হানিফ মোহাম্মদ নেই, আছে শুধু সেই সন্ধ্যার স্মৃতি আর একটা বই

উৎপল শুভ্র

১৭ আগস্ট ২০২১

হানিফ মোহাম্মদ নেই, আছে শুধু সেই সন্ধ্যার স্মৃতি আর একটা বই

টেপ রেকর্ডারে দ্বিতীয় ক্যাসেটটিও শেষ হয়ে যাওয়ার পর হানিফ মোহাম্মদ বলেছিলেন,`আপনাকে আমার অটোবায়োগ্রাফি দিয়ে দিচ্ছি। সব কিছুই ওখানে পাবেন।` তাহলে অটোবায়োগ্রাফিতে নেই, এমন কোনো মজার ঘটনা বলুন’, এই অনুরোধের দারুণ একটা জবাব দিয়েছিলেন, `সেই ঘটনা যদি এতই মজার হবে, তাহলে তা আমি আমার অটোবায়োগ্রাফি থেকে কেন বাদ দেব, বলুন?`

উইকেট-বোলিং-কন্ডিশন এসব কারণে কখনো কখনো সেঞ্চুরির চেয়েও বড় হয়ে যায় হাফ সেঞ্চুরি। ১৯৫৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে ৫১ রানের ইনিংসিটকে যে কারণে তাঁর অনেক সেঞ্চুরির চেয়েও এগিয়ে রাখতেন হানিফ মোহাম্মদ। অ্যালেক বেডসারের বোলিংয়ে স্টাম্পের ঠিক পেছনে দাঁড়ানো গডফ্রে ইভান্স যে ক্যাচটা নিয়ে হানিফকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তা এমনই দুর্দান্ত ছিল যে, ওই ছবিটা রেখে দিয়েছিলেন হানিফ।

এ কথার সূত্র ধরেই প্রশ্নটা করেছিলাম, গডফ্রে ইভান্সই কি তাহলে হানিফ মোহাম্মদের দেখা সেরা উইকেটকিপার? এই প্রশ্নের উত্তরে ‘আরও অনেক ভালো উইকেটকিপারই দেখেছি' বলে 'অ্যালান নট ভালো ছিল, আমাদের ওয়াসিম বারিও ছিল ভালো, এখন রশিদ লতিফ ভালো, মঈন ভালো’ এমন একটি দীর্ঘ তালিকা পেশ করে ফেলেছিলেন হানিফ মোহাম্মদ। কিন্তু তাঁকেই যখন বলা হলো, তাঁর পছন্দের একটা বিশ্ব একাদশ বেছে নিতে, সভয়ে মাথা নাড়ার দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে, 'না না, এটি এভাবে তাড়াহুড়ো করে করার জিনিস নয়। এমনিতে আড্ডায় বসে এসব নিয়ে কথা বললে অন্য কথা, কিন্তু আপনি তো এটি পত্রিকাতে ছাপবেন।'

হানিফের এমন শঙ্কিত হওয়ার বড় কারণ ছিল, তখন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের দল নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে তুমুল হইচই হচ্ছে। ডনের মৃত্যুর পর যা প্রকাশিত হয়েছে রোনাল্ড পেরির লেখা 'ব্র্যাডম্যানস্ বেস্ট' নামে এক বইয়ে। সেটির প্রসঙ্গ তুলেই হানিফ বিশ্ব একাদশ গড়তে অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন, 'ব্র্যাডম্যানের টিম নিয়ে কেমন হইচই হচ্ছে, তা তো জানেনই। তা ছাড়া আমি এভাবে বিশ্ব একাদশ গড়ায় চেয়ে প্রতি পজিশনে ২/৩ জন করে খেলোয়াড় বাছাই করাটাকেই বেশি ভালো মনে করি, এটি অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং, এ থেকে সবাই নিজের পছন্দের দলও বেছে নিতে পারবেন।' তা করতেও দু'তিন দিন সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। যে কারণে আর তা জানাই হয়নি।

হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়া টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে একটু দুঃখবোধ ছাড়া বড় কোনো আক্ষেপ ছিল না হানিফ মোহাম্মদের মনে। তবে আধুনিক যুগে যে হারে ক্রিকেট হয়, তা দেখে মাঝে মাঝে সামান্য একটু আফসোসের কথা বলেছিলেন, 'আমি ১৭ বছরে ৫৫টি টেস্ট খেলেছি। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে, আমি হয়তো কোনো টেস্টে সেঞ্চুরি করলাম, দেখা গেল তারপর আর কোনো ম্যাচ নেই, পরের টেস্ট এক বছর পর। অথচ আমার মনে আছে, একবার জাভেদ মিয়াঁদাদ এক বছরেই খেলেছিল ১৪টি টেস্ট।'

