হোয়াটমোরের দেখা সেরা পাঁচ বোলার

উৎপল শুভ্র

১৭ জুন ২০২১

হোয়াটমোরের দেখা সেরা পাঁচ বোলার

ছুটকো-ছাটকা যদি বাদও দিই, ডেভ হোয়াটমোরের আনুষ্ঠানিক দীর্ঘ ইন্টারভিউই যে কত করেছি, তার কোনো হিসাব নেই। এটির মতো উপভোগ করিনি আর কোনোটা। বিষয় ছিল, হোয়াটমোরের দেখা সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যান ও বোলার। ভাবার জন্য একটু সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির এক বৃষ্টিমুখর দিনে বুলাওয়ের হোটেল রুমে মুখের সামনে টেপ রেকর্ডার ধরার পর আমার কাজ ছিল শুধু একটু প্রসঙ্গ ধরিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয় পর্বে থাকছে হোয়াটমোরের চোখে সেরা পাঁচ বোলারের কথা।

উৎপল শুভ্র : ব্যাটসম্যান সম্পর্কে তো আগেই বলেছেন, এবার আপনার দেখা সেরা পাঁচ বোলার। পাঁচজনের আগে বলুন, তারপর একে একে সবার সম্পর্কে...

ডেভ হোয়াটমোর: আমার দেখা সেরা পাঁচ বোলার মুত্তিয়া মুরালিধরন, শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রা, ডেনিস লিলি ও ওয়াসিম আকরাম।

শুভ্র: তাহলে মুরালিধরনকে দিয়েই শুরু হোক।

হোয়াটমোর: মুরালিধরনকে এক নম্বরে রাখার কারণ, ও সত্যিকার এক জিনিয়াস। শুধু বোলিংয়ের সময়ই যে তা বোঝা যায়, তা নয়। ওর সঙ্গে কথা বললেও আপনি নতুন করে জানবেন পুরোনো সত্যিটা—চ্যাম্পিয়নদের তৈরি করা যায় না, তাদের জন্ম হয়। মুরালি যেকোনো ম্যাচই খেলতে নামুক, ও জানে, ওকেই ইনিংস শেষ করে দিতে হবে, প্রতি ইনিংসে কমপক্ষে চার-পাঁচ উইকেট পেতেই হবে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, ও অনেক ওভার বোলিং করে। তা করতে ওর কোনো ক্লান্তি নেই, কারণ বোলিংয়ের জন্য ওর অপরিসীম তৃষ্ণা । আর যদি শুধু ওর স্কিলের কথা বলেন, প্রায় লেগ ব্রেক অ্যাকশনে কজির ওই মোচড়ে এমন অফ ব্রেক বোলিং করা, এটা এক অনন্য স্কিল। ক্রিকেট ইতিহাসে কেউ কোনোদিন অফ ব্রেক বোলারকে ভয় পায়নি, ওর জন্য এখন তা পায়। টেস্ট ক্রিকেটে উইকেট নেওয়ার হারের দিক থেকে ও এক নম্বর, আমার দেখা সেরা বোলারদের তালিকাতেও তা-ই।

তাঁর দেখা সেরা পাঁচ বোলারের তালিকার এক নম্বরেই মুরালিধরনকে রেখেছিলেন ডেভ হোয়াটমোর। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র : মুরালিধরনকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে ওর মূল শক্তি বলবেন কোনটিকে? আমরা সবাই জানি, যেকোনো উইকেটে ও বল টার্ন করাতে পারে। আর কী?

হোয়াটমোর : আমি বলব, ওর মূল শক্তি হলো ভালো করার সুতীব্র ইচ্ছা। এর সঙ্গে যোগ হবে ওর অসম্ভব প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় মনোভাব। মাঠে কেউ কোনো ক্যাচ ফেললে বা মিস ফিল্ডিং হলে ও অসন্তোষটা পুরোপুরি বুঝিয়ে দেবে। কারণ ওর নিজের মানদণ্ডেই ও বাকি সবাইকে বিচার করে। বোলিং করার সময় ওর শরীরের প্রতি আউন্স মাংসপেশিই যেন প্রতিপক্ষকে আউট করার চেষ্টা করে।

শুভ্র : কিন্তু সব কিছুর পরও এটা তো সত্যি যে, মুরালিধরনের ক্যারিয়ারে তাঁর বোলিং অ্যাকশন নিয়ে একটা ফুটনোট থাকবেই। বিষেণ সিং বেদি যেমন মুরালিকে জ্যাভলিন থ্রোয়ারের বেশি কিছু মনে করেন না। মুরালির অ্যাকশন নিয়ে আপনার কী মত? 

