কী যুগে খেলেছেন, কিসের মধ্যে খেলেছেন!

উৎপল শুভ্র

৩০ আগস্ট ২০২১

কী যুগে খেলেছেন, কিসের মধ্যে খেলেছেন!

ভিন্ন যুগের খেলোয়াড়দের তুলনা প্রসঙ্গে `ত্রিশের দশকে ব্র্যাডম্যানের সময়ে জন্মালেও টেন্ডুলকার খুব ভালো ব্যাটসম্যান হতেন` বলার পর ইয়ান চ্যাপেলকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, `ব্র্যাডম্যানের চেয়েও ভালো?’ যা শুনে ইয়ান চ্যাপেল মহা বিরক্ত হয়েছিলেন। ব্র‍্যাডম্যানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না, কিন্তু ব্যাটসম্যান ব্র্যাডম্যানের সামনে মাথা না নুইয়ে কি কারও উপায় ছিল! নিজেকে ব্র্র্যাডম্যান সেই উচ্চতাতেও নিয়ে গিয়েছিলেন রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে অরক্ষিত উইকেটে খেলে, কখনো বা স্পোর্টস শপে সেলসম্যানের কাজ করে!

ইয়ান চ্যাপেল মানুষ ব্র্যাডম্যানকে পছন্দ করতেন, এমন কোনো দিন শোনা যায়নি। ক্রিকেট নিয়ে দুজনের মতাদর্শই যে দুই মেরুর। ব্র্যাডম্যানের কাছে সবকিছুর ওপরে ছিল খেলাটির চেতনা। শিক্ষাটা পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে। যিনি ছেলের মনে গেঁথে দিয়েছিলেন প্রশ্নটা, ‘ইট ওয়াজ নট ইফ ইউ উইন, ডিড ইউ প্লে দ্য গেম?' ব্র্যাডম্যান সারা জীবন এটিকে বেদবাক্য বলে মেনে চলেছেন। অধিনায়ক হওয়ার পর পরিষ্কার বলে দেন, কেউ স্লেজিং করলে পরের টেস্টে সে আর খেলবে না। সেখানে স্লেজিংকে প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে ফেলা ইয়ান চ্যাপেলের দলের নামই হয়ে গিয়েছিল 'দ্য ডার্টি অস্ট্রেলিয়ানস'। ডন ব্র্যাডম্যান তখন অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান, তিনি কীভাবে তা মেনে নেন? দুজনের খটাখটি তাই লেগেই ছিল। ইয়ান চ্যাপেলের বিখ্যাত একটা ছবি আছে। ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে কারও কাছে যেটি ‘কুখ্যাত’ও মনে হতে পারে। এক হাতে বিয়ারের মগ, অন্য হাতে সিগারেট। ডিসিপ্লিনারি কমিটির সামনে যাচ্ছেন, যে কমিটির প্রধান ডন ব্র্যাডম্যান!

অনেকে অবশ্য বলেন, ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে চ্যাপেলের সমস্যার মূল দূর অতীতে। চ্যাপেলের দাদা ভিক রিচার্ডসন ব্র্যাডম্যানের কাছে অধিনায়কত্ব হারিয়েছিলেন। কখনোই তা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি, সেই দুঃখের কথা নাতিরাও সবিস্তারে জেনেছে। দাদার ক্ষোভ সংক্রমিত হয়েছে ইয়ান চ্যাপেলের মনেও।

সেই ইয়ান চ্যাপেল ভিন্ন যুগের খেলোয়াড়দের তুলনা প্রসঙ্গে 'ত্রিশের দশকে ব্র্যাডম্যানের সময়ে জন্মালেও টেন্ডুলকার খুব ভালো ব্যাটসম্যান হতেন' বলার পর পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, 'ব্র্যাডম্যানের চেয়েও ভালো?’

