`টাই` টেস্টের শেষ ওভার এবং ওয়েস হল

উৎপল শুভ্র

১২ সেপ্টেম্বর ২০২১

`টাই` টেস্টের শেষ ওভার এবং ওয়েস হল

ব্রিসবেনে `টাই` টেস্টের অমর সেই শেষ দৃশ্য

পরে তো মিছিল করেই ফাস্ট বোলার এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে। তাঁর আগেও দুয়েকজন যে আসেননি, তা নয়। তবে টেস্ট ক্রিকেটে ছাপ রেখে যাওয়ার মতো প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান গ্রেট ফাস্ট বোলার তিনিই। ৪৮ টেস্ট ১৯২ উইকেটই তা বলে দেয়। ওয়েস হলের অনেক বোলিং কীর্তির মধ্যে আমার অবশ্য প্রথমেই মনে হয় ১৯৬০-৬১ সিরিজে ব্রিসবেনে ইতিহাসের প্রথম `টাই` টেস্টের শেষ ওভার। দুই বল বাকি থাকতে হলকে কী বলেছিলেন অধিনায়ক ফ্র্যাঙ্ক ওরেল?

‘ফ্র্যাঙ্ক ওরেল কি সত্যি আপনাকে ওই কথা বলেছিলেন?’

ওয়েস হল প্রশ্নটাতে যেন একটু বিরক্তই হলেন, ‘কেন, আপনার সন্দেহ হচ্ছে কেন?’

আমি হেসে ফেললাম, ‘না, সন্দেহ নয়। ক্রিকেটে অনেক গল্পগাথাই তো মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে সত্যি হয়ে যায়। আপনাকে পেয়ে মনে হলো, ব্যাপারটা কনফার্ম করে নিই।’

হলও এবার হাসলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘কনফার্মড।’

কী কনফার্মড? এই ‘গল্প’টা–

দুই দলের স্কোর সমান, বল বাকি দুটি, উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার শেষ দুই ব্যাটসম্যান। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অধিনায়ক ফ্র্যাঙ্ক ওরেল বোলার হলকে বললেন, ‘ওয়েস, যদি নো বল করো, তুমি আর কোনো দিন বারবাডোজ ফিরতে পারবে না।’

এরপর কী হয়েছিল, সেটি বলা কি খুব জরুরি? জরুরি, যদি ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে আপনার তেমন আগ্রহ না থেকে থাকে। নইলে বুঝে ফেলার কথা, টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ‘টাই’ টেস্ট নিয়ে কথা হচ্ছে। খুব নাটক করে তা বলতে গেলে ‘এটা কে না জানে’ ভেবে বিরক্তি উত্পাদনেরও সম্ভাবনা আছে।

তা হঠাৎ প্রায় ১১ বছর আগে বারবাডোজে ওয়েস হলের সঙ্গে ওই আলাপচারিতার স্মৃতিচারণা কেন?  উপলক্ষ তো একটা আছেই। আজ যে ওয়েস হলের জন্মদিন। ক্যারিয়ারে আরও কত কিছুই করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের প্রথম গ্রেট ফাস্ট বোলার হিসেবেও সবাই মেনে নিয়েছেন তাঁকে। তারপরও ওয়েস হলের কথা উঠলেই প্রথমেই আমার মনে পড়ে, ওই ‘টাই’ টেস্টের শেষ ওভার।

ওয়েস হল

আমার জন্মেরও বেশ কয়েক বছর আগে ব্রিসবেনে ১৯৬০ সালের ওই ‘টাই’ টেস্ট। অথচ কী ভুতুড়ে ব্যাপার দেখুন, মনে হয়, ওই টেস্টটা আমি নিজের চোখেই দেখেছি! গ্যারি সোবার্সের অসাধারণ ১৩২, যেটিকে রিচি বেনো তাঁর দেখা সেরা ইনিংসগুলোর মধ্যে রাখেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে নরম্যান ও’নিলের ১৮১ এবং তাতেও সোবার্সের অবদান! ৪৭ রানে স্লিপে ক্যাচ ফেলে। নতুন বুটে ফোসকা পড়ে যাওয়া পা নিয়ে হলের অদম্য বোলিং (৪/১৪০+৫/৬৩)। অ্যালান ডেভিডসনের দুর্দান্ত অলরাউন্ড নৈপুণ্য—দুই ইনিংস মিলিয়ে ১২৪ রান ও ১১ উইকেট, টেস্ট ক্রিকেটে তিন অঙ্কের রানের সঙ্গে ১০ উইকেটের যুগলবন্দী ওই প্রথম।

