লেন হাটনের রেকর্ডধন্য সেই ওভাল টেস্ট

গ্রাউন্ডসম্যানকে যখন গুলি করতে চান বোলার

উৎপল শুভ্র

২৪ আগস্ট ২০২১

গ্রাউন্ডসম্যানকে যখন গুলি করতে চান বোলার

১৯৩৮ ওভালের সেই বিখ্যাত স্কোরবোর্ড

প্রথম নয় শ রানের ইনিংস যে টেস্টে, সেই টেস্টে রেকর্ড হয়েছিল আরও বেশ কয়েকটা। দলীয় সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড তো বটেই, সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোরের রেকর্ড গড়েছিলেন ইংল্যান্ডের লেন হাটন, ফ্লিটউড-স্মিথ এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান দেওয়ার রেকর্ড...সবচেয়ে বিস্ময়কর রেকর্ডটি অবশ্যই অস্ট্রেলিয়ার ১ ইনিংস ও ৫৭৯ রানের পরাজয়। শেষ দুটি এখনো ভাঙেনি। ১৯৩৮ সালের ওভাল টেস্ট তাই ফিরে ফিরে দেখার মতোই।

পৌনে তিন দিন ব্যাটিং করে টেস্ট ইতিহাসে প্রথম নয় শর বেশি রান। তারপরও ইনিংস ডিক্লেয়ার করায় ওভালের চিফ গ্রাউন্ডসম্যান নাকি খুব মন খারাপ করেছিলেন! কেন, মন খারাপ করেছিলেন কেন? কারণ তাঁর আশা ছিল, টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম চার অঙ্কের রান দেখবেন। ইংল্যান্ড অধিনায়ক ওয়ালি হ্যামন্ড কেন তা হতে দিলেন না? এই সুযোগ কি আর প্রতিদিন আসে!

তা তো আসেই না। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট দুইবার হাজার রান দেখেছে, টেস্ট ক্রিকেট তো এখনো দেখেইনি। কোনোদিন দেখবে বলেও মনে হয় না। ১৯৩৮ সালের ২৩ আগস্টের আগে টেস্ট ক্রিকেট ৯০০ রানও দেখেনি। এই দিন দেখেছিল ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ওভাল টেস্টে। ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস ডিক্লেয়ার করেছিল ৭ উইকেটে ৯০৩ রান তুলে। ৯০০ রানের পরের ইনিংসটা দেখতে টেস্ট ক্রিকেটকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৫৯ বছর। ১৯৯৭ সালের সেই '৯০০' ওভালের চেয়েও বড়। ভারতের বিপক্ষে কলম্বোর খেত্তারামায় ৬ উইকেটে ৯৫২ রান করে শ্রীলঙ্কা ঠিক ডিক্লেয়ার করেনি, প্রহসন চালিয়ে যাওয়ার কোনো যুক্তি নেই দেখে নির্ধারিত সময়ের সামান্য আগে খেলার সমাপ্তি টানা হয়েছে। পুরো খেলা হলেও এক হাজার রান করার সময় ছিল না।

শ্রীলঙ্কার এই রেকর্ড ভারতের বিপক্ষে, কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে। যে রেকর্ডের পর সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। সেই সমালোচনার মূল সুরটা অনুমিতই। প্রেমাদাসার মতো উইকেট তৈরি করা হলে ভবিষ্যতে ক্রিকেটে বোলার বলে কিছু থাকবে না, কারণ সবাই তো ব্যাটসম্যানই হতে চাইবে। 'প্রহসন’ শব্দটাও খুব ব্যবহৃত হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, ঠিক এই শব্দটাই খুঁজে পেয়েছিলাম ৫৯ বছর আগের রেকর্ডভাঙা টেস্টটির রিপোর্টেও।

