স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০:৩৩

যে মহোৎসবের মাধ্যমে বাংলাদেশকে চিনেছিল ক্রিকেট বিশ্ব

দুলাল মাহমুদ

১২ সেপ্টেম্বর ২০২১

যে মহোৎসবের মাধ্যমে বাংলাদেশকে চিনেছিল ক্রিকেট বিশ্ব

কত নামী খেলোয়াড়, কত দামি আয়োজন। স্বাধীনতার পর এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন কত কিছুরই না সাক্ষী! ১৯৯৮ সালে মিনি বিশ্বকাপ নামেই বেশি পরিচিত উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ আয়োজনের মাধ্যমে ক্রিকেট বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে দেয় ঢাকা। ধারাবাহিকের ৩৩তম পর্বে আজ সেই টুর্নামেন্টের কথা।

এখনও কি বাংলাদেশের ক্রিকেটার কিংবা ক্রিকেট অনুরাগীদের ভাবনায় আছে আইসিসি ট্রফি? এমন প্রশ্ন অর্থহীন প্রলাপের মতো মনে হতে পারে। হওয়ারই তো কথা। এ নিয়ে এখন আর ভাবনা-চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। কেনই বা থাকবে? বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে এই ট্রফির তো এখন আর কোনো গুরুত্ব নেই। সে তো অতীতের এক নস্টালজিয়া। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়ানো ক্রিকেটারদের এ নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে। স্মৃতিকাতর কারও কারও কাছে তা হয়তো অ্যালবামে রাখা পুরানো দিনের ছবি উল্টিয়ে দেখার মতো সুখস্মৃতি অনুভব হতে পারে। ক্রিকেট বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমেই তো শুরু বাংলাদেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রার। 

সেই সাফল্য পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশের জন্য ছটফট করতে থাকে বাংলাদেশ। নির্দিষ্ট গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য একের পর এক হার্ডলস অতিক্রম করার তাগাদা অনুভব করতে থাকে। সাবের হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তখন কোনো কিছুকে অসম্ভব মনে করেনি। যেভাবেই হোক সামনে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে। সুনির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। সে সময় তা উচ্চাভিলাষী মনে হলেও পর্যায়ক্রমে প্রতিটি ধাপ সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। বুঝিয়ে দিতে পেরেছে মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়। স্বপ্ন না থাকলে তো সাফল্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। 

দক্ষিণ আফ্রিকার একমাত্র বৈশ্বিক শিরোপা। ১৯৯৮ মিনি বিশ্বকাপ, ঢাকাক্রিকেট অনুরাগের দিক দিয়ে বাংলাদেশ যে মোটেও পিছিয়ে নেই, তা ক্রিকেট বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়ার একটা তাগিদ অনুভব হতে থাকে। এটা অবশ্য অস্বীকার করা যাবে না, বাঙালির আবেগের কাছে ভেসে যায় সব প্রতিরোধ। আর আতিথেয়তার ক্ষেত্রে তো তার জুড়ি মেলা ভার। এর আগে এশিয়া কাপ, ইনডিপেনডেন্স কাপের মতো ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে বাংলাদেশ। 

তাই বলে টেস্ট খেলুড়ে ৯টি দেশকে নিয়ে আইসিসি নকআউট টুর্নামেন্ট! যা পরিচিতি পায় উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ নামে, আয়োজন করার দুঃসাহস দেখাবে? বিশ্বকাপের বাইরে এই ধরনের টুর্নামেন্ট তো ক্রিকেট বিশ্ব এর আগে প্রত্যক্ষ করেনি। আর এর আয়োজক কিনা টেস্ট পরিবারের বাইরের দেশ বাংলাদেশ! তখনও বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেকটা ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দারের মতো আর কি। অবশ্য কিছু না থাকলেও বাঙালির আছে বুক ভরা আত্মবিশ্বাস। সেই আত্মবিশ্বাসের কারণে যে কোনো চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখাতে পারে।

পারে বলেই অসম্ভবকে সম্ভব করার চ্যালেঞ্জ নেয় বাংলাদেশ। ক্রিকেট বিশ্বের ক্ষুদ্র শক্তি হয়েও আইসিসির কাছে আয়োজক হওয়ার আবেদন জানায় বাংলাদেশ। আর এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন আইসিসি তদানীন্তন সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া। তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের অকৃত্রিম সুহৃদ। দুই দিনের সফরে ঢাকা এসে ঢাকা স্টেডিয়ামের সুযোগ সুবিধা সরেজমিনে ঘুরে ঘুরে দেখেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করেন। তারপরও আইসিসির মন গলানো সহজ হয়নি। 

মিনি বিশ্বকাপকে ঘিরে ঢাকা পরিণত হয়েছিল উৎসবের নগরীতে

আইসিসিতে তো আর একজন ডালমিয়াই সর্বময় কর্তা ছিলেন না। কত মত কত পথ। যে কারণে আন্তরিক সমর্থন ও সদিচ্ছা থাকলেও সবাইকে তাঁর মতের অনুসারী করার ক্ষমতা তো আর ছিল না। অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর আয়োজক হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বাদ পড়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ঢাকা। নির্বাচিত হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। যে কোনো কারণেই হোক, মাসখানেক পর আমিরাত আয়োজক হতে অপারগতা প্রকাশ করলে শিকে ছেঁড়ে ঢাকার ভাগ্যে। কিন্তু তখন দেশে বন্যার কারণে এই টুর্নামেন্ট আয়োজন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয় সন্দেহ, সংশয়, আশঙ্কা। কিন্তু আয়োজকদের আন্তরিকতার কাছে সব আশঙ্কা দূর হয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত জনজীবন এই টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে খানিকটা স্বস্তি খুঁজে পায়। 