এ তো গেল নায়কদের কথা। পার্শ্বনায়কও তো কত! সবকিছু ছাপিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত ওই শেষ ওভার। তখন ৮ বলের ওভার, ৩ উইকেট হাতে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার চাই ৬ রান। হলের ওই ওভারে কী হয়নি! তিনটি উইকেট, যার দুটি রান আউট, রান আউট মিস, ক্যাচ ড্রপ…আপনি চাইলে আমি বল বাই বল বর্ণনা দিতে পারব।

এক বল বাকি থাকতে স্কোর সমান অবস্থায় জো সলোমনের থ্রোতে অস্ট্রেলিয়ার শেষ ব্যাটসম্যান ম্যাকাই রান আউট! টেস্টে ‘টাই’ অদৃষ্টপূর্ব ছিল বলে কী রেজাল্ট হলো দু দলের কেউ তা প্রথমে বুঝতেই পারেনি। ম্যাকাই তো বিড়বিড় করে এ-ও বলেছিলেন, ‘এভাবে কেউ হারে নাকি!’

ওয়েস হল কি বুঝতে পেরেছিলেন? বারবাডোজের লিজেন্ডস্ ক্লাবের আড্ডা থেকে ততক্ষণে উঠে পড়েছেন হল। পায়ে কী একটা সমস্যা আছে, একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। হাঁটতে হাঁটতেই একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমার মাথা কাজই করছিল না। বেশি কিছুক্ষণ লেগেছে বুঝতে।’  

ব্যাটসম্যানদের বুকে কাঁপন ধরাত ওয়েস হলের বোলিং। ছবি; গেটি ইমেজেস

ওয়েস হলের সঙ্গে কথপোকথনটা বাড়তি সংযোজন। বাকি সব পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। ওই ‘টাই’ টেস্টে খেলেছেন, এমন যে আটজনের (সোবার্স, হল, কানহাই, স্মিথ এবং বেনো, সিম্পসন, ডেভিডসন ও হার্ভি) সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে, ‘টাই’ টেস্টের খুঁটিনাটি বলে তাঁদের তাকও লাগিয়ে দিয়েছি।

নিজেকে জাহির করার জন্য এসব বলছি না। বলছি ওই ‘টাই’ টেস্টটির মহিমা বোঝাতে। মাঠে বসে কাভার করেছি, এমন অনেক টেস্ট ম্যাচও তো মনের পর্দায় এমন জীবন্ত ছবি হয়ে নেই। হয়ে নেই টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয় ‘টাই’টিও (ভারত-অস্ট্রেলিয়া, মাদ্রাজ, ১৯৮৬), যদিও সেটি আমি তারুণ্যে পা দেওয়ার পরের ঘটনা।

ওই ব্রিসবেন টেস্টের মহিমা তো শুধুই অবিশ্বাস্য সমাপ্তি আর ইতিহাসের প্রথম ‘টাই’য়ে শেষ নয়। এটি আরও বেশি কিছু। জ্যাক ফিঙ্গলটন ব্রিসবেনের ‘টাই’ নিয়ে লেখা বইটির নাম দিয়েছেন ‘দ্য গ্রেটেস্ট টেস্ট অব অল’। ভূমিকায় লিখেছেন, বইটির নাম অনায়াসে ‘ক্রিকেট রিবর্ন’-ও দেওয়া যেত। ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও রিচি বেনোর অস্ট্রেলিয়াকে একেবারে সমতায় শেষ করা ওই অবিস্মরণীয় ম্যাচে তো আসলেই পুনর্জন্ম টেস্ট ক্রিকেটের। থ্রোয়িং মহামারি, নেতিবাচক মানসিকতা, দর্শক হাঙ্গামা..এসব ঘুণপোকার মতো বাসা বেঁধে টেস্ট ক্রিকেটকে নিয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর দুয়ারে। তখনই জিয়নকাঠি হয়ে এল ওই‘টাই’ টেস্ট। পুরো সিরিজই। 

ব্রিসবেনের `টাই` টেস্ট নিয়ে লেখা জ্যাক ফিঙ্গলটনের বইদুই অধিনায়কেরই কৃতিত্ব প্রাপ্য। ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের একটু বেশি। ক্রিকেটটা যে শেষ পর্যন্ত একটা খেলাই এবং এটি খেলে ও দেখে আনন্দ পাওয়াটাই সবচেয়ে বড়…ভুলে যেতে বসা এই মর্মবাণীতে সবার আস্থা ফিরিয়ে এনেছিল ওরেলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এ কারণেই ১-২ ব্যবধানে সিরিজ হেরে দেশে ফেরার সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে বিদায় জানাতে মেলবোর্নে রাস্তার দুপাশে ভিড় করেছিল লাখো মানুষ। সিডনির দ্য টেলিগ্রাফ শিরোনাম করেছিল, ‘দে লস্ট দ্য সিরিজ বাট দে ওয়ান অস্ট্রেলিয়া।’ 

হেরেও তো কখনো কখনো জয়ী হওয়া যায়!
 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×