প্রথম দিন থেকেই সাকিব আলাদা

উৎপল শুভ্র

১২ আগস্ট ২০২১

প্রথম দিন থেকেই সাকিব আলাদা

সাকিবকে বুঝতে হলে মানুষটাকে বুঝতে হবে। সাকিবের জীবন পুরো দেশের মানুষের প্রাত্যহিক আলোচনার অংশ হয়ে যাওয়ার অনেক আগে, সাকিবকে আমিও যখন খুব ভালো চিনি না, তামিমকে জিজ্ঞেস করায় সাকিবকে বোঝাতে একটা শব্দই বলেছিলেন, `ডিফারেন্ট।` সেই `ডিফারেন্ট` সাকিবকে বুঝতে বেশির ভাগ সময়ই ভুল করেছে মানুষ।

কোনো কিছু নিয়েই 'রিগ্রেট' নেই বলে সাকিবের যে দাবি,  এত দিন দেখে আসার অভিজ্ঞতা থেকে কখনোই সেটি অবিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। তার মানে এই নয় যে নিজের ভুলটাও কখনো বুঝতে পারেন না। বিশ্বকাপের সময় লেখা কলামে সাবেক ক্রিকেটারদের নিয়ে ওই মন্তব্য সম্পর্কেই যেমন পরে আমাকে বলেছেন, 'এটা হয়তো অন্যভাবে বলা যেত। কমেন্ট না করাই হয়তো ভালো ছিল।'

সেটি ঘটনার অনেক পরে। ওই কলাম ছাপা হওয়ার অব্যবহিত পরের ঘটনাটা আগে বলে নিই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর ইংল্যান্ড আর হল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের পরের দুটি ম্যাচ চট্টগ্রামে। '৫৮' আর সাকিবের ওই কলাম মিলে দেশে তখন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। সাকিব নির্ঘাত ভেঙে চুরমার হয়ে গেছেন। সাংবাদিকের দায়িত্বের বাইরে গিয়ে তাঁকে চাঙা করে তোলার লক্ষ্যে হোটেল পেনিনসুলার লবিতে সাকিবকে নিয়ে বসেছি। সাকিবের মুখে হাসি দেখে প্রথম ধাক্কাটা খেলাম। এই ধাক্কা যদি রিখটার স্কেলে ৪ হয়, দ্বিতীয়টা সাড়ে ৯।

আমি বললাম, 'কী দরকার ছিল ওভাবে সবাইকে খেপিয়ে তোলার? চাপটা অকারণে বাড়িয়ে নেওয়া হলো না!' মুখে হাসিটা রেখেই সাকিব বললেন, 'ভালোই তো হলো! সব চাপ আমি নিয়ে নিলাম। বাকিরা এখন আরামে খেলতে পারবে।' এত দিন পরও যা লেখার সময় সেই বিস্ময়ের ধাক্কাটা টের পাচ্ছি। এই ছেলে বলে কী! স্পঞ্জের মতো সব চাপ শুষে নিতে পারার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা তাঁর আছে ঠিক, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছিল, সেটি বুঝতে পারলাম পরের দিন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নাটকীয় ওই জয়ের পর মাঠে নেমে আসা সাকিবের দুই চোখে জলের ধারা! সাকিবভক্ত আমার বন্ধু আনিসুল হক আবেগতাড়িত হয়ে পরের দিনের প্রথম আলোতে লিখলেন, 'সাকিব, তোমার চোখের জল আমাকে দাও'।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ম্যাচে। ছবি: গেটি ইমেজেসখেলার বাইরে সাকিবকে নিয়ে এত কথা বলার একটাই কারণ, সাকিবকে বুঝতে হলে মানুষটাকে বুঝতে হবে। সাকিবের জীবন পুরো দেশের মানুষের প্রাত্যহিক আলোচনার অংশ হয়ে যাওয়ার অনেক আগে, সাকিবকে আমিও যখন খুব ভালো চিনি না, তামিমকে জিজ্ঞেস করায় সাকিবকে বোঝাতে একটা শব্দই বলেছিলেন, 'ডিফারেন্ট।' সেই 'ডিফারেন্ট' সাকিবকে বুঝতে বেশির ভাগ সময়ই ভুল করেছে মানুষ। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর প্রথম আলোতে আমার সাবেক সহকর্মী তারেক মাহমুদের নেওয়া সাক্ষাৎকারটা নিয়ে যেমন। টি-টোয়েন্টি পাওয়ারের খেলা, আমাদের পাওয়ার কম—এটা বোঝাতে গিয়েই ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের বেড়ে ওঠার সময়টার সঙ্গে আমাদের ক্রিকেটারদের বেড়ে ওঠার সময়টার একটা তুলনা করেছিলেন। ওসব দেশে শিশু-কিশোরেরা সুষম পুষ্টিকর খাবার পায়। ব্রেকফাস্টে ডিম-দুধ-অরেঞ্জ জুস প্রায় বাধ্যতামূলক। ওই সাক্ষাৎকার ছাপা হওয়ার পর মূল কথাটা বোঝার চেষ্টা না করে সবাই 'অরেঞ্জ জুসে’ কেন্দ্রীভূত হয়ে গেলেন। 'অরেঞ্জ জুস' হয়ে গেল রসিকতার নাম—ওরা অরেঞ্জ জুস খায় বলে পারে, আমরা খাই না বলে পারি না। চরম দুঃখে সাকিব তখনই বোধ হয় বলেছিলেন কথাটা, 'আমার বোঝা হয়ে গেছে, এ দেশের মানুষ আমার কথা কখনোই বুঝবে না।'

