অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর, অধিনায়কত্ব হারানোর পর

উৎপল শুভ্র

৯ আগস্ট ২০২১

অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর, অধিনায়কত্ব হারানোর পর

যতবার `সাকিব কেন সাকিব` এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি, ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা, ক্ষুরধার ক্রিকেটমস্তিষ্ক—সব কিছু ছাপিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাস সবার আগে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গেই থেকেছে ইস্পাতকঠিন এক মন। চেনা সাকিব অচেনা সাকিব-এর তৃতীয় পর্বে আজ সাকিবের অধিনায়কত্ব অধ্যায়।

সাকিবের সহজাত নেতৃত্বগুণ বোঝাতে মাশরাফি সব সময়ই দুটি উদাহরণ দেন। অধিনায়ক হিসেবে নিজে প্রবাদপ্রতিম এক উচ্চতায় উঠে গেছেন। মাশরাফির তাই ভালোই জানা, ক্যাপ্টেনসি করতে একটা মানসিক প্রস্তুতি লাগে। কোনোবারই সাকিব যেটি নেওয়ার সুযোগ পাননি। মাশরাফি এতে এমনই মুগ্ধ যে সাকিবেরই দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব করা উচিত—এই বিশ্বাস থেকে কখনোই সরেননি। সেটি ঘোষণাও করে দিয়েছিলেন। সাকিব যখন আবার টি-টোয়েন্টিতে অধিনায়ক হয়েছেন, তখন এ কথা বললে খুবই স্বাভাবিক হতো।

কিন্তু মাশরাফির এই কথা ২০১৬ সালে। সিরিজটা সম্ভবত জিম্বাবুয়ের সঙ্গেই ছিল। খুলনায় টিম হোটেলে মাশরাফিকে সহজেই এবং সাকিবকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একসঙ্গে বসতে রাজি করিয়েছি। ব্যতিক্রমী ওই সাক্ষাৎকারের সময়ই মাশরাফির ওই ব্যতিক্রমী ঘোষণা। 'ব্যতিক্রমী' কী বলছেন, সেই কারণে নয়। কখন বলছেন, এই কারণে। মাশরাফি নিজে তখন ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক। মুশফিকুর রহিম টেস্টের। তারপরও দলে সমস্যা হতে পারে জেনেও মাশরাফি মনের কথা বলে দিয়েছিলেন। হয়তো সাকিবকে নিয়ে এমন কিছু বললে মুশফিকও মাইন্ড করবেন না জেনেই।

মাশরাফির সঙ্গে কিছুদিন মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা চলার পর সাকিব দীর্ঘ মেয়াদে প্রথম অধিনায়কত্ব পেলেন ২০১১ বিশ্বকাপের আগে। তাঁর বড় একটা ইন্টারভিউ করেছিলাম তখন । ‘অধিনায়ক সাকিব’ হেডিং দিয়ে যা পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হয়েছিল। যেখানে অধিনায়কত্ব নিয়ে নিজের দর্শনের কথা বলেছিলেন, দীর্ঘমেয়াদি অনেক পরিকল্পনার কথাও। সৌরভ গাঙ্গুলী যেমন ভারতীয় দলে নিজের ছাপ রেখে গেছেন, স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের গায়েও এমন 'সাকিবীয়' চিহ্ন এঁকে দেওয়ার।

সাত মাস পর আবারও পুরো এক পৃষ্ঠাজুড়ে সাকিবের সাক্ষাৎকার। এবারের হেডিং 'অধিনায়কত্ব হারানোর পর'। যে কারণে অধিনায়কত্ব হারিয়েছিলেন, সেটির মূলে ছিল বলতে গেলে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে লেগেছে' স্টাইলে জিম্বাবুয়ে চলে যাওয়া। অথচ 'জিম্বাবুয়ে বিপর্যয়' এর পর সাকিব আর তামিমকে 'বলির পাঁঠা' বানিয়ে কেড়ে নেওয়া হলো তাঁদের অধিনায়কত্ব ও সহ-অধিনায়কত্ব। এত দিন পরও এই বিশ্বাস থেকে সরার কোনো কারণ দেখছি না যে এটি ছিল বোর্ডের একটি মহলের পূর্বপরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন। সাকিবের কাউকে অকারণে পাত্তা না দেওয়ার স্বভাব আগে থেকেই চটিয়ে রেখেছিল অনেককে। পরাজয়টা সেসবের শোধ নেওয়ার কাজটাকে সহজ করে দিয়েছিল, এই যা! কথাটা হয়তো একটু বেশি কড়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই সফরে বাংলাদেশ দলের শেফ ডি মিশন শফিকুর রহমান মুন্না যেভাবে একেবারে নিয়ম করে সাংবাদিকদের সাকিব আর তামিম সম্পর্কে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, তাতে অনুমান করেছিলাম ভেতরে কিছু একটা ঘোঁট পাকাচ্ছে। তাঁর সেই চেষ্টা যে সফল হচ্ছে, ট্যুরে থাকতেই তা টের পাচ্ছিলাম। অনেক পত্রিকায় মাঠের খেলার চেয়ে মাঠের বাইরের খবর এত বেশি বড় হয়ে উঠেছিল যে ঢাকা থেকে আমার সহকর্মীরাও তখন প্রশ্ন করেছেন, 'কী ব্যাপার, অন্য পত্রিকায় দেখছি, বাংলাদেশ দলের মধ্যে এত কিছু হচ্ছে, আর আপনি কিছুই লিখছেন না!'

