স্যার গ্যারির ধমক খেতে খেতে যে ইন্টারভিউ

উৎপল শুভ্র

২৮ জুলাই ২০২১

স্যার গ্যারির ধমক খেতে খেতে যে ইন্টারভিউ

স্যার গারফিল্ড সোবার্স

জীবনে কত ইন্টারভিউই না করেছি! ইন্টারভিউ পেতে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে, ইন্টারভিউ করার সময়ও কখনো কখনো। তবে স্যার গ্যারি সোবার্সকে ইন্টারভিউটা হয়ে আছে একেবারেই ব্যতিক্রমী। ইন্টারভিউয়ের প্রায় পুরোটা সময়ই যে প্রশ্ন আর উত্তরের ফাঁকে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের ধমক খেতে হয়েছে!

স্যার গ্যারি সোবার্সের কাছে ক্রিকেটের বৃহত্তর একটা অর্থ আছে। সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের কাছে ক্রিকেট মানে—সবার ওপরে বিনোদন সত্য, তাহার ওপরে নাই। নিজে ক্রিকেটটা ওভাবেই খেলেছেন, এখনো সবাইকে ওভাবেই খেলতে দেখতে চান। এ কারণেই সে সময়, মানে ২০০৯ সালে যখন তাঁর ইন্টারভিউ করি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্রিয়াশীল ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় হিসেবে বলেছিলেন বীরেন্দর শেবাগের নাম। কারণটাও বলে দিয়েছিলেন একটা দারুণ বাক্যেই: ক্রিকেটটা যেভাবে খেলা উচিত, ও ওভাবেই খেলে।

সোবার্সের ক্রিকেট মানে ছিল আনন্দের নির্ঝরিণী। ব্যক্তি সোবার্সও নাকি তা-ই। এভার্টন উইকস তো তাঁর প্রিয় ব্যাটসম্যান হিসেবে সোবার্সের নাম বলে সঙ্গে এটা যোগ করে দেওয়াটাকে কর্তব্য বলে মনে করতেন যে, 'ও যত বড় ক্রিকেটার ছিল তার চেয়েও বড় মানুষ।'

প্রথম পরিচয়ে আমারও তা-ই মনে হয়েছিল। বারবাডোজে নিজের নামে বেশ কয়েক বছর ধরে একটা স্কুল টুর্নামেন্টের আয়োজন করে আসছেন। সেটির উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত ককটেল পার্টিতে সোবার্সকে দেখে তো মুগ্ধ। এত সহজভাবে সবার সঙ্গে মিশছেন। তারকাসুলভ অহমিকার কোনো চিহ্নই নেই। পরিচয় দিতেই হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন। মুঠোতে আমার হাত ধরে রেখেই বললেন, 'হোপ ইউ আর এনজয়িং ক্যারাবিয়ান।'

আমি বললাম, 'ক্যারাবিয়ান আমি সব সময়ই এনজয় করি। এর আগেও দুবার ক্যারাবিয়ানে ট্যুর করেছি। আশা করি, ভবিষ্যতেও আরও করব।' শুনে এমন খুশি হলেন যে, যেন আমার এই সার্টিফিকেটটা ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের জন্য খুব জরুরি ছিল। ছবি তুলতে চাইতেই কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে পোজ দিলেন। আমার হাতে তখনো স্মার্টফোন ওঠেনি। ডিজিটাল ক্যামেরার কী একটা ঝামেলায় ছবিটা এমন ঝাপসা এলো যে, বলে দিলে না বোঝার উপায় নেই কোনটা কে। তারপরও একটা স্মৃতির স্মারক তো বটেই। এমনই দুর্ভাগ্য, সেই ছবিটাও হারিয়ে ফেলেছি।

