জ্যাক গ্রেগরি

গ্লাভস ছাড়াই ব্যাটিং করতেন যিনি!

খেলা ছাড়ার প্রায় এক শতাব্দী পরও সময়ের হিসেবে টেস্টে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডটি তাঁর, এক সিরিজে সবচেয়ে ক্যাচ নেওয়ারও

উৎপল শুভ্র

৭ আগস্ট ২০২১

গ্লাভস ছাড়াই ব্যাটিং করতেন যিনি!

জ্যাক গ্রেগরি গ্লাভস ছাড়াই ব্যাটিং করেছেন সারা জীবন

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের প্রথম গ্রেট অলরাউন্ডার। অলরাউন্ডার সবার্থেই। বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান, বলে আগুন ঝরানো বোলার, দুর্দান্ত ফিল্ডার। এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ডটি এখনো তাঁর, সময়ের হিসেবে টেস্টে দ্রুততম সেঞ্চুরিরও। এর চেয়েও বিস্ময়কর বলে মানতে হবে, কোনোদিন গ্লাভস পরে ব্যাটিং করেননি জ্যাক গ্রেগরি। ব্যাট আর প্যাড ছাড়া বাকি সব বাহুল্য করতেন বলে টুপিও পরেননি, গার্ড-ও না!

ডন ব্র্যাডম্যানের যে টেস্টে শুরু, সেই টেস্টেই তাঁর শেষ। শেষটা বড় করুণ। নিজের বলেই ক্যাচ ধরতে গিয়ে আগে থেকেই নড়বড়ে হাঁটুটা একেবারে ধসে পড়ল। ‘আমার ক্যারিয়ার শেষ’—আর্ত চিৎকারে নিজেই জানিয়ে দিয়েছিলেন দুঃসংবাদটা। টেস্টের দ্বিতীয় দিন সতীর্থদের কাঁধে ভর দিয়ে ব্রিসবেনের এক্সিবিশন গ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে গেলেন। বেরিয়ে গেলেন টেস্ট ক্রিকেট থেকেই।

আজকের কথা নয়। জ্যাক মরিস গ্রেগরি ক্রিকেট মাঠ থেকে শেষবারের মতো বেরিয়ে যাচ্ছেন—এই দৃশ্যের ওপর ধুলো জমছে প্রায় ৯৩ বছর ধরে। ব্যাটে-বলে তাঁর কীর্তি অবশ্য একটুও ধূসর নয়। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের প্রথম গ্রেট অলরাউন্ডার, ‘ব্যাটে-বলে’ কথাটা তাই ঠিকই আছে। তবে জ্যাক গ্রেগরির যে বিশ্ব রেকর্ডটি এখনো দেদীপ্যমান, সেটি ব্যাটে বা বলে নয়। ১৯২০-২১ অ্যাশেজ সিরিজে পাঁচ টেস্টে ক্যাচ নিয়েছিলেন ১৫টি। এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি ক্যাচ নেওয়ার এই রেকর্ডটি এখনো তাঁর।

দেখুন তো কাণ্ড, ‘আসল’ বিশ্ব রেকর্ডটির কথাই কেমন বেমালুম ভুলে গেছি! ক্যাচের বিশ্ব রেকর্ডটি অনেক সময় আড়ালে পড়ে থাকে। জ্যাক গ্রেগরি নামটি উচ্চারিত হলে প্রথম তো মনে পড়ে ৭০ মিনিটে করা ওই সেঞ্চুরিই, সময়ের হিসাবে এখনো যা দ্রুততম। বলের হিসাবেও দ্রুততম হয়ে ছিল ৬৫ বছর। ১৯২১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জোহানেসবার্গে ওই সেঞ্চুরি এসেছিল মাত্র ৬৭ বলে। ১৯৮৫ সালে ৫৬ বলে সেঞ্চুরি করে সেই রেকর্ড ভেঙে দেন ভিভ রিচার্ডস।

ক্যাচ-সেঞ্চুরি নিয়ে এত কথা হচ্ছে, অথচ জ্যাক গ্রেগরির আসল পরিচয়টা কিন্তু ফাস্ট বোলার। ফাস্ট বোলাররা নাকি জুটি বেঁধে শিকার করে। এই ব্যাপারটির সঙ্গে ক্রিকেট-বিশ্বের প্রথম পরিচয় করিয়ে দেওয়াতেও বড় ভূমিকা গ্রেগরির। ‘গ্রেগরি অ্যান্ড ম্যাকডোনাল্ড’ কথাটা ক্রিকেট ইতিহাসের মনোযোগী ছাত্রের মনে অন্য রকম একটা অনুরণন তোলে। জ্যাক গ্রেগরি ও টেড ম্যাকডোনাল্ডই যে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম বিধ্বংসী পেস জুটি। মাত্র ১১টি টেস্ট খেলেছেন একসঙ্গে। সেটিও ১৯২১ সালে মাত্র ১০ মাসের মধ্যে। ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে আর্থিক নিরাপত্তার হাতছানিতে ম্যাকডোনাল্ড টেস্ট ক্রিকেট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ানদের হতাশ করেছেন, তবে ইংলিশ আর দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানদের মনে তা বইয়ে দিয়েছিল আনন্দের প্রস্রবণ। যাক, দুই প্রান্ত থেকেই আগুনে গোলা তো আর সামলাতে হবে না!

