২০২০ টোকিও অলিম্পিক

অলিম্পিক পদক ও বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন

মেজর চাকলাদার (অব.)

৯ আগস্ট ২০২১

অলিম্পিক পদক ও বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন

দেখতে দেখতে ১৬ দিনের মহাযজ্ঞে শেষ হল টোকিও অলিম্পিক। বরাবরের মত `অংশগ্রহনই বড় কথা` মূলমন্ত্রে আরেকটি অলিম্পিক শেষ করলো বাংলাদেশ। তাছাড়া কেমন ছিল বাকিদের অলিম্পিক? পদক-তালিকারই বা কি অবস্থা? এক নজরে ঘুরে তাকানো যাক টোকিও অলিম্পিকে।

২৩ জুলাই-৮ আগস্ট। ১৬ দিন। সুইট সিক্সটিন। বিশ্বের সব আনন্দ, আবেগ, উচ্ছ্বাসের হৃদপিণ্ড ছিল টোকিও অলিম্পিক ২০২০। বিশ্ব ক্রীড়াপ্রেমীরা প্যারিসে ২০২৪-এর অলিম্পিক পর্যন্ত টোকিওর পাওয়া আর না পাওয়ার হিসাব কষবেন।

আমাদের উপমহাদেশের সাতটি দেশ, প্রায় পৌনে দুই শত কোটি মানুষের সাতটি দেশ মিলে পদক পেয়েছে সাতটি। একটি সোনা, দুইটা রূপা আর চারটি ব্রোঞ্জ (তামা)। সব পদক ভারতের। বাকি ৬টি দেশ প্যাসেন্জার, যায় আর আসে ।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, আফিমের চীনকে জাগিও না, ওরা আফিমেই বুঁদ হয়ে থাক। সেই চীন সব দিক দিয়েই বিশ্বে শ্রেষ্ঠ হবার দৌড়ে সামনে। টোকিওতে এই চীন পেয়েছে ৩৮টি সোনা আর ৩৯টি সোনা পেয়ে আমেরিকা এবার প্রথম ।

রাশিয়া দুই বছরের জন্য বিশ্ব ক্রীড়া থেকে বহিষ্কৃত, তাদের অ্যাথলেটদের রাশিয়া অলিম্পিক কমিটি (আরওসি) নাম দিয়ে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়। তারা পেয়েছে ২০টি সোনা, এদের ওপরে আছে স্বাগতিক জাপান ও ইংল্যান্ড। যথাক্রমে ২৭ ও ২২টি সোনা নিয়ে।

টোকিও ২০২০ অলিম্পিক হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালেই। করোনার কারণে তা এক বছর পিছিয়ে গেল। তবে গেমস ভিলেজেও করোনার হামলা চলছিল, স্থানীয় মানুষ বিক্ষোভও করেছিল বন্ধ করার জন্য, কিন্তু উদ্যোক্তাদের নাছোড়বান্দা মনোভাব যাবতীয় সংশয়কে উপড়ে ফেলে সফলতার প্রতীক হয়ে রইল। হবে না কেন, হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে আনবিক বোমা ফেলে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছিল শহর দুটিকে, সেই আঘাতকে বহন করেছে, তবে প্রতিহিংসায় না গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে আজ জাপান বিশ্বের বিস্ময় ।

কে কয়টা সোনা পেল বা অলিম্পিকের মতো বড় আয়োজন করল,  এ নিয়ে চিন্তা ভাবনাতে আমাদের দেশের ফায়দাটা কোথায়?১৯৭১ সালে রণকৌশলে অভিজ্ঞ পাকিস্তানকে নাকানি চুবানি খাইয়ে আমরা স্বাধীন হয়ে ছিলাম, কারণ আমরা একাত্ম ছিলাম ।আর আজ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোন দল গঠন করতে আমরা ব্যর্থ। কেননা দেশের চাইতে আমরা দলকে বড় মনে করি। দলে দলে সংঘাত আর লাগাম ছাড়া মন্তব্যের ঠ্যালায় সুষ্ঠু সুন্দর একটা ক্রীড়া পরিবেশ তৈরিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