৩৬৪ রানের ম্যারাথন ইনিংসের পথে লেন হাটন। ছবি: গেটি ইমেজেস

কলম্বোতে দুই দলের একটি করে ইনিংসও শেষ হয়নি, ওভালের চিত্রটা কিন্তু মোটেই এমন খারাপ নয়। সে টেস্টে মীমাংসা হয়েছিল, ইংল্যান্ড জিতেছিল ১ ইনিংস ও ৫৭৯ রানের ব্যবধানে। ৭ উইকেটে ৯০৩ রানের রেকর্ডটি ভেঙে গেছে, ভেঙে গেছে সেই ইনিংসে লেন হাটনের ৩৬৪ রানের রেকর্ডও। তবে টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়-পরাজয় নিষ্পত্তি হওয়ার রেকর্ডটিতে কোনো আঁচড় পড়েনি এখনো। আরেকটি রেকর্ডও যেমন এখনো অম্লান। অস্ট্রেলিয়ার বাঁহাতি রিস্ট স্পিনার চাক ফ্লিটউড-স্মিথ ওই টেস্টে ৮৭ ওভার বোলিং করে মাত্র ২ রানের জন্যই 'ট্রিপল সেঞ্চুরি' করতে পারেননি।মানে ২৯৮ রান দিয়েছিলেন আর কি! উইকেটও অবশ্য পেয়েছিলেন একটি। তবে তা উদযাপন করার মতো মনের অবস্থা তাঁর ছিল না। ওয়ালি হ্যামন্ডের উইকেট পাওয়ার আনন্দ যে ঢেকে দিয়েছে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান দেওয়ার কলঙ্ক। অগৌরবের যে রেকর্ড এখনো ফ্লিটউড-স্মিথেরই আছে।

তাঁর রেকর্ড ভাঙার পর লেন হাটনকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন ডন ব্র্যাডম্যান (বাঁয়ে)। ছবির তৃতীয়জন উইকেটে হাটনের সঙ্গী জো হার্ডস্টাফ (ডানে)। ছবি: টু হান্ড্রেড ইয়ার্স অব অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বই থেকেফ্লিটউড-স্মিথের রেগে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক হতো। যদিও তাঁর চেয়ে বেশি রেগে গিয়েছিলেন অথবা বলতে পারেন, সেই রাগ প্রকাশ করেছিলেন তাঁর স্পিন বোলিং পার্টনার বিল ও'রিলি। বোলিং করতেন লেগ স্পিন, তবে মেজাজমর্জিতে ছিলেন ফাস্ট বোলারের মতো। পাটা পিচে ৮৫ ওভার মাথা কুটে ৩ উইকেটের জন্য ১৭৮ রানের মূল্য গুণতে হওয়ার পর ও'রিলি নাকি বলেছিলেন, 'কেউ আমাকে গ্রাউন্ডসম্যানের কুটিরটা দেখিয়ে দাও। হতচ্ছাড়াকে আমি গুলি করে মারব।' বলের ঘষায় লেগ স্পিনার ও'রিলির আঙুল দিয়ে তখন রক্ত ঝরছে।

১৯৩৮ সালের ২৩ আগস্ট ইংল্যান্ডের 'দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফে' প্রকাশিত টেস্টটির তৃতীয় দিনের রিপোর্টে 'প্রহসন' শব্দটি ব্যবহারের কারণ অন্য। এই টেস্টটি ছিল তখন খুব প্রচলিত ‘টাইমলেস টেস্ট’-এর একটি। অর্থাৎ জয় পরাজয়ের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে খেলা শুরু করেছিল দু'দল।

এ কারণেই তৃতীয় দিন চা-বিরতি পর্যন্ত ব্যাট করে তোলা ইংল্যান্ডের বিশাল ইনিংসের মধ্যে তেমন মাহাত্ম্য খুঁজে পাননি দ্য টেলিগ্রাফের রিপোর্টার। লেন হাটনের ৩৬৪ রানও ভেঙে দিয়েছিল অনেক রেকর্ড, কিন্তু তারপরও টেলিগ্রাফ-এর শিরোনাম ছিল: Hutton smashes all records, England certain to win farcical test.

