেয়ে ভালো অলরাউন্ডার ছিল বোথাম।

শুভ্র: স্যার রিচার্ড হ্যাডলি আমাকে বলেছিলেন, তিনি ছিলেন চারজনের মধ্যে সেরা বোলার আর বোথাম সেরা ব্যাটসম্যান...

কপিল: হ্যাডলি অবশ্যই আমাদের সবার মধ্যে সেরা বোলার ছিল। এ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই।

ইমরান-বোথাম-হ্যাডলি-কপিল: সেই অলরাউন্ডার কোয়াট্রেট। ছবি: উইজডেনশুভ্র: আপনি খুব পরিতৃপ্ত মানুষ জানি, তার পরও একটা আক্ষেপ তো না থেকে পারেই না। বিতর্কিতভাবে একটা টেস্টে বাদ না পড়লে টানা ১৩২ টেস্ট খেলার রেকর্ড থাকত আপনার...

কপিল: বলুন তো, তাতে এমন কী হাতি-ঘোড়া হতো?

শুভ্র: এটি দারুণ একটা রেকর্ড হতো না? একজন পেসারের টানা এতগুলো টেস্ট খেলা, ভাবাই যায় না!

কপিল: খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর এসব রেকর্ড-ফেকর্ডে কিচ্ছু আসে যায় না। 

শুভ্র: কিন্তু তখন তো নিশ্চয়ই খারাপ লেগেছিল? ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কলকাতা টেস্টে আপনাকে বাদ দেওয়া ছিল আগের টেস্টে বাজে শট খেলার শাস্তি। কলকাতায় ‘নো কপিল নো টেস্ট’ পোস্টার পড়েছিল। তার পরও আপনাকে নেওয়া হয়নি...

কপিল: জীবন এমনই। আপনি কখনোই সবকিছু পাবেন না। সত্যি বলছি, ক্রিকেট নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। ক্রিকেট আমাকে যা দিয়েছে, আমি কখনো তা পাওয়ার কথা কল্পনাও করিনি।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×