এখনকার লেগ স্পিনারদের `ম্যাজিশিয়ান` আবদুল কাদিরের চ্যালেঞ্জ

উৎপল শুভ্র

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

এখনকার লেগ স্পিনারদের `ম্যাজিশিয়ান` আবদুল কাদিরের চ্যালেঞ্জ

আবদুল কাদির (১৯৫৫-২০১৯)

পরে শেন ওয়ার্ন লেগ স্পিন বোলিংকে অন্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছেন, তবে মাঝখানে বিলুপ্তপ্রায় এই বোলিং আর্টের পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল আবদুল কাদিরের হাতেই। লেগ ব্রেক, গুগলি, ফ্লিপার...লেগ স্পিন বোলিংয়ের এই তিনটি অস্ত্রই এমন দারুণভাবে প্রয়োগ করতে পারতেন যে, কাদিরের বোলিং দেখাটা ছিল আনন্দময় এক অভিজ্ঞতা। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সময় আবদুল কাদিরের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে আড্ডার গল্প।

ভূমিকা
আবদুল কাদিরের মৃত্যুসংবাদটা একেবারে বুকে এসে ধাক্কা দিয়েছিল। খবরটা যে পেয়েছিলাম একেবারেই আকস্মিকভাবে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের টেস্ট দেখতে আমি তখন চট্টগ্রামে। লেখালেখি থেকে সাময়িক ছুটি, সেই টেস্টে শুধুই খেলা দেখতে যাওয়া। রাতে হোটেলের বিছানায় শুয়ে জীবনানন্দের কবিতা পড়ছি। টেলিভিশনে অ্যাশেজ চলছে। কবিতা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সেদিকে চোখ।

হঠাৎই উৎকর্ণ ডেভিড গাওয়ারের কথায়। ‘আই হ্যাভ আ স্যাড নিউজ টু শেয়ার’ বলে আমার কৈশোরের দুই ব্যাটিং হিরোর একজন (অন্যজন কে? অবশ্যই ভিভ রিচার্ডস) কাদিরের মৃত্যুসংবাদটা দিলেন। কমেন্ট্রিতে তাঁর সঙ্গে তখন শেন ওয়ার্ন। নিয়তি-নির্ধারিতই হয়তো। মৃতপ্রায় লেগ স্পিনকে পুনর্জন্ম দেওয়া কাদিরের জ্বালিয়ে দেওয়া মশালটাকে ওয়ার্নই তো নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার হিসাবে ওয়ার্নের প্রশ্নাতীত অধিষ্ঠান। কিন্তু কমপ্লিট লেগ স্পিনার বললে কাদির হয়তো একটু এগিয়েই থাকেন। ওয়ার্নের তো কাদিরের মতো গুগলি ছিল না।

কাদিরের হাতে পুনর্জন্ম পাওয়া লেগ স্পিন বোলিংকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন ওয়ার্ন

ওয়ার্ন লাহোরের বাড়িতে কাদিরের সঙ্গে কাটানো সময়টার স্মৃতিচারণা করলেন। যা শুনে আমারও মনে পড়ে গেল ২৩ বছর আগের এক সকাল। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সময় কাদিরের ওই বাড়িতে আমারও ঘণ্টা দুয়েক স্মরণীয় সময় কেটেছে। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেটে ঢাকা বিশাল ড্রয়িংরুম। আমি কার্পেটেই বসেছিলাম। ওয়ার্নের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎপর্বের বর্ণনার শুরুতেই কাদির বলেছিলেন, ‘আপনি যেখানে বসেছেন, ওয়ার্ন ঠিক সেখানেই বসেছিল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বাধ্য ছাত্রের মতো আমার কথা শুনছিল।’

আবদুল কাদিরের বাড়িতে কাটানো সময়টা নিয়ে যে লেখাটা লিখেছিলাম, সেটি ছাপা হয়েছিল আমার সে সময়ের ঠিকানা ভোরের কাগজে। আর্কাইভ থেকে সেটি উদ্ধার করার পর সেটি পড়তে পড়তে মনে হলো, আবদুল কাদিরকে কিছুটা বোঝা যায় এই লেখা থেকেও। সেই লেখাটির শিরোনাম ছিল:

এখনকার লেগ স্পিনারদের 'ম্যাজিশিয়ান' আবদুল কাদিরের চ্যালেঞ্জ

ছাপার সময়কাল: ৯ মার্চ, ১৯৯৬।

ওয়ানডে ক্রিকেটে লেগ স্পিনাররা কার্যকরী হতে পারে, এটা প্রথম প্রমাণ করার জন্যই তাঁকে প্রতি সপ্তাহে ফুল পাঠানো উচিত এখনকার ওয়ার্ন, মুশতাক, কুম্বলেদের। আবদুল কাদির এখনো খেলছেন; হাবিব ব্যাংক ও পাঞ্জাবের পক্ষে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে সাফল্যটাও খারাপ নয়। ‘এখনো তো জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারেন’---এ ধরনের কথা শোনার বিরক্তি থেকেই স্টেডিয়ামে গিয়ে বিশ্বকাপের খেলা দেখছেন না বলে জানালেন। তবে টেলিভিশনে বিশ্বকাপ দেখছেন এবং এক্সপার্ট কলামও লিখছেন একটি উর্দু দৈনিকে। সেদিনের পত্রিকা থেকে কিছুটা পড়েও শোনালেন তাঁর অফিস রুমে বসে। আবদুল কাদিরের সঙ্গে প্রায় ঘন্টা দুইয়ের এই জমজমাট আড্ডা তাঁর বাড়িতে। লাহোরে কাদিরের খেলাধুলার সরঞ্জামের দোকান, ‘ইমরান-কাদির স্পোর্টস।’ নামটা সার্থক। ইমরান খানের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের স্বীকৃতিও হতে পারে, আবার হতে পারে তাঁর ছেলের নামে। হ্যাঁ, ইমরানের নামে তাঁর এক ছেলের নাম রেখেছেন তিনি ইমরান কাদির।

ইমরান খানের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই কাদিরের

প্রথাগত একটা ইন্টারভিউ নিতেই যাওয়া হয়েছিল কাদিরের কাছে। কিন্তু সর্বকালের অন্যতম সেরা এই লেগ স্পিনার কথা বলতে খুব ভালোবাসেন। আর আবদুল কাদির কথা বললে তো শোনার ধৈর্য হারানোর কোনো কারণ নেই। এই একবার বর্তমান পাকিস্তান দল সম্পর্কে বলেছেন, প্রশংসা করেছেন শচীন টেন্ডুলকার, গ্রায়েম হিকের। ওয়ার্ন বোলার হিসেবে যেমন, মানুষ হিসেবে তার চেয়েও ভালো, সে কথা জানাচ্ছেন প্রশংসার উজ্জ্বল চোখে। ওয়ার্নের মতো লেগ-ব্রেক করতে আর কাউকে দেখেননি তিনি, দেখবেন বলেও মনে করেন না, তারপরও এখনো সে পরিপূর্ণ লেগ স্পিনার নয় বলে মন্তব্য কাদিরের, ‘ওয়ার্নের লেগ-ব্রেক দারুণ, ফ্লিপারও ভালো, কিন্তু ওর গুগলির ওপর তেমন ভালো দখল নেই।‘

মুশতাক ও কুম্বলের সীমাবদ্ধতাও বললেন, ‘মুশতাকের গুগলি ভালো, তবে ভালো ফ্লিপার নেই।’ কুম্বলেকে লেগ স্পিনার হিসেবে মানতেই একটু আপত্তি, ‘ওর প্রায় সব বলই ফ্লিপার। মাঝে মধ্যে শুধু একটু ফ্লাইট দেয়। মিডিয়াম পেসারের মতো বল বাতাসে ঠেলে দেয় বেশির ভাগ সময়।’

কুম্বলের চেয়ে নরেন্দ্র হিরওয়ানিকে অনেক বেশি পছন্দ তাঁর, ‘হিরওয়ানি একজন জেনুইন লেগ স্পিনার। ওকে সবসময় ভারতীয় দলে রাখা উচিত। কিছু ম্যাচে হয়তো রান দেবে, আবার অনেক ম্যাচ জেতাবেও।’

ওয়ার্নের কথা তো একটু অন্যভাবে বলতে হবেই, তবে এবারের বিশ্বকাপে (১৯৯৬) কাদির সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছেন জিম্বাবুয়ের পল স্ট্র‍্যাংকে দেখে। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগেই কাদির তাঁর কলামে লিখেছিলেন, বিশ্বকাপে সেরা পাঁচ বোলারের মধ্যে থাকবেন স্ট্র‍্যাং। প্রথম পাঁচ ম্যাচে সর্বোচ্চ ১২ উইকেট পেয়ে কাদিরের প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছেন বর্তমান লেগ স্পিনারদের অবাক করা মিছিলে সর্বশেষ সংযোজন। ‘স্ট্র‍্যাং খুব ভালো বোলার। তাঁর এখন যা প্রয়োজন, তা হলো একজন ভালো কোচ’- কাদিরের এই মন্তব্য শুনলে পল স্ট্র‍্যাংয়ের আত্মবিশ্বাস এক লাফে আকাশে চড়ে যেত।

আবদুল কাদিরের আরেকটি শিকার

তবে সবকিছুর পর ছোট্ট একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন কাদির। সেই ছোট বেলায় তরিতরকারি বিক্রি করে জীবন কেটেছে, নিদারুণ অর্থকষ্টে কেটেছে শৈশব। সেখান থেকে অর্থ, খ্যাতি, যশ, সম্মানের চূড়ায় ওঠার পথে এক একটি পাহাড় টপকাতে হয়েছে তাঁকে।