ছবি তোলার সময়ই আসল উদ্দেশ্যের কথাটা বলে ফেললাম। ইন্টারভিউ চাই। 'দাঁড়ান, আগে আজকের প্রোগ্রামটা শেষ হোক' বলে সোবার্স হাসিমুখে সম্মতি জানালেন। আমি ইন্টারভিউ নিতে যতটা আগ্রহী, তিনি ইন্টারভিউ দিতে যেন তার চেয়েও বেশি।

প্রোগ্রাম শেষ হতে হতে অনেক রাত। অতিথিদের বিদায় দিচ্ছেন স্যার গ্যারি। এরই ফাঁকে পাশে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, সোবার্সের চোখে তখন রক্তাভা, কথাবার্তাও একটু জড়িয়ে আসছে। খেলোয়াড়ি জীবনেও সারা রাত পার্টি করে পরদিন টেস্ট সেঞ্চুরি করার কীর্তি আছে তাঁর। টিম কারফিউ এড়িয়ে সেই পার্টিতে যাওয়ার নানা কৌশল নিজেই সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন আত্মজীবনীতে। বয়সকে পাত্তা না দিয়ে এখনো পার্টি মানেই আকণ্ঠ পান। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই অবশ্য ইন্টারভিউয়ের কথা ঠিকই মনে পড়ে গেছে, 'ওহ্ ইন্টারভিউ! আমার অবস্থা কী, তা দেখতেই পাচ্ছেন। এখন কথা বলা কঠিন হবে।'

তাহলে কখন? সোবার্সের যেন উত্তরটা ঠিক করাই ছিল, 'সাভানা হোটেল চেনেন?'

আমি বললাম, 'চিনি না। তবে চিনে নিতে পারব। ওখানে কী?'

সোবার্স হাত দিয়ে অপসৃয়মান স্কুল ছাত্রদের দেখিয়ে বললেন, 'আগামীকাল সকাল সাতটায় সাভানা হোটেলে ওদের জন্য ব্রেকফাস্ট পার্টি। ওখানে চলে আসুন। সময় নিয়ে মন খুলে কথা বলা যাবে।'

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা, সময় পার্থক্যের কারণে ভোরবেলায় উঠে লিখতে বসতে হয়। সোবার্সের ইন্টারভিউ করব বলে তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েই উঠে পড়তে হলো শেষ রাতে। কোনোমতে লেখা শেষ করে ওই হোটেলে দৌড়। গিয়ে দেখি, ব্রেকফাস্ট পার্টি শেষে স্কুল ক্রিকেটের দলগুলোর অধিনায়ক-কোচ ম্যানেজারদের টুর্নামেন্টের বাইলজ বুঝিয়ে দেওয়ার পর্ব চলছে। চলছে তো চলছেই। নানা জনের নানা প্রশ্ন আর শেষ হয় না। স্যার গ্যারি একটু বিরক্ত মুখেই মঞ্চে বসে আছেন। অন্যরা সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন।

স্যার গ্যারি সোবার্সের এই হাসিমুখ দেখেছি ইন্টারভিউ শেষ হওয়ার পর

এসব শুনলে এমনিতেই ঘুম-ঘুম লাগে। আর আমার তো আগে থেকেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। বিরক্তও লাগছে কখনো কখনো। নিজেই তখন নিজেকে বলছি, আরে বোকা! একটু কষ্ট না হয় কর্। একটু পর স্যার গ্যারি সোবার্সের ইন্টারভিউ করবি। এই সুযোগ কি প্রতিদিন আসে নাকি?