প্রথম আলো সম্পাদকের পরামর্শে বেশ কাটছাট করে ছাপা হওয়া ওই সাক্ষাৎকারের প্রতিক্রিয়া দেখে একটু শিউরেই উঠেছিলাম, আনকাট ছাপা হলে না জানি কী হতো! কথায় কথায় ক্রিকেটারদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিয়ে সাকিবের যে কথাটা নিয়ে বিতর্ক হবে ভেবে সাক্ষাৎকার থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, সেটি তো একেবারে ভুল ছিল না। একটু কড়া করে বলা, এই যা, 'সবাই যে সুযোগ পেলেই আমাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাঁরা দেশের জন্য কে কী করে। দেশের জন্য বন্দুকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেই দেখা যাবে, কে কত দেশপ্রেমিক।'

 ওই সাক্ষাৎকার যেদিন প্রকাশিত হয়, সেদিনই সাকিব ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন। ছবি: গেটি ইমেজেস

সাকিবকে দেখে, তাঁকে কিছুটা বুঝে অনেকবারই আমার মনে পড়েছে শেকসপিয়ারের কিং লিয়ারের সেই অমর কথাটা–মোর সিনড্ অ্যাগেইনস্ট দ্যান সিনিং। সবার সঙ্গে আপনজনের মতো মেশার ক্ষমতা আর চারিত্রিক মাধুর্যের কারণে মাশরাফিকে মানুষ যেমন হৃদয়ে তুলে নিয়েছে, সাকিবকে কখনোই তা নেয়নি। সাকিবকেও মানুষ ভালোবেসেছে, তবে সব সময়ই পাশেই একটা প্রশ্নচিহ্ন রেখে। পান থেকে চুন খসলেই আমজনতা তাঁর পেছনে লেগে গেছে, নিত্য কাটাছেঁড়া করেছে মিডিয়া। মিডিয়ার ব্যাপারটা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি। সাকিব-তামিমদের হাত ধরে প্রথম সত্যিকার তারকা হতে শুরু করেছেন ক্রিকেটাররা। আগের ক্রিকেটারদের মতো সাংবাদিক দেখলেই যাঁরা গদগদ হয়ে পড়ছেন না। দশবার ফোন করলে হয়তো একবার ধরছেন। মোবাইল নাম্বার চাওয়ার পর 'আমার ব্যক্তিগত নাম্বার আপনাকে কেন দেব' শোনার অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। এর আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাভার করার মোটামুটি ভালো অভিজ্ঞতা হয়ে যাওয়ার কারণে আমার কাছে সেসব খুব বেশি অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদেরও একই রকম মনে হবে, সেই আশাও করিনি। সবার চেয়ে আলাদা সাকিবকে এত দিনের চেনা ছাঁচে ফেলতে না পারাটাই আসলে বোর্ড কর্মকর্তা, সাংবাদিক, দর্শক—সবাইকেই একটা বিষম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল।

