‘আশরাফুলের সঙ্গে আমিও মিল খুঁজে পাই’

ব্রেন্ডন ম্যাককালামের একান্ত সাক্ষাৎকার

উৎপল শুভ্র

২০ জুন ২০২১

‘আশরাফুলের সঙ্গে আমিও মিল খুঁজে পাই’

ব্রেন্ডন ম্যাককালাম

শুধু ব্যাটিং দিয়ে নয়, আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্ব দিয়েও নিউজিল্যান্ড দলকে আমূল বদলে দিয়েছেন পরে। তবে এই ইন্টারভিউটা যখন নিয়েছিলাম, ম্যাককালাম তখনো পুরোপুরি ম্যাককালাম হয়ে ওঠেননি। মাঝে মধ্যে শুধু ঝলক দেখিয়েও আবার মিলিয়ে যান। যে কারণে আশরাফুল যেমন তাঁর সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন, তেমনি ম্যাককালামও আশরাফুলের সঙ্গে।

প্রথম প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১০। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনার রেকর্ড দেখলে একটা কথাই মনে হয়—‘খুব ভালো নয়, খুব খারাপও নয়’। আপনি নিজে আপনার ক্যারিয়ারকে কীভাবে দেখেন?

ব্রেন্ডন ম্যাককালাম: আমি এখনো শেখার পর্যায়েই আছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নয় বছর হয়ে গেছে, তার পরও আমি বলব, আমি নিজের খেলাটা বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি (হাসি)। এই নয় বছরে আমার প্রত্যাশামতো সব হয়েছে বলব না। তবে আমার বয়স ২৮, এখনো আরও বেশ কয়েক বছর খেলব। যে অভিজ্ঞতাটা হয়েছে, সেটি কাজে লাগিয়ে সামনের দিনগুলোয় ক্যারিয়ারটাকে ওপরে নিয়ে যেতে চাই।

শুভ্র: নয় বছর পরও শেখার প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আশরাফুলের কথা মনে হলো। প্রায় নয় বছরে আশরাফুলও নিজের খেলাটা বুঝতে পেরেছেন বলেই মনে হয় না। কদিন আগে বলছিলেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করবেন। খেলার ধরন, রেকর্ড—সব কিছুতেই আপনার সঙ্গে নাকি নিজের অনেক মিল খুঁজে পান।

ম্যাককালাম: হ্যাঁ, আমিও ওর সঙ্গে মিল খুঁজে পাই। আমরা দুজনই খুব আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান। এর একটা অসুবিধার দিক হলো, সফল হলে সেটি দারুণ দর্শনীয় ব্যাপার হয়। কিন্তু না পারলে সেটি খুব বাজে দেখায়। এক দিক থেকে আমি খুব ভাগ্যবান যে, আমার দল আমাকে আমার সহজাত ঢঙে খেলার স্বাধীনতাটা দিয়েছে। মেনে নিয়েছে, এভাবে খেলে আমি হয়তো খুব ধারাবাহিক হতে পারব না, কিন্তু যেদিন ভালো খেলব, সেদিন ম্যাচ জেতাব। আমার মনে হয়, আশরাফুলও এমনই মনে করে। ওর দল যদি ওকে সহজাত আক্রমণাত্মক খেলার আত্মবিশ্বাসটা দেয়, তাহলে ও অনেক ম্যাচ জেতাতে পারবে। ওই আক্রমণাত্মক খেলাটা বদলে ফেললে তা আর পারবে না।

আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়েই পৃথিবী মাত করেছেন ম্যাককালাম।৷ ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: ব্যাটিংয়ে এই আক্রমণাত্মক মেজাজটা কি প্রকৃতিগতভাবেই পাওয়া?