১৯৭৮-৭৯-তে পাকিস্তান সফরে বেদি-চন্দ্রশেখর-ভেংকটরাঘবন মার খেয়ে ভূত হয়ে ফিরে যাবার পর স্পিন বোলিংয়ের দিন শেষ হয়ে গেছে বলে ধরে নিয়েছিলেন সবাই। শুরু হয়েছিল পেসের যুগ। তার মধ্যে আবার লেগ স্পিনকে স্বমর্যাদায় ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। প্রমাণ করেছেন ফাস্ট বোলিংয়ের মতো লেগ স্পিন দিয়েও ম্যাচ জেতা যায়...এটা বলার সময় খানিকটা গর্ব কাদিরের কন্ঠে টের পাওয়া যায় স্পষ্ট। একইভাবে এই চ্যালেঞ্জটি ছোড়ার সময়ও।

‘আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি লেগ-ব্রেক, গুগলি ও ফ্লিপার...লেগ স্পিনের এই তিনটি অস্ত্র আমার মতো সমান দক্ষতায় ব্যবহার করতে পারে না এখনকার কোনো লেগ স্পিনার’। কাদেরের কথাটা মিথ্যা নয়। অবিশ্বাস্য ছিল তাঁর ভ্যারিয়েশন। একই স্পেলে সমান দক্ষতায় ভিন্ন রকম তিনটি বল করে গেছেন। সব দেশের, সব ধরনের উইকেটে সাফল্য আছে। ওয়ানডেতে শেষ দিকের ওভারগুলো করার যে দায়িত্বটা এখন নিয়মিত পালন করেন ওয়ার্ন, স্পিনারদের মধ্যে সেটাও প্রথম শুরু করেছিলেন কাদিরই। ১৯৮৯ সালে নেহরু কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে তিনিই ইমরানের কাছ থেকে বল চেয়ে নিয়েছিলেন বলে জানালেন। শেষ ওভারে শ্রীলঙ্কার প্রয়োজন ছিল ৬ রান, হাতে ৪ উইকেট। সে অবস্থায় ‘ম্যাচ জেতাব’ ইমরানকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বোলিং করেছিলেন কাদির। বলাই বাহুল্য, প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন তিনি। ‘আল্লাহর পর ইমরানের কাছেই আমি সবচেয়ে কৃতজ্ঞ'...এক ফাঁকে জানিয়ে দেন তা-ও।

১৯৯৪ সালে পাকিস্তান সফরে কাদিরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন ওয়ার্ন। কার্পেটে বল ঘুরিয়ে কাদির যে তাঁকে অবাক করে দিয়েছিলেন, পরে ওয়ার্ন নিজেই তা জানিয়েছেন। ওয়ার্নের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন কাদির, “আপনি ভাবতে পারেন, আমি ওর জন্য প্রার্থনা করি। মানুষ হিসেবে ওর তুলনা হয় না। ও আমার সামনে এসে যেভাবে বসল, সেভাবে স্কুলের ছাত্ররাও তাদের স্যারদের সামনে বসে না। ও আমাকে বলছে, আমি ভিডিওতে আপনাকে দেখেছি, আমি এখনো আপনার গুগলি ‘রিড’ করতে পারি না’।“

ওয়ার্নের সঙ্গে প্রায় ঘন্টা দুয়েক কথা বলেছেন কাদির, একটা ভিডিও উপহার দিয়েছেন আর মুখে তো বলেছেনই কী করতে হবে। ওয়ার্নকে খুব ভালোমতো চিনেছেন বলেই সেলিম মালিকের বিরুদ্ধে ঘুষ সাধার অভিযোগটা উড়িয়ে দিতে চান না কাদির। ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তবে ওয়ার্নকে আমি যতোটা চিনেছি, তাতে বলতে পারি হয়তো এমন কিছু সত্যি ঘটেছে। মিথ্যে অভিযোগ করে ওর কী লাভ?’

অনেক স্বীকৃতির একটি

পায়ের টেন্ডন ছিড়ে যাওয়ার প্রথম ছেদ পড়েছিল আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে। মাঝখানে শারজায় এক ওয়ানডে টুর্নামেন্টে দলে ফিরেছিলেন। এরপর আবার পড়েন ইনজুরিতে। তবে এর মধ্যে ঘরোয়া ক্রিকেটে তার পারফরম্যান্স আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে আসার দ্বার খুলে দিয়েছিল প্রায়। গত বছর (১৯৯৫) শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হোম সিরিজের আগে ক্যাম্পে ডাকা হয়েছিল কাদিরকে। কিন্তু ডাকার ধরন অপমানজনক মনে হওয়াতে তাতে সাড়া দেননি। এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। আক্ষেপ নেই জীবন নিয়েও।

‘অনেক পেয়েছি। আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আমি পরিতৃপ্ত’--বলতে বলতে চোখ বুজে আসে কাদিরের। সত্যিই খুব পরিতৃপ্ত দেখায় আবদুল ‘ম্যাজিশিয়ান’ কাদিরকে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×