রবি শাস্ত্রী ভালো বলেছে বলে এত উত্তেজনার কী আছে?

উৎপল শুভ্র

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

রবি শাস্ত্রী ভালো বলেছে বলে এত উত্তেজনার কী আছে?

তোমাকে উৎসাহ দেওয়া, নিজে যতটুকু বুঝি পরামর্শ দেওয়াটাকে কেন যেন একটা দায়িত্বের মতোই বানিয়ে ফেলেছিলাম। নিজেকেই নিজে এখন প্রশ্ন করি—তোমার ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রমটা কেন হয়েছিল? কারণ খুঁজে পাই একটাই, আমার বরাবরই মনে হতো, তুমি কত বড় ব্যাটসম্যান, তুমি নিজেই তা বুঝতে পারছ না।

লিখতে লিখতে তোমার বিখ্যাত, কম বিখ্যাত, হয়তো শুধু আমিই মনে রেখেছি—এমন কত ইনিংসের কথাই তো লিখে ফেললাম। এর সবই এখনো আমার চোখে ভাসে, তারপরও আবারও সেই মায়াবী বিভ্রম জাগে। টেস্টে মাত্র ২৪ আর ওয়ানডেতে ২২.২৩ গড়ের এক ব্যাটসম্যান এত সব স্বর্গীয় স্মৃতি কীভাবে উপহার দিয়েছে। যেটিকে উল্টো করেও বলা যায়, এমন সব ইনিংস খেলা এক ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং গড় কীভাবে এমন হাড় জিরজিরে হয়। আগের মতো এখন আর আমি যেটির ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা খুঁজি না।

একটা অন্য রকম সম্পর্কই গড়ে উঠেছিল তোমার সঙ্গে। ট্যুরে না গেলে, সিরিজ-টিরিজ না চললে খুব যে দেখা-সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা হতো, তা নয়। তবে যখনই তা হতো, তোমাকে উৎসাহ দেওয়া, নিজে যতটুকু বুঝি পরামর্শ দেওয়াটাকে কেন যেন একটা দায়িত্বের মতোই বানিয়ে ফেলেছিলাম। অন্য প্রায় সব ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টাকে যেখানে আমি বরাবরই এড়িয়ে চলি। নিজেকেই নিজে এখন প্রশ্ন করি—তোমার ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রমটা কেন হয়েছিল? কারণ খুঁজে পাই একটাই, আমার বরাবরই মনে হতো, তুমি কত বড় ব্যাটসম্যান, তুমি নিজেই তা বুঝতে পারছ না।তুমি নিজেও বোধ হয় জানতে না, ব্যাটসম্যান হিসেবে তুমি কতটা ভালো। ছবি: রয়টার্স

সেটা তো তোমাকেও অনেকবারই বলেছি। কোথায় কে তোমাকে নিয়ে কী বলেছে, এ নিয়ে তোমার প্রবল আগ্রহ ছিল। ভারতীয়দের মধ্যে গাভাস্কার, মাঞ্জরেকার, শাস্ত্রী সুযোগ পেলেই তোমার প্রশংসা করতেন। একবার শাস্ত্রীর কী একটা কথা নিয়ে তোমার মধ্যে প্রবল উত্তেজনা দেখে বলেছিলাম, 'শাস্ত্রী ভালো বলেছে, ভালো কথা। কিন্তু এ নিয়ে তুমি এত রোমাঞ্চিত কেন? শাস্ত্রী কী প্লেয়ার ছিল, আর তুমি কী প্লেয়ার! তাঁর সার্টিফিকেট তোমার কাছে এত মূল্যবান মনে হবে কেন?'