অনুমিতভাবেই এখন যা অনেকটাই কমে এসেছে দেখি। একটা সময় সাকিবের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে আমার একটা সুনাম বা বদনাম ছিল। যেটির অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া হিসেবে সাকিবের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট থাকার অভিযোগেও অভিযুক্ত হয়েছি। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে সাকিব সম্পর্কে 'ছেলেটা আসলে কেমন' প্রশ্নটা যতবার শুনতে হয়েছে, বাকি আর সব ক্রিকেটার মিলিয়েও তা নয়। প্রতিবারই আমি একটাই উত্তর দিয়েছি, 'হি ইজ নট ইয়োর টিপিক্যাল ... ইয়ার ওল্ড বাংলাদেশি বয়। ইয়ার-এর আগের জায়গাটা শূন্য রেখেছি সাকিবের বয়সভেদে সেটি পরিবর্তন হয়েছে বলে।

প্রমাণটা আমি সাকিবের প্রথম টেস্টেই পেয়েছিলাম। ২০০৭ সালে ভারতের বিপক্ষে চট্টগ্রামে অভিষেক। প্রথম দিনের খেলা শেষ হওয়ার পর ক্রিকেটাররা মাঠ ছাড়ছেন।

সাকিবকে ধরে টিপিক্যাল প্রশ্নটা করলাম, 'সব ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে টেস্ট ক্রিকেট খেলার। সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় কেমন লাগল?'

টিপিক্যাল প্রশ্ন, কিন্তু টিপিক্যাল উত্তর নয়। এক শব্দেই যা শেষ, 'ভালো'।

ভালো তো জানিই, কেমন ভালো? ‘এ আর এমন কী' ভঙ্গিতে উচ্চারণ একটু বদলে আবার সেই একই উত্তর, 'ভালো'!

হাবিবুল বাশার ২০০৭ সালেই বুঝেছিলেন, সাকিব `ডিফারেন্ট`

প্রথম ভালো'টা শুনে ভেবেছিলাম, একটু বোধ হয় লজ্জা পাচ্ছেন। দ্বিতীয়বারও তা শুনে বুঝে গেলাম, ঘটনা তা নয়। এই ছেলেটা যে একটু আলাদা, বোঝা হয়ে গেল সেটিও। সাকিবের এই নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়ার অস্বাভাবিকত্ব বুঝতে আপনাকে সেই সময়টা বুঝতে হবে। এটা সেই সময়, যখন নামী পত্রিকার সাংবাদিক কথা বলতে চাইলে তরুণ ক্রিকেটার উৎসাহে হড়বড় করে কথা বলতে শুরু করে।

সাকিব যে একটু ‘ডিফারেন্ট’, হাবিবুল বাশার কোন ঘটনায় প্রথম তা বুঝতে পেরেছিলেন, সেটি তাঁর মুখেই শোনা। ২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের গ্রুপ ম্যাচ ত্রিনিদাদে। পোর্ট অব স্পেনের টিম হোটেলের লবিতে গিজগিজ করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ভৌগোলিক নৈকট্যের সুযোগ নিয়ে বেশির ভাগই এসেছেন আমেরিকা থেকে। ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ নিয়ে, তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলেও যাঁদের তৃপ্তি মিটছে না। ক্রিকেটারদের জন্য কিছু করার জন্যও তাঁরা ব্যাকুল। প্রবাসীদের এমনই একটা দল বাংলাদেশের কয়েকজন ক্রিকেটারকে ডিনার করাতে নিয়ে গেলেন শহরের নামী ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট অপ্সরায়। সেখানে গিয়েই খুলে বসলেন তাঁদের ক্রিকেট জ্ঞানের পসরা। বাংলাদেশ দলের এই সমস্যা ওই সমস্যা আলোচনাতেই থেমে না থেকে বাতলে দিতে শুরু করলেন সমাধানের উপায়ও। এর পা চলে না, ও বেশি স্লো খেলে, অমুক কিছু পারে না-- হাবিবুল শুনছেন আর মহাবিরক্ত হয়ে মনে মনে আফসোস করছেন, এঁদের আমন্ত্রণ রক্ষা করে কী ভুলটাই না হয়েছে! তারপরও চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছেন, ভদ্রতা বলে একটা ব্যাপার আছে না! আর ২০ বছরের সাকিব কী করলেন? মুখে কিছু না বলে ভরা প্লেট রেখে হাত ধুতে বেসিনে চলে গেলেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের খুলে বসা ‘এমসিসি কোচিং ম্যানুয়াল' যে সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেটা বোধ হয় না বললেও চলছে।

চলবে...

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×