ঢাকায় ক্রিকেটের এই মহোৎসবকে কেন্দ্র করে উৎসবমুখর হয়ে উঠে বাংলাদেশ। শুরু হয় ব্যাপক মহাযজ্ঞ। নতুন সাজে সাজানো হয় ঢাকা স্টেডিয়ামকে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সংস্কার, ডে-নাইট ক্রিকেটের জন্য উপযুক্ত আলোর ব্যবস্থা, আধুনিক ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডসহ খোলনলচে বদলে ফেলা হয়। মোটাদাগে  ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। এমন আয়োজনের সঙ্গে এই দেশের মানুষের পরিচয় ছিল না। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে ক্রিকেটের মৌ মৌ গন্ধের সৌরভ।

১৯৯৮ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত আয়োজিত নকআউট বিশ্বকাপ হিসেবে পরিচিত এই টুর্নামেন্টে অংশ নেয় জিম্বাবুয়ে, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তান। টেস্ট খেলুড়ে সবগুলো দেশকে এক সঙ্গে দেখতে পাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো। সমসাময়িককালে দুনিয়ার তাবৎ ক্রিকেট তারকাদের একই ছাতার নিচে সমবেত হওয়াটা ছিল সাড়া জাগানো ঘটনা। একই ভেন্যুতে এতগুলো দেশের খেলাটাও ছিল নজিরবিহীন। আর ক্রিকেট বিশ্বে তখন বাংলাদেশের অবস্থান মোটেও সুদৃঢ় নয়। কিন্তু সাংগঠনিক দক্ষতা আর আন্তরিকতা দিয়ে আয়োজক হিসেবে চ্যালেঞ্জ নিতে একটুও দ্বিধা করেনি। নিজেদের নিষ্ঠা ও নিবেদন ঢেলে দিয়ে আয়োজন করে মিনি এই বিশ্বকাপ।

উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপে বাংলাদেশ অংশ নিতে না পারলেও এই টুর্নামেন্ট হয়ে উঠে নগর বিনোদনের অন্যতম খোরাক। ক্রিকেট দুনিয়াকে কাছ থেকে দেখার এমন মোক্ষম সুযোগ তো এক জীবনে বার বার আসার সুযোগ ছিল না। যে ক্রিকেটাররা স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে হৃদয়ে এঁকেছেন স্বপ্নের আল্পনা, তাঁরা নেমে আসেন হাত বাড়ানো দূরত্বে। বিমোহিত করেন ক্রিকেটপ্রেমীদের। সঙ্গত কারণেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়েসী দর্শকের গন্তব্য ছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। অপরিচয়ের দূরত্ব ঘুচিয়ে পাশাপাশি বসে উপভোগ করেন খেলা। প্রতিটি মুহূর্ত গ্যালারি ছিল প্রাণবন্ত, প্রাণোচ্ছ্বল। স্বাগতিকদের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও কোনো টুর্নামেন্ট দর্শকদের মধ্যে এত আগ্রহ সঞ্চার করতে পারে, তা ভাবাই যায় নি। প্রতিটি ম্যাচেই ছিল উপচে পড়া ভিড়। বৃষ্টিও কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। 

শুধু ঢাকা শহর কেন, টেলিভিশনের কল্যাণে ক্রিকেটের রূপ-রস-সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে। একইসঙ্গে বর্হিবিশ্বে দৃশ্যমান হয় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন, দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, অরণ্য, নদী। উন্মীলিত হয় মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, লোকায়ত সংস্কৃতি। অন্তত ক্রিকেট বিশ্ব জানতে পারে এই দেশকে। চিনতে পারে এই দেশের মানুষকে। বাড়ে বাংলাদেশের পরিচয়ের বলয়। শারজা, টরন্টোর মতো ক্রিকেট-নগরী হিসেবে স্বীকৃতি পায় ঢাকা। 

উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ ছিল দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। হানসি ক্রনিয়ের নেতৃত্বে প্রথম কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে শিরোপা জয় করে দক্ষিণ আফ্রিকা। ফিলো ওয়ালেসের পাওয়ার ক্রিকেট, শচীন টেন্ডুলকারের প্রাণোচ্ছ্বল ব্যাটিং, জ্যাক ক্যালিস আর অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের দুর্দান্ত শতক, ব্যাটিং উইকেটের স্বর্গভূমিতে বোলারদের মাথা কুটে মরা, জন্টি রোডসের চিতা বাঘের মতো শিকার ধরা ক্রিকেটানুরাগীদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। 

নয়টি দেশকে নয় দিন রোদ-বৃষ্টিতে, আলোয়-অন্ধকারে উৎসবের আনন্দে অভিভূত করে রাখে। ক্রিকেট মাধুর্যে আপ্লুত হয়েছেন কত কত মানুষ। স্বাগতিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আতিথ্য সবার মন জয় করতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে ক্রিকেট মানচিত্রে আলাদাভাবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×