হোয়াটমোর : এটা খুবই দুঃখজনক। প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব মতামত থাকে, এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে কেউ ভালো করলে যখন সমালোচনা শুরু হয়, সেটি খুব অন্যায়। মুরালি যদি ভালো না করত, তাহলে কেউই এসব বলত বলে আমার মনে হয় না। বরং আমার যা মনে হয়, তা বলেই ফেলি, ঈর্ষা থেকেই এসব কথাবার্তার উৎপত্তি।

শুভ্র : আপনার তালিকার দ্বিতীয়জনও তো স্পিনার। শেন ওয়ার্ন।

হোয়াটমোর: ওয়ার্ন, ও গড! ও আরেক ম্যাচ উইনার। মুরালিধরন নাম্বার ওয়ান ম্যাচ উইনার, ওয়ার্নও তা-ই; আসলে আমার তালিকার পাঁচজনই ম্যাচ উইনার। লেগ ব্রেক বোলিং করে ওয়ার্নের যে স্ট্রাইক রেট, এটাই বুঝিয়ে দেয়, ও বিশেষ কিছু। মুরালির চেয়ে ও একেবারেই আলাদা, ওকে ঘিরে সব সময়ই অন্য রকম একটা আবহ থাকে। আবেদন করার ভঙ্গি, জোরে জোরে কথা বলে চাপ সৃষ্টির কৌশল—সবকিছু মিলিয়ে ওর মধ্যে অন্য রকম একটা নাটকীয়তা আছে। তবে শুধু এটাই তো আর ওয়ার্ন নয়, ওর অসাধারণ স্কিলটাই আসল। লেগ ব্রেকের ওপর ওর অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ, সেই লেগ ব্রেকও আছে দু-তিন রকম। আর ওর ফ্লিপার রীতিমতো বিধ্বংসী। দারুণ বর্ণময় ওর ক্যারিয়ার, এ কারণে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেকবার সমস্যাতেও পড়তে হয়েছে ওকে।

শুভ্র : এক্সট্রা কারিকুলাম আরও অনেক কিছুতে তাঁর ঝোঁকও তো প্রমাণিত... 

হোয়াটমোর : (হাসি) হ্যাঁ, সেসব তো সবারই জানা। তবে সব কিছুর পরও বারবার ফিরে এসেছে ও এবং ফিরে এসেছে আগের মতোই দুর্দান্তভাবে। 

শুধু বোলিং নয়, আরও অনেক কিছু মিলিয়েই শেন ওয়ার্নে মুগ্ধ হোয়াটমোর। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: এবার গ্লেন ম্যাকগ্রা। 

হোয়াটমোর: গ্লেন ম্যাকগ্রার পরিসংখ্যানই সেরা পাঁচে তার জায়গা নিশ্চিত করে দেয়। এখন যে হারে ক্রিকেট খেলা হয়, তাতে একজন ফাস্ট বোলারের এমন ফিগার নিয়ে ফেরাটাকে এক কথায় বলতে হবে, অসাধারণ। অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার, তাই ও যে খুব আক্রমণাত্মক, তা না বললেও চলে। তবে ম্যাকগ্রার কথা উঠলে প্রথমেই আমার যা মনে হয় তা হলো—ও খুব নির্ভরযোগ্য, ওর হাতে বল তুলে দিলে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, ওর মার খাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম । উইকেট না পেলেও চাপটা ঠিকই ধরে রাখবে ও। অধিনায়ক হিসেবে এটা একটা দারুণ ব্যাপার, কারণ আপনি জানেন ম্যাকগ্রাকে বল ছুড়ে দিলেই ও ব্যাটসম্যানের পরীক্ষা নেবে এবং বেশির ভাগ সময় সেই পরীক্ষায় তো ও-ই জিতবে।

শুভ্র : ক্রিকেট ইতিহাসে ম্যাকগ্রার মতো জটিলতাহীন বোলারও সম্ভবত আর নেই । ক্রমাগত লাইন-লেংথ বোলিং করে যাওয়া... দেখলে মনে হয় এ আর এমন কী! 