আমি লিখিনি, কারণ আমার কাছে সেসব লেখার মতো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি। ওই সফরে সাকিবের মাঠের ক্যাপ্টেনসিতেও আমি কোনো সমস্যা দেখিনি। একটা ব্যাপারই একটু চোখে লেগেছিল, মাঠের বাইরে দলের বাকি খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাঁর ছাড়া ছাড়া ভাব। মাঠের বাইরে তাঁর আরেকটু তৎপর হওয়া উচিত ছিল, পরে এ কথা নিজেও স্বীকার করেছেন। যদিও সাকিবের অধিনায়কত্ব-দর্শনে সারাক্ষণ খেলোয়াড়দের সঙ্গে লেপ্টে থাকায় বিশ্বাস নেই । দলের সবাই প্রাপ্তবয়স্ক, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার—তাঁদের এত বোঝানোর কী আছে, কথাটায় হয়তো যুক্তিও আছে। ক্যাপ্টেনসির তো আর বাঁধাধরা কোনো নিয়ম নেই। একেকজনের স্টাইল একেক রকম। সাকিব দাবি করেছিলেন, যখন দরকার মনে করেছেন, তখন যাকে যা বলার, তা ঠিকই বলেছেন। সুনির্দিষ্ট দুটি উদাহরণও দিয়েছিলেন।

‘প্রথম ম্যাচে খারাপ করার পর এক প্লেয়ারের খুব মন খারাপ দেখে আমি বললাম, তুই এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? আমি বলছি, তুই পাঁচটা ম্যাচই খেলবি। এমন ভেঙে পড়লে ভালো খেলবি কীভাবে?'

জানতে চাওয়ার পরও এই ক্রিকেটারের নামটা বলেননি। তবে মুশফিকের ঘটনাটা নাম উল্লেখ করেই বলেছিলেন। মুশফিক খুব টেনশন করেন জেনে তাঁকে বলেছেন, 'আপনি এত টেনশন করছেন কেন? সর্বোচ্চ কী খারাপ করতে পারেন আপনি! জিরো মারতে পারেন, এই তো! তা জিরো মারলে তো আর আপনি মরে যাবেন না। এত ভাবার কী আছে।' এটা বলার পর ‘মুশফিক ভাই' নাকি অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিলেন। হেসেছিলেন বলেও শোনা যায়।

যে কারণে এই পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটা, এবার সেটি বলি। সাকিব-তামিমকে সরিয়ে দেওয়াটাকে যে অন্যায় মনে হয়েছিল, সেটি তো বলেছিই। এর প্রতিবাদে জ্বালাময়ী দুটি লেখাও লিখে ফেলেছি। এর একটি ‘সাকিব-তামিমকে শিক্ষা' শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন। যেটির মূল বক্তব্য, নানা ঘটনায় সাকিব-তামিমের প্রতি তৈরি হওয়া আক্রোশ থেকে তাঁদেরকে শিক্ষা দিতেই এই সিদ্ধান্ত। ব্যতিক্রমীভাবে যা প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে।সাকিবের সেই সাক্ষাৎকার।

বড় ধাক্কাটা খেলাম সাকিবের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে। যেভাবে অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন, তাতে নিশ্চিত হয়েই গিয়েছি, বিস্ফোরক একটা ইন্টারভিউ হতে যাচ্ছে। রাগে-ক্ষোভে গজগজে এক সাকিবকেই পাব সেই স্বাভাবিক ব্যাপারটিই ঘটল না ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনেকবার জিজ্ঞেস করার পরও রাগ-ক্ষোভের সর্বোচ্চ যে প্রকাশ পেলাম, তা হলো, আমিও তো মানুষ, একটু খারাপ তো লেগেছেই।' পুরো ট্যুরে এবং সেখান থেকে ফিরে আসার পরও সাকিব সম্পর্কে আজেবাজে অনেক কথা বলে গেছেন শেফ ডি মিশন। সাকিবের অধিনায়কত্ব হারানোয় তাঁর দেওয়া রিপোর্টেরও বড় ভূমিকা। অথচ তাঁর সম্পর্কেও একটা কটূক্তি করলেন না সাকিব। পুরো ব্যাপারটিই এমন অবাস্তব লাগছিল যে একসময় জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম, 'আপনি মানসিকভাবে খুব শক্ত, কিছুতেই কিছু আসে যায় না—এটা বোঝানো কি এতই জরুরি যে এমন স্বাভাবিক থাকার ভান করছেন?'