ম্যাককালাম: সহজাতই বলতে পারেন। অ্যাডাম গিলক্রিস্টেরও ভূমিকা আছে। গিলক্রিস্টের খেলা দেখেই আমার চিন্তাভাবনায় বড় একটা পরিবর্তন আসে। বিশ্বের সব উইকেটকিপারের জন্যই ও ব্যাটিংয়ের একটা নতুন মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছে। গিলক্রিস্টের মতো অসাধারণ হওয়া তো আর সম্ভব নয়, কিন্তু আমার মতো বিশ্বের সব উইকেটকিপারের কাছেই ও আদর্শ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।

শুভ্র: উইকেটকিপার হয়ে গিলক্রিস্টের অমন ব্যাটিং তো উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের চিরন্তন ধারণাটাকেই বদলে দিয়েছে। এদিক থেকে চিন্তা করলে গিলক্রিস্ট সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনা। আপনি কী বলেন?

ম্যাককালাম: সবচেয়ে যুগান্তকারী কি না, এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে ক্রিকেট দল গড়ার ক্ষেত্রে এটি বিশাল একটা প্রভাব তো রেখেছেই। উইকেটকিপারের কাছ থেকে এখন সবাই খুব ভালো ব্যাটিং আশা করে। গিলক্রিস্ট যেভাবে এত লম্বা সময় ধরে দিনের পর দিন অমন বিধ্বংসী ব্যাটিং করে গেছে, এক কথায় সেটি অবিশ্বাস্য। আমাদের কাজটা অনেক কঠিনও করে দিয়েছে লোকটা!

শুভ্র: কিন্তু ব্যাটিংয়ের ওপর এই বেশি গুরুত্বটা কি উইকেটকিপিংয়ের মানে প্রভাব ফেলেছে? এখন তো উইকেটকিপার নির্বাচনের সময় ভালো কিপিংয়ের চেয়ে ভালো ব্যাটিংই বেশি গুরুত্ব পায়।

ম্যাককালাম: না, আমার তা মনে হয় না। আপনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এখনো দারুণ সব উইকেটকিপার আছে। কিছু কিছু জায়গায় আমি তো বলব কিপিংয়ের মান আগের চেয়েও ভালো হচ্ছে। টি-টোয়েন্টিরও ভূমিকা আছে এতে। টি-টোয়েন্টিতে পেসারদের বলেও উইকেটকিপাররা স্টাম্পের পেছনে দাঁড়াচ্ছে। আপনি যেটা বললেন, তা বোধহয় শুধু ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। স্পেশালিস্ট উইকেটকিপার না উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান—এ ব্যাপারে মনস্থির না করতে পেরে ওরা আজ একে আনছে, কাল ওকে।

উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের সংজ্ঞাটাই বদলে গিয়েছে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের সৌজন্যে। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: বাংলাদেশে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম নামটা বলতেই বেশির ভাগ মানুষের কুইন্সটাউনের কথা মনে পড়ে যায়। ৯৮ রানের টার্গেট, অথচ ৬ ওভারেই খেলা শেষ—এই ম্যাচটা তো আপনারও বিশেষভাবে মনে থাকার কথা।

ম্যাককালাম: (হাসি) হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে। আমি ওটাগোর পক্ষে খেলেছি। কুইন্সটাউন তাই আমার জায়গাই বলতে পারেন। অনেকবার ওখানে গেছি। এখন অবশ্য কুইন্সটাউনের কথা বললে ওই ইনিংসটার কথাই আগে মনে হয়। টার্গেটটা এত ছোট বলে খুব নিশ্চিন্তে খেলতে পেরেছি। আশরাফুলের প্রসঙ্গে যা বলেছিলাম, আমাদের মতো ব্যাটসম্যানকে নিজেদের খেলা খেলতে দিলে যেদিন তা ক্লিক করবে, অমন হবে। তবে ওটা ছিল একটা অদ্ভুত ম্যাচ, প্রতিদিন এমন হয় না।

শুভ্র: বাংলাদেশকে নিয়ে আপনার আরও সুখস্মৃতি আছে। ২০০৪ সালে ঢাকা টেস্টে নিউজিল্যান্ড যখন বিপদে, সেঞ্চুরি করে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।