২০০৯ সালে বারবাডোজে স্যার গ্যারি সোবার্স স্কুল টুর্নামেন্ট নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানটার কথা মনে আছে তোমার? ওই যে অনেক নাচ-গান হলো, তোমরা সবাই গ্যারি সোবার্সের সঙ্গে দল বেঁধে ছবি তুললে। বাংলাদেশের পুরো দলই আমন্ত্রিত ছিল সেখানে। তোমরা ওখানে পৌঁছানোর অনেক আগে থেকেই আমি ওখানে। বিখ্যাত সেই থ্রি ডব্লিউস-এর একমাত্র জীবিতজন স্যার এভার্টন উইকসের সঙ্গে গল্প করছি। বাংলাদেশের সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পরই বলেছেন, 'তোমাদের দলে ছোটখাটো যে ব্যাটসম্যানটা আছে...কী যেন নাম, ও খুব ভালো ব্যাটসম্যান। আমি বলব, দারুণ!' তোমার কথা যে বলছেন, সেটি অনুমান করেছি। নিশ্চয়ই টিভিতে তোমার অনেক খেলা দেখেছেন। বিস্মিত করে উইকস বললেন, তোমাকে দেখা বলতে সেই সফরেরই প্রস্তুতি ম্যাচে। সেই ম্যাচে তুমি একটা হাফ সেঞ্চুরি করেছ। ৫০ রানের একটা ইনিংস দেখেই আপনি এত মুগ্ধ? উইকস কী উত্তর দিয়েছিলেন, জানো? ‘জাত ব্যাটসম্যান দেখলেই চেনা যায়।'

তোমার প্রসঙ্গে এই 'জাত' কথাটা আমি অনেকবারই লিখেছি। ২০০২ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের চ্যালেঞ্জ কাপ নামে নির্বাচনী টুর্নামেন্টটার কথা মনে আছে তো? দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত জাতীয় দল বনাম দলে ফেরার দাবি জানাচ্ছেন, এমন ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া বাংলাদেশ 'এ'। শ্রীলঙ্কায় এক টেস্টে ৭৫ করার পরও দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে বিস্ময়করভাবে বাদ পড়ায় তুমি খেলছ ‘এ’ দলে । চোটের কারণে হারিয়ে যাওয়া তালহা জুবায়েরের বলে তখন রীতিমতো গতির ঝড়। যেটির সামনে নান্নু-আকরামের মতো ব্যাটসম্যানের অবস্থাও খুব সুবিধার নয়। আর তুমি তালহার এক ওভারে তিনটি ছয় মারলে। এর মধ্যে ফ্লিক করে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে মারা ছক্কাটা ফ্রন্ট ফুটে গিয়ে। ম্যাচ রিপোর্টে আমি লিখলাম, 'তালহার এক ওভারে ওই ৩টি ছয় যারা দেখেছেন, সবকিছু ছাপিয়ে তাঁদের মনে হতে বাধ্য, এই কিশোর ছেলেটি অন্য জাতের ব্যাটসম্যান।'

পরদিন মাঠে যাওয়ার পরই তোমার দলেরই এক ব্যাটসম্যান আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, 'আশরাফুল তো অন্য জাতের ব্যাটসম্যান। ওর পেছনে একটা লেজ আছে।' দলে ঢোকার জন্য লড়াই থাকতেই পারে, তারপরও ঈর্ষাকাতর কথাটা এমন কুরুচিপূর্ণ লেগেছিল যে তোমাকে আর তা বলিনি।

কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম। বলছিলাম, আমার সব সময়ই মনে হতো, তুমি কত ভালো ব্যাটসম্যান, তুমি নিজেই তা জানতে না। গায়ানায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর আগের না পরের ঘটনা, মনে নেই। বাংলাদেশের আরও দু-তিনজন ক্রিকেটারের সঙ্গে তুমিও টিম হোটেলের লবিতে বসে। টিভিতে ইংল্যান্ডের খেলা চলছে। কেভিন পিটারসেনের একটা শট দেখে বলে উঠলে, ‘ওফ্, কী ব্যাটসম্যান!' আমি বললাম, 'ব্যাটসম্যান হিসেবে তুমি পিটারসেনের চেয়ে একটুও খারাপ নও।' আমি আমার মনের বিশ্বাস থেকেই কথাটা বলেছিলাম। তোমার মুখ দেখে মনে হয়নি, তুমি সেটি বিশ্বাস করো। ২০১১ বিশ্বকাপের আগে তোমাকে এক মনোবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলাম তো তোমার মনে এই বিশ্বাসটা জাগাতেই।কেভিন পিটারসেনের একটা শট দেখে বলে উঠলে, ‘ওফ্, কী ব্যাটসম্যান!` আমি বললাম, `ব্যাটসম্যান হিসেবে তুমি পিটারসেনের চেয়ে একটুও খারাপ নও।`

তোমাকে নিয়ে এত যে লিখেছি, সেটিও ওই বিশ্বাস থেকেই। তোমার কোনো কীর্তির পর লেখাটা তো বাধ্যতামূলকই ছিল। এর বাইরেও কত রকম লেখা! পত্রিকার হেডলাইন তোমার আগ্রহের বিষয় ছিল বলেই তার কয়েকটি তুলে দিতে ইচ্ছা করছে—

আশরাফুল, দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটি কবে?