টাইমলেস সেই টেস্ট কিন্তু শেষ হয়ে গিয়েছিল চতুর্থ দিনেই। ইংল্যান্ডের ইনিংস শেষে তৃতীয় দিন চা-বিরতির পর ব্যাট করতে নামা অস্ট্রেলিয়া দিন শেষ করেছিল ৩ উইকেটে ১১৭ রানে। পরদিন ২০১ রানে অলআউট হয়ে যাওয়াটাও দ্বিতীয় ইনিংসের তুলনায় ছিল অনেক ভালো, দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া করে ১২৩। পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তৃতীয় দিনেই।

বোলিং করার সময় ফুটমার্কে পা আটকে পড়ে যান ডন ব্র্যাডম্যান, সতীর্থদের কাঁধে চড়ে মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, তাঁর শিন বোন ভেঙে গেছে। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এতটা মারাত্মক প্রমাণিত না হলেও ব্যাটিং করতে পারেননি। কারণ অ্যাঙ্কেলের হাড়ে চিড় ধরেছিল। ওই সিরিজেই আর খেলা হয়নি তাঁর। ডন ব্র্যাডম্যান তখন ইংলিশদের কাছেও এমনই এক চৌম্বক আকর্ষণ যে, তাঁকে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন খোদ ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। ব্র্যাডম্যান ছিটকে পড়াতেই ম্যাচের মোটামুটি মীমাংসা হয়ে যায়। মাংসপেশিতে টান পড়ায় ব্যাট করতে পারেননি অস্ট্রেলীয় ব্যাটিংয়ের আরেক ভরসা জ্যাক ফিঙ্গলটনও। ‘টাইমলেস টেস্ট' তাই প্রথাগত নির্দিষ্ট টাইম পর্যন্তও গড়ায়নি।

বোলিংয়ের সময় অ্যাঙ্কেল মচকে সতীর্থদের কাঁধে চড়ে মাঠ ছাড়ছেন ডন ব্র্যাডম্যান। ছবি: টু হান্ড্রেড ইয়ার্স অব অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটলন্ডনের 'দ্য টেলিগ্রাফ' পত্রিকায় প্রকাশিত ক্রিকেট রিপোর্টের একটা সংকলন আছে আমার সংগ্রহে। কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার রান-উৎসবের পর ৫৯ বছর আগের ওই ওভাল টেস্টের ম্যাচ রিপোর্ট খুঁজে বের করেছিলাম সেই বই থেকেই। যা পড়তে গিয়ে দেখি, কলম্বো টেস্টের পর যা লেখা হয়েছিল, সামান্য পরিবর্তন করে একই কথা লেখা হয়েছে ৫৯ বছর আগের সেই টেস্টটি সম্পর্কেও। রিপোর্টের একটি অংশ ছিল এরকম : Records do not make cricket, however, and we can only hope that these fresh ones will be stout nails in the coffin of timeless tests played on wickets that turn a great game into a farce.

শুধু timeless শব্দটি বাদ দিলে কলম্বো টেস্ট নিয়েও তো এমনই লেখা হয়েছে। 

ইংল্যান্ডের অমন শম্বুকগতির ব্যাটিং এবং ইনিংস টেনে নেওয়ার পেছনে ডন ব্র্যাডম্যান অবশ্য অন্য একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন। এই 'টাইমলেস টেস্ট' বস্তুটা ইংল্যান্ডের পছন্দ ছিল না, সময়-নির্দিষ্ট টেস্টের প্রতিই ছিল তাদের পক্ষপাত। টাইমলেস টেস্টের কফিনে শেষ পেরেক পুঁততেই হয়তো অমন অনন্তকাল ব্যাটিং করে যাওয়া। যাতে দ্য টেলিগ্রাফ-এর রিপোর্টে ব্যবহৃত ওই শব্দটার আর পুনরাবৃত্তি না হয়। 'প্রহসন'!