ম্যাককালাম: এর কিছুদিন আগেই আমি লর্ডসে ৯৬ রানে আউট হয়ে গিয়েছিলাম। সেঞ্চুরি মিস করে মনটা খুব খারাপও হয়েছিল। বাংলাদেশে সেই দুঃখটা ভুলেছিলাম। ওটা আমার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। অনেকে হয়তো বলবে, বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি, এ আর এমন কি! আমি শুধু একটা কথাই বলি, খেলাটা বাংলাদেশে হয়েছিল এবং নিজেদের দেশে বাংলাদেশ খুব বিপজ্জনক দল।

শুভ্র: প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি, এটা তো বিশেষভাবে মনে থাকার কথা...

ম্যাককালাম: (হাসি) আমার সব সেঞ্চুরিই মনে আছে। শচীন টেন্ডুলকার বা রিকি পন্টিংয়ের মনে রাখতে সমস্যা হতে পারে, আমি সেঞ্চুরিই বা করেছি কটা!

শুভ্র: টেস্টে ৪৬, ওয়ানডেতে ৪৫—আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরিসংখ্যা ৯১। শচীন টেন্ডুলকারের কোনো ব্যাখ্যা আছে আপনার কাছে?

ম্যাককালাম: আমার কাছে তো কখনো কখনো ওকে অতিপ্রাকৃত বলে মনে হয়। খুব প্রতিভাবান সন্দেহ নেই, কিন্তু ওর মধ্যে এখনো যে ভালো করার তাড়না সেটাই অবিশ্বাস্য লাগে। আমার কাছে ও-ই ‘ফেস অব ক্রিকেট’। ভারতের মতো ক্রিকেটপাগল দেশে এই উন্মাদনা সামলে এত বছর এভাবে খেলে যাওয়াটা ভাবলেই তো কেমন লাগে। খেলা ছাড়ার আগে ও রেকর্ড-টেকর্ড যে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে!

একসঙ্গে অনেকবারই দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে মাঠে নেমেছেন দুই ভাই। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: নিউজিল্যান্ড দলে তো এখন আপনারা দুই ভাই। ক্রিকেটটা কি আপনাদের পারিবারিক উত্তরাধিকার?

ম্যাককালাম: আসলেই তাই। বাবা ওটাগোর পক্ষে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলেছেন। আমরা দুই ভাইও বাড়ির আঙিনায় ক্রিকেট খেলতে খেলতেই বড় হয়েছি। এখন একসঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলি, আমার কাছে এটা বড় আনন্দের ব্যাপার। এখন অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভাইয়ের ছড়াছড়ি, ৫-৬ জোড়া ভাই আছে। একটু অদ্ভুতই।

শুভ্র: সব সিরিয়াস সিরিয়াস প্রশ্ন হলো, এবার যদি ক্যারিয়ারের সবচেয়ে মজার ঘটনা জানতে চাই...

ম্যাককালাম: মজার ঘটনা তো অনেক। কোনটা বলি, কোনটা বলি..

শুভ্র: প্রথম ওয়ানডেতে তামিম ইকবালের ক্যাচ ধরে যে হাসিটা দিয়েছিলেন, তাতে তো মনে হয়, মাঠে এত মজা আর পাননি!

ম্যাককালাম: (জোরে হাসি) তামিম...ইয়েস, দ্যাট ওয়াজ ফানি। সেদিন ও আমাদের খুব ভুগিয়েছে, আমরাও চেষ্টা করেছি ওকে উত্ত্যক্ত করতে। এর বাইরে কিছু না। মজার ঘটনা যদি বলেন, দলের সবাই একসঙ্গে থাকা, ভ্রমণ করা—সব সময়ই মজার কিছু না-কিছু হয়ই। সব আবার বলাও যাবে না (হাসি)। টিমমেটদের মধ্যে যে মজাটা হয়, এটার আসলে কোনো তুলনা হয় না। আমার তো মনে হয়, এ কারণেই টেন্ডুলকার বিশ বছর খেলে যেতে পারল!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×