সাকিব মৃদু হাসিতে উত্তর দিয়েছেন, 'ভান কেন হবে, আমি সব সময়ই এমন ৷ সহজেই কোনো কিছুতে বিস্মিত, মর্মাহত বা আনন্দে আত্মহারা হই না।' টাটকা প্রমাণও হাজির করেছেন, 'অধিনায়কত্ব হারানোর পর আমি যে ট্রেনিংয়ে যোগ দিয়েছি, কেউ বলুক, আমি কোনো কিছু কম করেছি কি না। আমাকে কেউ একটুও মন খারাপ দেখেছে কি না! অধিনায়কত্ব হারানোর পর বাংলাদেশেরই এক ক্রিকেটারের মুখে যেখানে শুনেছি, 'বাবার মৃত্যুর পর এত কষ্ট কখনো পাইনি'; সাকিব উল্টো সেটি নিয়ে রসিকতার ঢঙে বলেছেন, 'এখন আবার বাউন্ডারিতে ফিল্ডিং করার সুযোগ আসবে। উড়ে উড়ে ফিল্ডিং করব।' মাগুরা সার্কিট হাউসে নেওয়া ওই ইন্টারভিউয়ে যা বলেছিলেন, তা তো আরও মজার। অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন বছরখানেকও হয়নি। ক্যাপ্টেনসির সবচেয়ে বেশি কী মিস করেন জিজ্ঞেস করায় হাসি দিয়ে বললেন, 'স্যুইট রুম। উফ্, কী দারুণ সব রুমে থেকেছি!' কারও জানা না থাকলে জানিয়ে দিই, ক্রিকেট দলে খেলোয়াড়দের মধ্যে অধিনায়কই শুধু স্যুইট রুম পান।

জিম্বাবুয়েতে মুশফিককে যা বলেছিলেন, তা আসলে সাকিবের নিজেরই জীবনদর্শন। জীবন নিয়ে বেশি কিছু ভাবেন না। গতকাল কী হয়ে গেছে তা নিয়ে যেমন নয়, আগামীকাল কী হবে, তা নিয়েও না। অনেকবারই বলেছেন, 'বেশি ভাবা মানেই তো জটিলতা বাড়ানো। সারা দিন জলে থেকেও হাঁসের গায়ে যেমন জল লাগে না, সাকিবেরও তেমনি অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে কোনো কিছু গায়ে না মাখার। মিডিয়ার সমালোচনাও না। বেশির ভাগ ক্রিকেটারই সমালোচনায় এমন স্পর্শকাতর যে সামান্যতম আঘাতেও রক্তাক্ত হন। যেখানে মিডিয়ার সমালোচনায় রাগ হয় কি না প্রশ্নে সাকিবের ‘একটুও না' জবাবে অবিশ্বাস প্রকাশ করায় অবলীলায় বলেন, 'ভালো লিখলে ভালো, আর খারাপ লিখলে ভাবি, দুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে।' চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ওই দুঃসময়েও তো চারপাশে সমালোচনার ঝড় বইছে শুনে নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিয়েছেন, 'একটা ফিফটি মারলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।'

যতবার 'সাকিব কেন সাকিব' এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি, ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা, ক্ষুরধার ক্রিকেটমস্তিষ্ক—সবকিছু ছাপিয়ে এই প্রবল আত্মবিশ্বাস সবার আগে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গেই থেকেছে ইস্পাতকঠিন এক মন। আবারও তামিমের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। সাকিব শুধু তাঁর দেখা মানসিকভাবে সবচেয়ে শক্ত ক্রিকেটারই নন, ধারেকাছে রাখার মতোও আর কাউকে তিনি খুঁজে পান না। এই মনই সাকিবের চারপাশে এমন অভেদ্য একটা বলয় তৈরি রাখে, যা মন খারাপের বাতাসটাই তাঁর গায়ে লাগতে দেয় না। এত ঝড়ঝাপটা সয়ে এত দূর আসা মাশরাফি পর্যন্ত সাকিবের এই ক্ষমতাটাকে ঈর্ষা করেন।

চলবে...

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×