এই সময়ে এসে কোন সুস্থ্ মগজ থেকে দোকানসহ স্টেডিয়াম তৈরির চিন্তা আসতে পারে! এই দোকানের ক্রেতা-বিক্রেতার গাদাগাদি পেরিয়ে কি একজন ক্রীড়াবিদ সুস্থ স্বাভাবিক মন নিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারে? ধরে রাখতে পারে তার মনসংযোগ? পারে না। বছর বছর ক্রীড়া পরিবেশহীন এই দেশের অ্যাথলেটরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করছেন আর ব্যর্থতার পাহাড় গড়ছেন ।

অংশগ্রহনের জন্যই অংশগ্রহন করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ছবি: রয়টার্স

টাকা দরকার। টাকা না থাকলে একজন খেলোয়াড় উপযুক্তভাবে গড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত খাদ্য পাবে কোথায়? ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপত্তাবোধ না থাকলে কীভাবে সে উজাড় করে দেবে নিজেকে?

সব খেলাতে একই অবস্থা। হকি লিগ তিন বছর থেকে নাই, লিগ হলে তো ক্লাবগুলো প্লেয়ারদের টাকা দেবে। এদের দিন কিভাবে চলছে? হকির গত সভাপতি তাঁর তিন বছরে লিগ, টুর্নামেন্ট, জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ কোনোটাই করতে পারেন নাই। স্পনসর আনতে পারেন নাই, তবে গদিতে ছিলেন ঠিকই। এই গদি ধরে থেকে কী লাভ? কদিন আগে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের অ্যাথলেটিকস ট্রাকের একটি ছবি দেখে ছিলাম, ট্রাকের গর্ত ঢাকতে ওই গর্তের মধ্যে একটা ডাব ঢুকিয়ে রেখেছে। ক্রীড়া নিয়ে কর্মকর্তারা কতখানি উদাসীন হলে ট্র্যাকের হালহকিকত এত নিকৃষ্ট হয়! খুঁজলে প্রায় সব ফেডারেশনগুলোতেই এই দৈন্যদশা দেখবেন।

পঞ্চাশ বছর পরও দেশের ক্রীড়াজ্ঞনের এই চিত্র, তা হলে কি করে আশা করবেন, ২০২৪-এর প্যারিস অলিম্পিকে যাবার কোয়ালিফাইং স্তর পার হবেন? ভারত খেলোয়াড়দের বিদেশে রেখে প্রয়োজনে নিজের পছন্দের কোচ দিয়ে পদক লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করেছে, এত কিছু করেও  সবেধন একটি সোনা। তাহলে বুঝুন, অলিম্পিকে সাফল্য পাওয়াটা কত কঠিন। 

এই পঞ্চাশ বছরে ক্রীড়া কাঠামো কখনই অলিম্পিক পর্যায়ের ছিল না। সবার আগে দরকার প্রচুর মানসম্মত স্টেডিয়াম আর সরকারি অর্থ ব্যায়ে ৬/৭ বছর বয়স থেকেই শিশুদেরকে মানসম্মত প্রশিক্ষণ দেওয়া, যা চীন করে থাকে। আমরা ওদের মতোই রক্ত-মাংসের মানুষ, ওরা পারলে আমরাও পারব। অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন হাম হোঙ্গে কামিয়াব' বলে ১৩০ কোটি লোকের হয়ে মাত্র সাতটি পদক পেয়েছে। অলিম্পিকের পদক গলা বাজি দিয়ে আসে না... তাই বক্তৃতা না করে গড়ে তুলতে হবে মান সম্মত ক্রীড়াবিদ।

লেখক সাবেক জাতীয় হকি দলের অধিনায়ক এবং জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×