আশরাফুল, এবার যে জেগে উঠতে হয়!

আশরাফুল ও প্রত্যাশার চাপ

আশরাফুলকে নিয়ে আবারও প্রশ্ন

কী হয়েছে আশরাফুলের?

আশরাফুলকে শান্তিতে খেলতে দিন!

আশরাফুল, অস্ট্রেলিয়া সিরিজ যে শেষ হতে চলল!

কার্ডিফের মহানায়কই আজ নেই!

আশরাফুলকে নিয়ে আরও কয়েক ছত্র

আশরাফুলকে দলে ফিরিয়ে নিতে প্রথম আলোতে প্রকাশিত নির্বাচকদের কাছে সেই খোলা চিঠি। কাজও হয়েছিল এতেচাইলে এমন আরও কত লেখা যায়! সব না হলেও এর বেশির ভাগই হয়তো তোমার মনে ছিল। তুমি দল থেকে বাদ পড়ার পর তোমাকে ফিরিয়ে আনার দাবি তুলে নির্বাচকদের কাছে খোলা চিঠি লিখেছি। জাতীয় লিগে ২৬৩ রান করে সেই দাবিকে যৌক্তিক বানানোর কৃতিত্ব অবশ্যই তোমার। আমার ওই চিঠি কোনো ভূমিকা রেখেছিল কি না, জানি না। তবে তুমি দলে ফিরেছিলে। এরপর কিছুদিন অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকল। ঘরোয়া ক্রিকেটে কেউ ভালো কিছু করলেই আমাকে ফোন করে তা জানাত। সঙ্গে সরাসরি বা প্রচ্ছন্ন অনুরোধ, তাঁর দাবিটা নির্বাচকদের কাছে তুলে ধরার। যেন তোমার অনুরোধেই আমি ওই ‘খোলা চিঠি'টা লিখেছিলাম! অথচ ঘটনা তো এই, তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী জানার পরও কোনো দিন তুমি তোমাকে নিয়ে কিছু লিখতে বলোনি। তোমাকে নিয়ে লেখার কোনো তীব্র প্রতিক্রিয়াও জানাওনি কখনো। এমন তো নয় যে তোমাকে নিয়ে শুধু ভালো ভালো কথাই লিখেছি। তোমার যে খেলার ধরন, আউট হওয়ার যেসব বিচিত্র সব উপায় উদ্ভাবন করতে, সেটি অনেক সময়ই বাধ্য করেছে কড়া সমালোচনা করতে। তোমার মাথায় কী হয়, এটি লেখা তো নির্দোষ কৌতূহলের প্রকাশ। তোমার মাথায় কী আছে, এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথাও তো অনেকবারই লিখেছি। তুমি অবশ্যই পড়েছ। কখনোই কিছু বলোনি। তোমাকে নিয়ে সবচেয়ে কড়া লেখাটার জবাব অবশ্য ব্যাট দিয়েই দিয়েছিলে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেকে সেঞ্চুরির ওই টেস্টটি ছিল পরে বিলুপ্ত এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ। এর আগে বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচটি খেলেছে মুলতানে। তৃতীয় দিনেই টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি টিম হোটেলে গিয়েছি দানিশ কানেরিয়ার ইন্টারভিউ করতে। গিয়ে দেখি, তুমি লবিতে অটোগ্রাফ খাতা নিয়ে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের পেছনে ছোটাছুটি করছ। যা একদমই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারসুলভ নয়। এই মন্তব্যের সঙ্গে লিখেছিলাম, ইমরান খান বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হলে এই দৃশ্য দেখার পর মোহাম্মদ আশরাফুলকে সোজা দেশের প্লেনে তুলে দিতেন। কলম্বোতে সেঞ্চুরির পর ভাবছিলাম, ভাগ্যিস, বাংলাদেশ দলে কেউ আমার মতো করে ভাবেনি!

(লেখকের 'এগারো' বই থেকে)

চলবে...

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×