সব কিছুই এক সময় শেষ হয়। এই প্যাচালও শেষ হলো। সবাই হলরুম ছেড়ে চলে যেতে শুরু করতেই আমি সোজা মঞ্চে। স্যার গ্যারি আমাকেই আগেই দেখেছেন। বিভিন্ন স্কুলের অধিনায়ক-কোচ-ম্যানেজাররা ভিন্ন ভিন্ন টেবিলে বসেছেন। আমি একা বসেছি একটা টেবিলে। চোখে না পড়ে তাই উপায় নেই। কয়েকবার স্যার গ্যারির সঙ্গে চোখাচোখিও হয়েছে। 

'এখানেই বসে ইন্টারভিউটা সারব, নাকি অন্য কোথাও' জিজ্ঞেস করতেই সোবার্স বললেন. 'আপনি বারবাডোজ নিয়ে কথা বলবেন তো! তাহলে ইন্টারভিউ হবে । আমি কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে কথা বলব না।'

সাত সকালে আমার হোটেল সাভানায় বসে এতক্ষণ প্যাচাল শোনার উদ্দেশ্যও তাঁর অজানা নয়। অথচ মঞ্চ গিয়ে 'স্যার গ্যারি, আমরা কি এখানেই বসে ইন্টারভিউটা সারব, নাকি অন্য কোথাও' জিজ্ঞেস করতেই সোবার্স বললেন. 'আপনি বারবাডোজ নিয়ে কথা বলবেন তো! তাহলে ইন্টারভিউ হবে । আমি কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে কথা বলব না।'

বলে কি! বারবাডোজ নিয়ে কথা বলতে আমার বয়েই গেছে। ক্রিকেট নিয়ে কথা না বললে আর সোবার্সের পেছনে ঘুরছি কেন? সোবার্স এমনভাবে কারণটা বুঝিয়ে বললেন, যেন আমার এই ইন্টারভিউয়ের ওপরই তাঁর চাকরি নির্ভর করছে। 'দেখুন, আমি বারবাডোজ সরকারের পর্যটনবিষয়ক বিশেষ দূত। আমার কাছ হলো, বারবাডোজে যাতে আরও বেশি বেশি পর্যটক আসে, সে ব্যাপারে সাহায্য করা। এ কারণে আমি শুধু এখন বারবাডোজ নিয়েই ইন্টারভিউ দিই।'

শুনে তো আমার বজ্রাহত হওয়ার দশা। এত কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত কি না বারবাডোজ নিয়ে ইন্টারভিউ! একটু রাগও যে হলো না, তা নয়। মনের ভাব চেপে রেখে আমি হাসি-হাসি মুখ করে বললাম, 'স্যার গ্যারি, বারবাডোজ আমারও খুব প্রিয়। বারবাডোজ নিয়ে অবশ্যই কথা বলব। কিন্তু আমি তো স্পোর্টস রিপোর্টার। স্যার গ্যারি সোবার্সকে শুধু বারবাডোজ নিয়ে ইন্টারভিউ করলে লোকে কী বলবে! কেউ তো তা পড়বেও না। একটু ক্রিকেট না থাকলে কীভাবে হয়!'

সোবার্সের মুখটা একটু নরম হতে দেখলাম। পাশে বসার ইঙ্গিত করে বললেন, 'ওকে। লেটস্ স্টার্ট।'

স্টার্টটা বারবাডোজ দিয়েই করতে হলো। দু'তিনটি 'ফিল গুড' প্রশ্ন করেই যে-ই ক্রিকেটে গিয়েছি, অমনি স্যার গ্যারির সপ্রতিভ ভাব উধাও। প্রায় পুরো ইন্টারভিউ জুড়েই এমন চলল। মাঝেমধ্যে ধমক-টমকও দিয়ে গেলেন অকাতরে। সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের দুর্ব্যবহারকেও অনেক পাওয়া ভেবে আমি নাছোড়বান্দার মতো প্রশ্ন করে গেছি বলেই ইন্টারভিউটা হয়েছে। বেশ কয়েকবার রাগত স্বরে মনে করিয়ে দিলেন, আমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। 'এনাফ ইজ 'এনাফ' বলে চেয়ার ছেড়ে চূড়ান্ত উঠে পড়ার আগেও দুবার উঠে পড়ার উপক্রম করলেন—তবে রাগত স্বরে হলেও ঠিকই উত্তর দিয়ে গেলেন আমার প্রশ্নের। 

