আসলেই তো ব্যাখ্যার অতীত

উৎপল শুভ্র

৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

আসলেই তো ব্যাখ্যার অতীত

শুধু ব্যাটসম্যান ব্র্যাডম্যান নয়, মানুষ ব্র্যাডম্যানও একই রকম ব্যতিক্রমী। কখনো কখনো সাধারণ যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে। ব্র্যাডম্যানের জীবনী লিখতে গিয়ে এরই একটা প্রমাণ পেয়েছিলেন রোনাল্ড পেরি। যাকে অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়।
ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে ধারাবাহিকের শেষ পর্ব।

শুধু ব্যাটসম্যান ব্র্যাডম্যানই নন, মানুষ ব্র্যাডম্যানও যেন বিরল এক প্রজাতি ৷ আত্মজীবনীতে জীবনের খুঁটিনাটি এত গুছিয়ে লিখেছেন যে, অবাক হতে হয়। সেটি তো ইন্টারনেটের যুগ নয় যে, কি-বোর্ডে চাপ দিলেই সব বেরিয়ে আসবে সেই বইয়ে 'ক্রিটিকস্' নামে একটি অধ্যায় আছে। কবে কোন পত্রিকায় কী লেখা হয়েছিল, কিছুদিনের ব্যবধানে একই পরিস্থিতিতে একই সাংবাদিকের লেখায় কেমন পরস্পর বিরোধিতার ছাপ সব মনে রেখেছেন। ধরে ধরে জবাব দিয়েছেন ‘অন্যায়' সমালোচনার।

পারফেকশনিস্টের চূড়ান্ত। কোথাও কিছু বলতে হলে বাড়িতে গ্রামোফোনে রেকর্ড করে রিহার্সাল দিয়ে নিতেন। ১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ডে শেষ সফরের জাহাজ-যাত্রায় লাঞ্চের আগে কেউ তাঁর দেখা পায়নি। নৈশভোজ-উত্তর বক্তৃতা দেওয়াটা তখন অধিনায়কের কার্যবিবরণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। দুপুর পর্যন্ত ব্র্যাডম্যান ব্যস্ত থেকেছেন সেসবের খসড়া তৈরির কাজে। প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ফ্যান-মেল এসেছে। জীবনের শেষ প্রান্তে অসুস্থতা কাবু করে ফেলার আগ পর্যন্ত নিজ হাতে লিখে প্রতিটি চিঠির উত্তর দিয়েছেন।

প্রখর স্মৃতিশক্তি ও চিন্তাশীল মনের কাছে বার্ধক্যকে পর্যন্ত পরাজয় মানতে হয়েছে। উদাহরণ অনেকই আছে। এর একটি দিই। রোনাল্ড পেরি নামটা হয়তো শুনে থাকবেন । ব্র্যাডম্যানের মৃত্যুর পর 'ব্র্যাডম্যানস ইলেভেন' নামে বহুল আলোচিত বইয়ের লেখক। ব্র্যাডম্যানের সবচেয়ে বিখ্যাত জীবনীটাও তাঁরই লেখা। এই বইয়ের জন্যই ১৯৯৫ সালে ব্র্যাডম্যানের বেশ কয়েকটি ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন।

একটু ছুঁয়ে দেখতে...১৯৪৮ সালে এমসিজিতে এক টেস্টিমোনিয়াল ম্যাচে ব্যাট করতে নামছেন ডন ব্র্যাডম্যান

প্রথম ইন্টারভিউটি নিতে গিয়েছিলেন ভয়ে ভয়ে। সাত ঘণ্টা স্থায়ী ওই ইন্টারভিউয়ের শেষ দিকে ৮৭ বছর বয়সী বৃদ্ধের ওপর অত্যাচার হয়ে যাচ্ছে কি না ভেবে একটু অস্বস্তি বোধ করছিলেন। বেরিয়ে আসেন বিস্মিত হয়ে এবং পরে বলেন, সাত ঘণ্টায় ব্র্যাডম্যান একটিও অপ্রাসঙ্গিক শব্দ বলেননি। মনঃসংযোগের এমন ক্ষমতা তিনি আর কারও মধ্যে দেখেননি।

আসল গল্প এটা নয়। আগেই বলা ছিল, এটা হবে আনঅথারাইজড জীবনী। মানে জীবনীকারের যা ঠিক মনে হয়, তা-ই লিখবেন। সাবজেক্টের সেখানে কোনো ওজর-আপত্তির জায়গা নেই। ব্র্যাডম্যান একদিন ফোন করে পাণ্ডুলিপিটা দেখতে চাইলে রোনাল্ড পেরি তাই একটু বিব্রতই হলেন। বুঝতে পেরে ব্র্যাডম্যান তাঁকে আশ্বস্ত করেন, ‘আমি শুধু তথ্যগত কোনো ভুল আছে কি না, সেটি দেখব।'

ডন ব্র্যাডম্যানের এই জীবনী লিখতে গিয়ে বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা হয়েছিল রোনাল্ড পেরিরতো রোনাল্ড পেরি এয়ার এক্সপ্রেসে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দিলেন। ব্র্যাডম্যান তা হাতে পেলেন মঙ্গলবার দুপুরে। বুধবার, মানে পরদিনই ফোন করে ব্র্যাডম্যান জানালেন, তাঁর পড়া হয়ে গেছে। চার পৃষ্ঠা নোট নিয়েছেন, ৮০টা পয়েন্ট নিয়ে পেরির সঙ্গে কথা বলতে চান। পেরি কি আর একবার তাঁর বাড়িতে যেতে পারবেন?

ওই পাণ্ডুলিপিতে আড়াই লাখ শব্দ! পড়তে ডনকে নিশ্চয়ই সারা রাত জাগতে হয়েছে এই বিস্ময় নিয়ে পরদিন মেলবোর্ন থেকে অ্যাডিলেডে পৌছালেন পেরি। ব্র্যাডম্যান স্টাডি রুমে ৮০টা পয়েন্ট নিয়ে বসলেন। বেশির ভাগই বানান বা পরিসংখ্যানগত ভুল। তবে একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা একটু দীর্ঘ হলো। পেরি লিখেছিলেন, ১৯৩০ সালে লর্ডসে ব্র্যাডম্যানের প্রথম রানটা ছিল মিড অনে খেলে।

ব্র্যাডম্যানের দাবি, মিড অন নয়, মিড অফ হবে। পেরি মিড অনেই। অনড় থাকায় ব্র্যাডম্যান তথ্যসূত্র জানতে চাইলেন। তিনজনের নাম। বলা হলো। ব্র্যাডম্যান তাতেও নিরস্ত নন। চোখ বন্ধ করে মনে মনে শটটা যেন আবার খেললেন। চোখ খুলে ‘না, এটা মিড অফেই ছিল’ বলে ফিল্ডারের নামও বলে দিলেন। অবাক বিস্ময়ে পেরিকে ব্র্যাডম্যানের কথাই মেনে নিতে হলো। ১৯৩১ সালে কী একটা ম্যাচে ব্র্যাডম্যান তিন ওভারে (আট বলের ওভার) একটা সেঞ্চুরি করেছিলেন। সেটির বর্ণনায় শটের ক্রমপর্যায়ে একটা ভুল ছিল। সেটিও ঠিক করে দিলেন।

এই লোক সম্পর্কে কী বলা যায়!

ফেনোমেনন? বোঝানো গেল না।

‘ফ্রিক' শব্দটাই বোধ হয় কাছাকাছি হয়।

(লেখকের 'শচীন রূপকথা' বই থেকে)

সমাপ্ত

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×