নিজে খেলতে পারেননি, এজন্য আফসোস ছিল, কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের প্রতি ঈর্ষাবোধের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাইনি তাঁর মধ্যে। এমনকি জাভেদ মিয়াঁদাদ যে ক্রিকেটের মান 'একবারে রসাতলে গেছে' বলে নিয়মিত চিৎকার করেন, হানিফ মোহাম্মদ তাতে কণ্ঠ মেলাতেও রাজি হননি। মিয়াঁদাদের এই দাবির কথা শুনে প্রথমে তো মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন, 'ও কি এই কথা সিরিয়াসলি বলেছে? আমার তা মনে হয় না।' মিয়াঁদাদের মুখ থেকে একাধিকবার এ কথা শুনেছি বলে জানানোর পর মাথা নাড়তে নাড়তে বলেছিলেন, 'এটা ওর ব্যক্তিগত মত। কিন্তু আমি এর সঙ্গে একমত নই । আমি শুধু একটাই সমস্যা দেখি—বেশি বেশি ওয়ানডে খেলার কারণে ব্যাটসম্যানদের টেকনিক খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানের এখন আর লম্বা ইনিংস খেলার ক্ষমতা নেই।' এই দুঃখ হানিফ মোহাম্মদকেই সবচেয়ে বেশি ছুঁয়ে যাওয়ায় কথা, হানিফ মোহাম্মদ নামটিই তো সমার্থক লম্বা ইনিংসের সঙ্গে।

করাচিতে নিজের বাড়িতে আত্মজীবনী হাতে হানিফ মোহাম্মদ। ছবি: উৎপল শুভ্র

হানিফ মোহাম্মদের বাড়িতে ঢুকেছিলাম সন্ধ্যে ছটায়, কথায় কথায় কখন যে দু'ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, টেরই পাইনি। পেলাম, যখন থেমে গেল রেকর্ডারে ঢোকানো দ্বিতীয় ক্যাসেটটিও। শব্দটা শুনে হাসি ফুটে উঠেছিল হানিফ মোহাম্মদের মুখে, 'আপনাকে আমার অটোবায়োগ্রাফি দিয়ে দিচ্ছি। সব কিছুই ওখানে পাবেন।' তাহলে অটোবায়োগ্রাফিতে নেই, এমন কোনো মজার ঘটনা বলুন’, এই অনুরোধের দারুণ একটা জবাব দিয়েছিলেন, 'সেই ঘটনা যদি এতই মজার হবে, তাহলে তা আমি আমার অটোবায়োগ্রাফি থেকে কেন বাদ দেব, বলুন?'

ঘণ্টা দুয়েক আগে পরিচিত হওয়া ভিনদেশি এক ক্রিকেট লেখককে শুভকামনা জানিয়ে খুব যত্ন করে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন তাঁর আত্মজীবনীতে। হানিফ মোহাম্মদের আত্মজীবনী 'প্লেয়িং ফর পাকিস্তান' এর একটি কপি আমার ক্রিকেট-সম্পদের তালিকায় যোগ করে যখন তাঁর ঘর থেকে বেরোচ্ছি, দরোজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন পাকিস্তানি কিংবদন্তি। কীর্তিতে নয়, হয়তো হৃদয়-মহিমাতেও নয়, তবে অন্তত শারীরিক আকৃতিতে এই ‘মাস্টার' যে সত্যিই কতো 'লিটল’, আবার তা টের পেলাম নতুন করে। আমি এমন কোনো দীর্ঘদেহী মানব নই, তারপরও হানিফ মোহাম্মদ পড়ে রইলেন আমার কাঁধ সমান উচ্চতায়।

ফিরতি পথটায় কেন যেন হানিফ মোহাম্মদের ছোটখাটো চেহারাটাই ঘুরপাক খেতে থাকলো মাথায়। হানিফ মোহাম্মদের একটা কথাই মনে পড়ল বারবার। ব্রায়ান লারা তাঁর ৪৯৯ রানের রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার পর এই উচ্চতার রহস্যের দিকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। একটু আগে সে কথা বলেছেন আমাকেও, 'আপনি দেখবেন, টেস্ট ক্রিকেটে বড় ইনিংস খেলা বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানই উচ্চতায় খাটো। সোবার্স, গ্রেগ চ্যাপেল, গ্রাহাম গুচ—এমন কয়েকজনকে বাদ দিলে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন বা বড় ইনিংস খেলেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের বাকি কেউই লম্বা নন।' এর রহস্যটা অবশ্য ব্যাখ্যা করতে পারেননি হানিফ মোহাম্মদ, ‘আমি জানি না কারণটা কী! তবে একটা কিছু নিশ্চয়ই আছে।' কারণটি কী কে জানে, তবে ডন ব্র্যাডম্যান, লেন হাটন, সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা...গ্রেট ব্যাটসম্যানদের সারিতে ছোটখাটো লোকগুলোরই ভিড় বেশি। এদের অনেকের সম্পর্কেই ব্যবহৃত হয়েছে 'লিটল মাস্টার' শব্দযুগল। তবে এই বিশেষণটি হানিফ মোহাম্মদ সম্পর্কেই ব্যবহৃত হয়েছিল প্রথম। তা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার ওমর কুরেশি। সেই 'লিটল মাস্টার’-এর সঙ্গে কাটানো দু্ই ঘণ্টার স্মৃতি যে এতদিন পরও স্মরণীয় হয়ে আছে, তাতে ক্রিকেটীয় আলোচনার চেয়ে হানিফ মোহাম্মদের বিনয়ী এবং মৃদুভাষী আচরণের ভূমিকাও কম নয়।

ধন্যবাদ হানিফ মোহাম্মদ, স্মরণীয় এক সন্ধ্যার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আত্মজীবনীটা হাতে নিলেই আপনার কথা মনে পড়ে। অটোগ্রাফটা দেখলে আরও বেশি। আপনি নেই, তবে সেই সন্ধ্যার স্মৃতি আছে আর আছে এই বইটা।

সমাপ্ত

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×