পরে গিয়ে ভিক রিচার্ডসনের সঙ্গে এই হাসিটা আর থাকেনি ডনের

জবাবটা দিয়েছিলেন মহা বিরক্ত হয়ে, 'না, না, সেই প্রশ্নই আসে না। ব্র্যাডম্যানের অ্যাভারেজ পরবর্তী সেরা ব্যাটসম্যানের চেয়ে ৪০ বেশি। মনে রাখতে হবে, আমরা অ্যাভারেজ ব্যাটসম্যানের কথা বলছি না। বলছি পরবর্তী সেরা ব্যাটসম্যানের কথা। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে অন্য কারও তুলনারই প্রশ্ন আসে না। কেউ যদি আমাকে বলে, আমি ব্র্যাডম্যানের চেয়ে বড় ব্যাটসম্যান, হয় সে ইডিয়ট, নয়তো মিথ্যাবাদী অথবা সে খেলার কিছুই বোঝে না।'

বলার পর এমনভাবে তাকিয়ে ছিলেন যে, বিব্রত আমি ভাবতে শুরু করলাম প্রশ্নটা করেছি বলে আমাকেও বোধ হয় ওই তিনটির কোনোটা ভাবছেন!

কথাটা অনেকবারই বলা হয়েছে। আবারও বলি। ভিন্ন ভিন্ন আমলের খেলোয়াড়দের আসলে তুলনাই চলে না। কোনো খেলাতেই না, ক্রিকেটে আরও বেশি না। ভিন্ন সময়, ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন মানসিকতা, ভিন্ন প্রতিপক্ষ—এসব পরিবর্তন সব খেলাতেই কমন, কিন্তু ক্রিকেটের মতো আর কোন খেলায় এমন ফরম্যাট বদলেছে? আর কোন খেলা আইনকানুনের এত সব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে? তবে সবকিছু মাথায় রেখেও মনে হয়, ব্যাটিং করার কাজটা বোধ হয় আগের চেয়ে একটু সহজই হয়েছে।

ব্র্যাডম্যানের সময়ে উইকেট ঢাকা থাকত না, রোদ-বৃষ্টির খেয়ালখুশির মধ্যে দিতে হতো ব্যাটসম্যানশিপের চূড়ান্ত পরীক্ষা, নো বলের জন্য ফ্রন্ট ফুট রুল ছিল না। এখন যেমন বোলারকে চার ফুট বক্সের মধ্যে দুই পা-ই রাখতে হয়, তখন শুধু পেছনের পা'টা বক্সে রেখে সামনের পা যত ইচ্ছা এগিয়ে বল করা যেত। যার অর্থ বোলাররা তখন ফুট দেড়েক এগিয়ে থেকে বল করার সুযোগ পেত। এখন যে নতুন বল পেতে ৮০ ওভার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, সেটি নেওয়া যেত ৫৫ ওভার শেষেই এবং বাউন্সার দেওয়া যেত যত ইচ্ছা।

আধুনিক ক্রিকেট সব নিয়মকেই ব্যাটসম্যানের মনের মতো সাজিয়েছে। নিয়মকানুনের বাইরেও সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা হয়েছে খেলার সরঞ্জামে। প্যাড-গ্লাভস উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। এখন ব্যাটসম্যানরা সারা শরীরে বর্ম লাগিয়ে গ্ল্যাডিয়েটরের বেশে মাঠে নামে। ব্র্যাডম্যানের সময়ে থাই প্যাড পর্যন্ত ছিল না। হানিফ মোহাম্মদের মুখে শুনে অবাক লাগছিল, বারবাডোজে ১৬ ঘণ্টারও বেশি সময়ব্যাপী রেকর্ড ওই ইনিংস খেলার সময় নাকি একটা মোটা রুমাল প্যান্টের বাম পকেটে গুঁজে নিয়েছিলেন। ওটাই ছিল 'থাই প্যাড'! বডিলাইন সিরিজে ব্র্যাডম্যানেরও প্যাড-গ্লাভসের বাইরে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বলতে তা-ই ছিল।