এই উদ্দেশ্য সফলই হয়েছিল বলতে হবে। ওভালের ওই 'প্রহসন'-এর পর টাইমলেস টেস্ট হয়েছে আর একটাই। সেটিতেও ইংল্যান্ড ছিল। পরের মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট ইতিহাসের দীর্ঘতম ম্যাচের অবশ্য মীমাংসা হয়নি ইংল্যান্ডের জাহাজ ধরার তাড়া থাকায়। ওভালে ৭ উইকেটে ৯০৩ রানের রেকর্ডের প্রায় প্রতিশব্দ হয়ে আছেন লেন হাটন। ২২ বছর বয়সী ইয়র্কশায়ারম্যান যাঁর রেকর্ড ভেঙেছিলেন, তিনি তখন মাঠেই ছিলেন। প্রথম অভিনন্দনও তিনিই জানান। ডন ব্র‍্যাডম্যান। ইংল্যান্ডে অস্ট্রেলিয়ার আগের সফরে লিডসে রেকর্ড ৩৩৪ রান করতে ব্র্যাডম্যানের ব্যাট করতে হয়েছিল ছয় ঘণ্টা ২৩ মিনিট। এই রেকর্ড ভাঙতে লেন হাটনকে ব্যাট করতে হয়েছে প্রায় সাত ঘণ্টা বেশি, ১৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট।

ওভালে লেন হাটন ভেঙেছিলেন ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড আর ইংল্যান্ড ভেঙেছিল ইংল্যান্ডেরই রেকর্ড। টেস্টে সর্বোচ্চ রানের আগের রেকর্ডটি ছিল ৮৪৯ রানের। ১৯২৯-৩০ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে কিংস্টনে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে যা করেছিল ইংল্যান্ড। সেবারও ইংল্যান্ড নিজেদের রেকর্ডই ভেঙেছিল। আগেরটা ছিল অবশ্য অনেক ‘কম’। মাত্র ৬৩৬! কিংস্টনে ৮৪৯ রানের ইনিংসেই টেস্ট ক্রিকেট প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি দেখে টেস্ট ক্রিকেট। অ্যান্ডি স্যান্ডহামের ৩২৫ রানের রেকর্ডই ভেঙেছিলেন ব্র্যাডম্যান। ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ভাঙেন হাটন। হাটনের রেকর্ড গ্যারি সোবার্স, গ্যারি সোবার্সের রেকর্ড ব্রায়ান লারা, ব্রায়ান লারার রেকর্ড ম্যাথু হেইডেন, ম্যাথু হেইডেনের রেকর্ড আবার ব্রায়ান লারা। এক নিঃশ্বাসে টেস্টে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের হাত বদলের কাহিনি বলা হয়ে গেল।

ম্যাচশেষে রেকর্ড গড়া দুই ক্রিকেটারের মধ্যে স্টাম্প নেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি। রেকর্ড অবশ্য বিপরীতধর্মী। লেন হাটন গড়েছেন সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড, আর ফ্লিটউড-স্মিথ এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান দেওয়ার ইংল্যান্ডের ৯০৩ আর লেন হাটনের ৩৬৪ দিয়ে যেহেতু লেখার শুরু, শেষটাও তা দিয়েই করা ভালো। শেষ করি একটা গল্প দিয়ে। সত্যি গল্পই, কারণ তা বলেছেন স্বয়ং লেন হাটনই। ৩৬৪ রানের রেকর্ড করার পর সতীর্থ ডেনিস কম্পটনকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে ফিরছেন হাটন। তখন তো আর টিম বাস-টাসের ব্যাপার ছিল না। একটা ট্রাফিক লাইটপোস্টে গাড়ি থামল। হাটনকে দেখে পাশের গাড়ি থেকে এক ভদ্রমহিলা মাথা বের করে বললেন, 'ওয়েলডান লেন, কিন্তু আর একটা রান করতে পারলে না! তাহলে বছরের প্রতিটি দিনের জন্য একটা করে রান হতো।'

হতভম্ব হাটন আর কী জবাব দেবেন! ডেনিস কম্পটনকে তিনি শুধু বললেন, 'ডেনিস, তুমিই বলো, কোনো মেয়েকে কি কখনো সন্তুষ্ট করা সম্ভব?'

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×