হোয়াটমোর : আসলেই তাই। ম্যাকগ্রার বোলিং খুবই সহজ-সরল। ও সোজা দৌড়ে আসে, ওর অ্যাকশনকে ক্লাসিক্যাল বলা যাবে না, দৌড়ে এসে এমনভাবে বল করে যাতে সিমটা গিয়ে উইকেটে আঘাত করে। মুভমেন্ট পায় দুদিকেই, সব সময় ও যেদিকে চায় তা হয়তো নয়, তাতে কিছু আসে যায়ও না। কখনো কখনো একট সুইংও পায়, তবে ও মূলত সিম বোলার, যে নব্বই ভাগ সময় ঠিক ওই জায়গাটায় বল ফেলতে পারে। ছয় ফুটের ওপর লম্বা হওয়ায় বাউন্সও পায়, আর এ সব কিছুই বিরতিহীনভাবে করে যাওয়ার পুরস্কার হিসেবে আসে উইকেট।

৯০ ভাগ বলই একই জায়গায় ফেলার বিস্ময়কর ক্ষমতা ছিল ম্যাকগ্রার। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র : এবার ডেনিস লিলি। আপনার তালিকার চার নম্বরে, কিন্তু অনেকের চোখেই তো সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলার। 

হোয়াটমোর: অবশ্যই সর্বকালের সেরাদের একজন। সত্যিকার ঝড়োগতির বোলারদের মধ্যে লিলিই প্রথম এমন সাফল্য পেয়েছেন। লিলির ক্রিকেটের আরেকটি বলার মতো দিক, তাঁকে দেখতে মাঠে ছুটে আসত দর্শক। ওই লম্বা রান আপ, ক্লাসিক্যাল অ্যাকশন, ব্যাটসম্যানের মুখের পাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে যাওয়া বল... এসবই ছিল দর্শকদের জন্য দারুণ রোমাঞ্চকর।

শুভ্র : ভিডিওতে দেখেছি, লিলি বল করতে দৌড় শুরু করেছেন, আর পুরো স্টেডিয়াম 'লিলি' 'লিলি' বলে চিৎকার করছে। 

হোয়াটমোর : হ্যাঁ, এটা ছিল মেলবোর্নে, সম্ভবত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। দর্শকের পুরো মনোযোগ নিজের দিকে টেনে নেওয়ার একটা ক্ষমতা ছিল তাঁর। লিলির বোলিংয়ের আরেকটি বড় দিক ছিল, অমন গতির ঝড় তোলা ফাস্ট বোলার হয়েও তিনি ছিলেন খুব নিখুঁত। অ্যাকশন ছাড়াও জেফ টমসনের সঙ্গে তার সবচেয়ে বড় পার্থক্য ছিল এটাই—'থম্মো'র প্রচণ্ড গতি থাকলেও ও ছিল এলোমেলো, আর লিলি আপনাকে সব বলই খেলতে বাধ্য করতেন। বলে কিছু কারিকুরি করার ক্ষমতাও ছিল তাঁর। গতির ব্যাপারে কোনো আপস না করেই বল সুইং করাতে পারতেন, দারুণ এক স্লোয়ার বল আয়ত্তে এনেছিলেন, উইকেটে ফেলে দু দিকে বল কাটও করাতে পারতেন। সব মিলিয়ে লিলি ছিলেন খুবই কঠিন এক বোলার। আমি আমার ক্যারিয়ারে কয়েকবার তাঁর মুখোমুখি হয়েছি, আপনাকে বলতে পারি, অভিজ্ঞতাটা একদমই সুখকর ছিল না। যখন আপনি জানবেন যে, যে বলটা আসছে, আপনাকে তা খেলতেই হবে, তা ছেড়ে দিতে পারবেন না...এটা ভালো লাগার কথা নয়। লিলির ক্যারিয়ার রেকর্ডও তো অসাধারণ।