সবচেয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তনটা হয়েছে ব্যাটে। ব্র্যাডম্যান যে ব্যাট দিয়ে ম্যাচের পর ম্যাচ তাণ্ডব চালিয়েছেন, এখন পাড়ার ক্রিকেটেও কেউ ওই ব্যাট দিয়ে খেলতে চাইবে না। বিভিন্ন ক্রিকেট জাদুঘরে পুরোনো দিনের ব্যাট দেখে অবাক হয়ে ভেবেছি—এখনকার ব্যাটের কানাই তো এসব ব্যাটের ব্লেডের প্রায় সমান! আগেকার দিনে 'সুইট স্পট' বলে একটা কথা খুব শোনা যেত । সেটি ছিল ব্যাটের ছোট্ট একটা অংশ আর এখন তা ব্যাটজুড়েই। টেলএন্ডারের মিস হিটেই ছক্কা হয়ে যায়—এখনকার এই ব্যাট পেলে ব্র্যাডম্যান কী করতেন, ভাবতেই তো শিহরণ জাগে।

তর্ক করলে তো করাই যায়। টেন্ডুলকারের পক্ষেও যেমন যুক্তি আছে। ব্র্যাডম্যান দুটি দেশের মাত্র ১০টি ভেন্যুতে টেস্ট খেলেছেন। টেন্ডুলকার খেলেছেন ১০টি দেশের ৫৯টি ভেন্যুতে। ওয়ানডে ধরলে তো সংখ্যাটা অবিশ্বাস্য একটা রূপ নেয়। ব্র্যাডম্যান ৫২টি টেস্টের বাইরে ১৮২টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন। টেন্ডুলকার ২০০টি টেস্টের বাইরেও ১১০টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ, সঙ্গে ৪৬৩টি ওয়ানডে, এর বাইরেও আইপিএল-টাইপিএল! ২৪ বছর ধরে এত এত ম্যাচে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে যাওয়া কি সহজ কথা!

টেন্ডুলকারের সময়ে মিডিয়া আরও সর্বগ্রাসী হয়েছে। সঙ্গে বেড়েছে চাপও। আবার এটির সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগীও টেন্ডুলকারই। তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে প্রায় মিলে গেছে ভারতে স্যাটেলাইট টেলিভিশন যুগের শুরু। যা খুলে দিয়েছে খেলার বাইরেও অর্থাগমের সিংহদ্বার। উপার্জনের এই খাতটা বাড়তি। শুধু খেলেই যা পেয়েছেন, সেটিই আরও দুই-তিন পুরুষ পায়ের ওপর পা তুলে খাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।

ব্র্যাডম্যানের যেখানে শুধুই ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকাটা ছিল অবাস্তব এক বিলাসী ভাবনা। ১৪ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে এক রিয়েল এস্টেট এজেন্টের অফিসে কেরানির চাকরি নিতে হয়েছিল। বিখ্যাত হয়ে যাওয়ার পরও জীবিকার জন্য কিছু না কিছু করে যেতে হয়েছে। ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ড কাঁপিয়ে দেশে ফেরার পরই যোগ দিতে হয়েছে সিডনির স্পোর্টস শপে সেলসম্যানের কাজে। 'এভরিডে ইজ আ রেইনবো ডে ফর মি’ গান বেঁধেছেন, কিন্তু দিনগুলো রংধনুর রঙে আঁকা হয়ে থাকলে তা হয়েছে ওই স্পোর্টস শপের মালিক মিকস্ সিমন্ডসের। ব্র্যাডম্যানের অটোগ্রাফ-সংবলিত ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস, জার্সি কিনতে লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ওই দোকানে। ব্র্যাডম্যানের বেতন বেড়েছিল কি না, এই তথ্য কোথাও নেই। সিডনি ছেড়ে অ্যাডিলেডে পাড়ি জমানোর সবচেয়ে বড় কারণ ছিল, ওখানে গেলে স্টকব্রোকারের কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা। বাড়তি কিছু অর্থের জন্য পত্রিকায় লিখতে গিয়ে বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়েছেন। একই কারণে একসময় টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে খেলার কথাও সিরিয়াসলিই ভাবতে শুরু করেছিলেন।

(লেখকের 'শচীন রূপকথা' বই থেকে)

চলবে...

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×