তখন তো আর আমার কার্যকারণ নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা নয়। তবে পরে মনে হয়েছে, একদিকে নিজেকে ভালো মানুষ প্রমাণ করার দায়, অন্যদিকে কিছুদিন ধরে ‘সোবার্স' নামটাকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে আসার অভ্যাস—এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই তাঁর অমন রুক্ষ আচরণ। বারবাডোজের সাংবাদিক বন্ধুরা তো সোবার্সের ইন্টারভিউ পেয়েছি জেনেই অবাক। অনেক দিনই নাকি টাকা-পয়সা ছাড়া ইন্টারভিউ দেন না। ২০০৭ বিশ্বকাপের সময় তো নিজেই দেখেছি, বারবাডোজের টেস্ট ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া লিজেন্ডস ক্লাবে বসে আছেন সোবার্স। কেউ বললেই সাগ্রহে ছবি তুলছেন তাঁর সঙ্গে। তবে সেটি টাকার বিনিময়ে, অটোগ্রাফ-ফটোগ্রাফ সবকিছুরই রেট নির্দিষ্ট। আরেকটা অদ্ভুত দৃশ্যও দেখেছিলাম সেবার। স্যার গ্যারি একটা রুমে বসে ম্যাগাজিন পড়ছেন। দরজায় দাঁড়িয়ে এক ভারতীয় সাংবাদিক ছবি তুলতে যেতেই ম্যাগাজিনটা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন।

আত্মজীবনীতে দেওয়া স্যার গ্যারি সোবার্সের সেই অটোগ্রাফ

সোবার্সের অমন ব্যবহারের সম্ভাব্য যে কারণটার কথা বললাম, সেটির পক্ষে আরও যুক্তি খুঁজে পেলাম ইন্টারভিউ শেষের সোবার্সকে দেখে। অটোগ্রাফ নেব বলে তাঁর 'টোয়েন্টি ইয়ার্স অ্যাট দ্য টপ' নামে আত্মজীবনীর একটা কপি নিয়ে গিয়েছিলাম। তাতে অটোগ্রাফ দিতে দিতে বললেন, 'ইন্টারভিউয়ে যদি আমার ক্রিকেট লাইফ নিয়ে সব বলে ফেলি, তাহলে এই বই কেউ কেন কিনবে?' বলার সময় অবশ্য মুখে হাসি ফুটেছে। হাসি বেরিয়ে যাওয়ার সময়ও। 

হোটেলের রাস্তা ভুল করে ঘোরানো-পাচানো রাস্তা ভুল করে লিফট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হেসে বললেন, 'আমার সঙ্গে আসুন। আমিও বেরিয়ে যাব।' একসঙ্গে লিফটে নামার সময়ও টুকটাক কথাবার্তা হলো। কোন হোটেলে উঠেছি, সেখানে কীভাবে যাব জানতে চাইলেন। লিফটও দিতে চাইলেন নিজের গাড়িতে। আমার হোটেল তাঁর রাস্তার উল্টো দিকে জেনে আমিই ধন্যবাদ দিয়ে নিরস্ত করলাম। গাড়ির কি-হোলে চাবি ঢুকিয়ে ঢাকায় টেস্ট খেলার স্মৃতিচারণা করলেন। মুখে একটু আগের বিরক্তির লেশমাত্রও নেই।

সোবার্সের ইন্টারভিউটার কথা মনে হলে আমারও এখন বিরক্তির পরিবর্তে মজাই লাগে। গৎবাঁধা ইন্টারভিউ তো জীবনে অনেক করেছি। সোবার্স অমন চেহারায় দেখা দিয়েছিলেন বলেই তো তাঁর ইন্টারভিউটা আর দশটা ইন্টারভিউয়ের একটা না হয়ে এমন স্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা হয়ে রয়েছে!

ধন্যবাদ, স্যার গ্যারি!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×