ডেনিস লিলির বোলিং দেখতে মাঠে ছুটে আসত দর্শক। ছবি: গেটি ইমেজেস 
শুভ্র : ইনজুরির কারণে ক্যারিয়ারের দুই বছর লিলি নষ্ট হয়েছে, এটা মনে রাখলে তা আরও উজ্জ্বল দেখায়। ডাক্তাররা তাঁর ক্যারিয়ার শেষ বলে ঘোষণা করে দেওয়ার পরও লিলির ওভাবে ফিরে আসাটা তো যুগে যুগে ফাস্ট বোলারদের জন্য অসাধারণ এক অনুপ্রেরণার গল্প।

হোয়াটমোর: হ্যাঁ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে পিঠের স্ট্রেস ফ্র্যাকচারের কারণে লিলিকে দেশে ফিরে আসতে হয়েছিল। অ্যাকশনও কিছুটা বদলাতে হয়েছিল তাকে। ভালো ডাক্তারি পরামর্শ পেয়েছেন; বোলিংয়ের সময় দেহের বিভিন্ন অংশের অবস্থান সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক পরিষ্কার একটা ধারণাও হয়েছে। তাঁর। তবে সব মিলিয়ে লিলির ফিরে আসাটা অসাধারণ বলে মানতেই হবে।

শুভ্র : এবার ওয়াসিম আকরাম, আপনার তালিকার একমাত্র বাঁহাতি। কী বলবেন, তাকে, বল হাতে এক শিল্পী?

হোয়াটমোর: আমার সময়ে সহজাত প্রতিভার বিচারে ওয়াসিম আকরামকেই বাকি সবার চেয়ে এগিয়ে রাখতে হবে। অসাধারণ এক বোলার! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম বলটি থেকে শেষ বল পর্যন্ত ১৭ পা দৌড়ে এসে একইভাবে বল করে গেছে ও। শেষ মুহূর্তে ওর হাত চাবুকের মতো দ্রুত নেমে আসত, ব্যাটসম্যানদের বল বুঝতে তাই খুব সমস্যা হতো, কারণ এটা ক্লাসিক্যাল অ্যাকশন নয়। আর বোলিং! ডানহাতি ব্যাটসম্যানকে ইন সুইং, ডানহাতি ব্যাটসম্যানকে অ্যাওয়ে সুইং, শরীরের আড়াআড়ি আসা বলে পাঁজরে ছোবল দেওয়ার ভয়...সব কিছুই ছিল ওর। অসাধারণ এক অ্যাথলেট ছিল, আউটফিল্ডে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে সাইড আর্ম থ্রোতে ও যেভাবে বুলেটের মতো বল ফেরত পাঠাত, সেটিই প্রমাণ দিত ওর অ্যাথলেটিসিজমের।

সহজাত প্রতিভার দিক থেকে ডেভ হোয়াটমোরের চোখে সবচেয়ে এগিয়ে ওয়াসিম আকরাম। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র : একজন ফাস্ট বোলার ১৮ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন, অ্যাথলেটিসিজমের বড় প্রমাণ তো এটাই। 

হোয়াটমোর : আসলে তা-ই। (হাসি) ওর ক্যারিয়ারও খুব বর্ণময়, কিছু দুষ্টু কাজও করেছে ও। এ সব কিছু সামলে পাকিস্তানের মতো দেশে এত বছর খেলে যাওয়া অবশ্যই বিশেষ কিছু। ওয়াসিমও দুর্দান্ত কম্পিটিটর ছিল, সব সময়ই জিততে চাইত। আর অধিনায়ক হিসেবে ওর ট্যাকটিক্যাল জ্ঞানের কোনো তুলনা ছিল না। ক্রিকেটার হিসেবেও তার সেরাটা বের করে আনত অধিনায়কত্ব। আমি তো বলব, ইমরানের বিদায়ের পর ওয়াসিমের নেতৃত্বেই পাকিস্তান তাদের সেরা ক্রিকেট খেলেছে, ওয়াসিমও ওর সেরা খেলাটা খেলেছে অধিনায়ক হিসেবেই।

আরও পড়ুন:
হোয়াটমোরের দেখা সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যান

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×