ব্র্যাডম্যান-টেন্ডুলকারের মিল-অমিল
৩১ আগস্ট ২০২১
শুধু ব্যাটিং-কীর্তির কথা যদি বলা হয়, তো শচীন টেন্ডুলকার আর ডন ব্র্যাডম্যানের মাঝে চলে আসবে আরও বেশ ক`টা নাম। ব্যাটিং কীর্তির চেয়ে অন্য একটা ক্ষেত্রে ব্র্যাডম্যান-টেন্ডুলকারের তুলনাটা বরং বেশি প্রাসঙ্গিক—খ্যাতি। দুজনই নিজেদের দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ এবং সেই খ্যাতি খেলার সীমানা ছাড়িয়ে সমাজের সব স্তরেই পরিব্যাপ্ত। ব্র্যাডম্যান যত দিন বেঁচে ছিলেন, `দ্য গ্রেটেস্ট লিভিং অস্ট্রেলিয়ান` তকমাটা আঠার মতো গায়ে লেগে ছিল। মৃত্যুর পর পরিবর্তন বলতে ‘লিভিং’ শব্দটির বিলুপ্তি।
ভিন্ন সময়, ভিন্ন পরিস্থিতি, ভিন্ন প্রেক্ষাপট। সমসাময়িক অন্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে তুলনা বরং কাউকে বিচারের সবচেয়ে ভালো আয়না। তা সেটি কী বলে? বহু বছর ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং গড়ের সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম পোলক (৬০.৯৭)। পোলকের প্রায় পাশেই ব্র্যাডম্যানের সমসাময়িক ওয়েস্ট ইন্ডিজের জর্জ হেডলি (৬০.৮৩) ও ইংল্যান্ডের হার্বার্ট সাটক্লিফ (৬০.৭৩)। সম্প্রতি পোলককে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে চলে এসেছেন অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম ভোজেস (৬১.৮৭) ও স্টিভ স্মিথ (৬১.৮০)। হেডলি আর সাটক্লিফের মাঝখানে মারনাস লাবুশেন (৬০.৮০)।
তাতে বৃহত্তর ছবিটার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ইয়ান চ্যাপেল যেমন মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ব্যাটিং গড়ের বিচারে ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে পরবর্তী সেরার পার্থক্যটা হলো ৪০। যে পার্থক্যটাই ব্যাটিং গড় হলে সেই ব্যাটসম্যান 'বেশ ভালো' বলে স্বীকৃতি পেয়ে যান।
টেন্ডুলকার ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ৫৩.৭৮ গড় নিয়ে। আশপাশে গিজগিজে ভিড়। হ্যামন্ড, হবস, হাটন, উইকস, ওয়ালকট, ব্যারিংটন, সোবার্স, গ্রেগ চ্যাপেল, ভিভ রিচার্ডস, গাভাস্কার, মিয়াঁদাদদের তো আগে থেকেই ৫০-এর বেশি গড় নিয়ে ‘গ্রেট ব্যাটসম্যান’-এর সীমানায় বসবাস। সমসাময়িকদের মধ্যে শুধু ১৫টি নাম বলি—সাঙ্গাকারা, ক্যালিস, লারা, দ্রাবিড়, স্টিভ ওয়াহ, পন্টিং, হেইডেন, শেবাগ, চন্দরপল, ইউনিস, ইউসুফ, হাসি, ডি ভিলিয়ার্স, ক্লার্ক, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। ব্যাটিং গড়ে যাদের কেউ কেউ টেন্ডুলকারের ওপরেও।
ব্যাটিং কীর্তির চেয়ে অন্য একটা ক্ষেত্রে ব্র্যাডম্যান-টেন্ডুলকারের তুলনাটা বরং বেশি প্রাসঙ্গিক—খ্যাতি। দুজনই নিজেদের দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ এবং সেই খ্যাতি খেলার সীমানা ছাড়িয়ে সমাজের সব স্তরেই পরিব্যাপ্ত। ব্র্যাডম্যান যত দিন বেঁচে ছিলেন, 'দ্য গ্রেটেস্ট লিভিং অস্ট্রেলিয়ান' তকমাটা আঠার মতো গায়ে লেগে ছিল। মৃত্যুর পর পরিবর্তন বলতে ‘লিভিং’ শব্দটির বিলুপ্তি।
দুজনের ব্যাটই বয়ে বেড়িয়েছে পুরো দেশের প্রত্যাশার ভার। ব্র্যাডম্যানের আবির্ভাবের সময় অস্ট্রেলিয়া ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুরবস্থার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। ইতিহাসে যেটি 'গ্রেট ডিপ্রেশন' নামের বিভীষিকা হয়ে আছে। বডিলাইন সিরিজে যখন খেলছেন, অস্ট্রেলিয়ার তিনটি পরিবারের মধ্যে একটি উপার্জনহীন। সেই অন্ধকারে আলো ছড়ানোর দায়িত্ব এসে বর্তেছিল ব্র্যাডম্যানের ওপর। ডাবল-ট্রিপল সেঞ্চুরিতে মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়নি। কিন্তু ক্ষণিকের জন্য হলেও মুখে হাসি ফুটেছে। যতবার ব্যাট করতে নেমেছেন, মানুষ সেঞ্চুরি চেয়েছে। নিজেকে এমন একটা অতিমানবীয় পর্যায়ে তুলে নিয়েছিলেন যে, সেটিই পরিণত হয়েছে বিষম দায়ে। প্রতিবার উইকেটে যাওয়ার সময় টেন্ডুলকারের সঙ্গেও হেঁটে গেছে একই প্রত্যাশা। সেটি আরও অনেক অনেক গুণ বেশি মানুষের। শুধু ব্র্যাডম্যানকে দেখতেই মাঠে দর্শক আসত। টেন্ডুলকারের টানেও এসেছে।
জন-উন্মাদনার দিক থেকে দুজনই সমান্তরালে। তবে ব্র্যাডম্যানেরটা একটু বেশিই অবাক করার মতো। শচীন টেন্ডুলকারকে নিয়ে অস্বাভাবিক কিছু হয়নি। ক্রিকেটারদের নিয়ে উন্মাদনায় এই উপমহাদেশ বরাবরই এক নম্বরে। ব্যক্তিপূজার চলও এখানে বেশি। কিন্তু ওসব দেশে তো তা নয়। সেখানে ‘প্রাইভেসি’ ধর্মগ্রন্থের মতো সশ্রদ্ধ আনুগত্য দাবি করে। সিডনির রাস্তায় স্টিভ ওয়াহকে নির্বিঘ্নে হেঁটে বেড়াতে দেখেছি। লন্ডনে ইয়ান বোথামকে। হ্যামিল্টনে অবাক হয়ে দেখেছি, স্যার রিচার্ড হ্যাডলি রাস্তায় হাঁটছেন, বড়জোর দু-একজন একবার ফিরে তাকাচ্ছে। সেখানে ব্র্যাডম্যান অবসর নেওয়ার পরও সাধারণ্যে যেতে পারেননি। বাবার খ্যাতির বিড়ম্বনায় ছেলে পদবি পর্যন্ত বদলে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। সেটিও কোন সময়ে!