কাকতালীয়ই বলতে হবে, ম্যাকডোনাল্ডের বিদায়ের পর গ্রেগরি আর আগের গ্রেগরি থাকেননি। সেটির কারণ অবশ্য ওই হাঁটু। ১৯২২ সালে কার্টিলেজে অস্ত্রোপচার তো আর এখনকার মতো সাধারণ কিছু ছিল না। তা করানোর পর ১৯২৪-২৫ অ্যাশেজের আগে আর মাঠেই ফিরতে পারেননি। সেই সিরিজেও ২২ উইকেট, তবে বোলিংয়ে ঝাঁজটা ঠিক আগের মতো ছিল না।

জ্যাক গ্রেগরি ও টেড ম্যাকডোনাল্ড: টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ফাস্ট বোলিং জুটি২৪ টেস্টে দুটি সেঞ্চুরিসহ ১১৪৬ রান, ৮৫ উইকেট ও ৩৭ ক্যাচ—এই পরিসংখ্যান জ্যাক গ্রেগরির অলরাউন্ডের সামর্থ্যের কিছুটা প্রমাণ তো বটেই। তবে সংখ্যায় কি আর সব লেখা থাকে! এই অবিশ্বাস্য তথ্যটাই তো এখানে নেই যে, জ্যাক গ্রেগরি ব্যাটিংয়ের সময় কখনো গ্লাভস পরেননি! ব্যাটিংয়ের সময় ব্যাট আর প্যাড ছাড়া বাকি সবকিছুকেই বাহুল্য মনে করতেন বলে মাথায় টুপি পর্যন্ত পরতেন না, এমনকি গার্ড’ও না!

ছয় ফুট উচ্চতার গ্রেগরি ছিলেন দারুণ সুদর্শন। সঙ্গে অমন ঝাঁজালো ব্যাটিং-বোলিং মিলে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধোত্তর অস্ট্রেলিয়ায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন পৌরুষের প্রতীক। এরপর ‘রমণীমোহন’ বলাটা বাহুল্যই। তবে এটা জানানো যেতেই পারে যে, ক্রিকেট থেকে বিদায় নেওয়ার মাস ছয়েক আগে বিয়ে করেছিলেন সে সময়ের ‘মিস অস্ট্রেলিয়া’কে।

চেহারা-ছবি, ব্যাটিং করার ধরন মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় জ্যাক গ্রেগরি হয়ে উঠেছিলেন পৌরুষের প্রতীকক্রিকেটটা রক্তেই ছিল। তাঁর দুই চাচা ডেভ ও নেড গ্রেগরি খেলেছেন ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচে। এর মধ্যে ডেভ গ্রেগরি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রথম টেস্ট অধিনায়ক। জ্যাকের চাচাতো ভাই সিড গ্রেগরি (নেডের ছেলে) ৫৮টি টেস্ট খেলেছেন। অ্যাশেজে সবচেয়ে বেশি, ৫২টি টেস্ট খেলার রেকর্ড এখনো তাঁর। জ্যাক গ্রেগরির বাবাও ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলেছেন, যে কৃতিত্ব আছে সিড ছাড়াও তাঁর আরেক চাচাতো ভাইয়ের। সব মিলিয়ে ইংল্যান্ডের ‘গ্রেস পরিবার’ বা পাকিস্তানের ‘মোহাম্মদ পরিবার’কেও ছাপিয়ে যেতে চায় অস্ট্রেলিয়ার ‘গ্রেগরি পরিবার’।

ক্রিকেট বা ক্রিকেটের বাইরের বিস্তীর্ণ জগৎ নিয়ে জ্যাক গ্রেগরি কী ভাবতেন, এটি জানার অবশ্য কোনো উপায় নেই। আত্মজীবনী-টীবনী তো লিখেনইনি, সাংবাদিকদেরও বিষবৎ পরিত্যাজ্য জ্ঞান করে এসেছেন আমৃত্যু। কারণ কী জানেন, ক্যারিয়ারের শেষ বছরে কোন সাংবাদিক নাকি তাঁকে ‘মিসকোট’ করেছিলেন!

সবই বোঝা গেল। কিন্তু একটা প্রশ্ন পাঠকের মনে খেলা না করে পারেই না। হঠাৎ করে এই জ্যাক গ্রেগরি-কীর্তন কেন? কারণ তো আছেই। ১৯৭৩ সালের এই দিনেই ৭৮ ছুঁই-ছুঁই বয়সে পৃথিবী ছেড়ে গেছেন জ্যাক গ্রেগরি। আজ তাঁর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী।


 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×