চৌকোনো বাক্স টেন্ডুলকারকে ভারতের প্রত্যন্ত গৃহকোণেও পৌছে দিয়েছে। ব্র্যাডম্যানের সময় তো ঘটনা তা ছিল না। টেন্ডুলকারকে মানুষ প্রতিদিন চোখের সামনে ঘটতে দেখেছে। ব্র্যাডম্যানকে আর কতটুকু দেখার সুযোগ পেয়েছে আমজনতা! অথচ সেই সময়েও ওই মুখটা কীভাবে এমন পরিচিতি পেয়ে গেল যে, এনভেলাপে শুধু মুখের ছবিই প্রাপকের কাছে ঠিক ঠিক চিঠি পৌঁছে দিত। ঘটনাটা কাল্পনিক নয়। ইংল্যান্ডে খেলছিলেন। আমস্টারডাম থেকে এক ভক্ত ডনকে চিঠি লিখেছেন, কিন্তু ঠিকানা কী লিখবেন? চিঠি পৌঁছাতে কত দিন লাগে আর ব্র্যাডম্যান তখন কোথায় থাকেন, কে জানে! সহজ সমাধানও বেরিয়ে গেল। 'টু মিস্টার'-এর পর ব্র্যাডম্যানের একটা ছবি লাগিয়ে নিচে লেখা হলো 'সামহোয়্যার প্লেয়িং ইন ইংল্যান্ড'। পুরো মুখেরও নয়, নাক পর্যন্ত ছবি। লর্ডসে সেই চিঠি হাতে পেয়েও গেলেন ব্র্যাডম্যান!
খেলা ছাড়ার পর প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছেন অনেক দিন। খেলোয়াড়ি জীবনেই নির্বাচকের ভূমিকায় অভিষেক, টানা ৩৭ বছর সেই দায়িত্ব পালন করার পর ছাড়লেন ১৯৭১ সালে। দুই মেয়াদে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান। একটা সময়ে ক্রমাগত প্রচারের আলোয় তিতিবিরক্ত তিনি চলে গেছেন নিভৃত জীবনে। কোনো পাবলিক ফাংশনে যেতেন না। নিজের ৯০তম জন্মদিনে আয়োজিত বিশাল ডিনার পার্টিতে পর্যন্ত অনেক অনুরোধেও নেওয়া যায়নি। ক্রিকেটে তুলনা খুঁজে না পেয়ে রুপালি জগতে যেতে হচ্ছে। তবে গ্রেটা গার্বো-সুচিত্রা সেনদের অন্তরালে চলে যাওয়ার অন্য কারণ ছিল। দর্শকের মনে নিজের গ্ল্যামারাস রূপটাকেই চিরস্থায়ী ছবি করে রাখা। ব্র্যাডম্যানের ঘটনা তো তা নয়। তিনি কেন ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?
আত্মজীবনীতে উত্তরটাও দিয়ে গেছেন— সাধারণ মানুষের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, পাবলিক ফিগার হওয়ার যন্ত্রণাটা কেমন। মেলবোর্নের ট্রেনে, স্ট্রান্ডের বাসে, এমনকি পোর্ট সৈয়দের দোকানে দেখামাত্র কেউ চিনে ফেলার অর্থ আসলে কী! একবার প্যারাম্বুলেটরে বাচ্চা নিয়ে এক ভদ্রমহিলা অটোগ্রাফ চাইলেন। বাচ্চা যখন বড় হবে, তখন তাকে দেবেন বলে নাকি নিয়ে রাখছেন। অনেকেই হয়তো আবেগে অভিভূত হয়ে বলবে, আহা, কী কমপ্লিমেন্ট! হয়তো তা-ই, তবে আপনাকে বলব পঞ্চাশ বছর এটি করে যেতে, তাহলে বুঝবেন স্নায়ুতন্ত্রের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে যায়!
‘কী ঝড় বয়ে যায়’–এটি হয়তো শচীন টেন্ডুলকারই একদিন সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন।
*লেখকের 'শচীন রূপকথা' বই থেকে।
চলবে...