কেন পত্রিকায় লিখে দিয়েছিলাম, তুমি তো জানোই

উৎপল শুভ্র

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

কেন পত্রিকায় লিখে দিয়েছিলাম, তুমি তো জানোই

দু-তিন দিন পর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, তোমার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে এটা লিখতেই হবে। শুধু বিপিএলের ব্যাপার হলে হয়তো লিখতাম না। কিন্তু বাংলাদেশ দলে বাসা বাঁধা এই ঘুণপোকার কথা সবাইকে না জানানোটা অন্যায় হবে।

তোমার বনশ্রীর বাসায় সেই রাতের কথা ভাবলে এখনো যেটি ভেবে অবাক লাগে, কী স্বাভাবিকভাবেই না তুমি এসব বলে গেছ। ভেঙে পড়া দূরে থাক, গলাটা একবার কাঁপেনি পর্যন্ত। ঘটনাটা লিখব কি লিখব না, এ নিয়ে তোমার সঙ্গে পরদিনই কথা হয়েছে। তুমি 'না লেখা’র পক্ষে। ‘ঘটনা তো প্রকাশ পেয়েই গেছে’ বলায় উত্তর দিয়েছ, বিপিএলে ফিক্সিংয়ের কথা বলার সময় বাংলাদেশের অন্য লোকও ছিল বলেই তা ফাঁস হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ফিক্সিং নিয়ে কিছু ছাপা হলে আকসু বুঝে ফেলবে, তুমিই সব বলে দিয়েছ। দু-তিন দিন পর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, তোমার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে এটা লিখতেই হবে। শুধু বিপিএলের ব্যাপার হলে হয়তো লিখতাম না। কিন্তু বাংলাদেশ দলে বাসা বাঁধা এই ঘুণপোকার কথা সবাইকে না জানানোটা অন্যায় হবে।

তুমি যা বলেছ, তা ঠিক কি না, এটি নিশ্চিত হতে অনেক খাটতে হয়েছে। তোমার স্বীকারোক্তির সঙ্গে ম্যাচের ঘটনাপ্রবাহ মেলানোটা ছিল যেটির সহজতম অংশ। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা ছিল, তুমি আকসুর কাছে এই জবানবন্দিটাই দিয়েছ কি না। বিভিন্ন সূত্রে শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পর তোমাকে জানালাম, 'উপায় নেই, লিখতেই হচ্ছে।' তুমি আবারও না-লেখার অনুরোধ করার পর একটা কথাই বারবার বললে, 'চাচার (খালেদ মাহমুদ) সঙ্গে দেখা হলে আমি কী বলব?'

পরদিনের প্রথম আলোেত সব ছাপা হচ্ছে জানিয়ে তোমাকে এসএমএস করার পর তোমার ফিরতি এসএমএস পেলাম, 'আপনি যা ভালো মনে করেন, করেন; আমার আর কিছু বলার নেই।'

পরদিন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে সব স্বীকার করে তুমি কেঁদে ফেলেছ। সত্যি বলছি অ্যাশ, আমিও কম কাঁদিনি। কী কষ্টটাই না পেয়েছিলাম! জীবনে কোনো লেখা লিখতে এত কষ্ট হয়নি। কাজ-টাজ শেষ হতে হতে মানসিকভাবে একেবারে বিধ্বস্ত। যে ধকল সামলাতে আমার অনেক দিন লেগেছে। তোমাকে কী চোখে দেখতাম, সেটি তো আর তোমাকে অন্তত নতুন করে বলার কিছু নেই। তোমার জবানবন্দিতে বাংলাদেশের অন্য যে তিন ক্রিকেটারের নাম এসেছে, তাঁদেরকেও তো পছন্দই করি ।

ক্রিকেটারদের সঙ্গে সাংবাদিকদের কত রকম ঝামেলা হয়। ওই তিনজনের সঙ্গে কোনো দিনই যা হয়নি। কত বছর ধরে মালিন্যহীন সহজ, সুন্দর একটা সম্পর্ক। আর তাঁদের নিয়েই এসব লিখতে হচ্ছে। সবচেয়ে কঠিন ছিল, সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে চলার দায় থেকে ওই তিনজনকে অভিযোগটা জানিয়ে তাঁদের বক্তব্য নেওয়া।

এরপর তোমার সঙ্গে দু-একবার দেখা হয়েছে। ওই নিউজ ছাপা হওয়ার কদিন পরই সোনারগাঁও হোটেলে একটা অনুষ্ঠানে তো ঘটনাচক্রে দুজন পাশাপাশিও বসলাম। সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে এল টিভি ক্যামেরা। কী যে অবাস্তব লাগছিল, আমাদের পাশাপাশি বসে থাকাটাও এখন বড় খবর! এরপর একদিন অনেক রাতে তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম। খুব মজার একটা কথা বলেছিলে তুমি সেদিন। থাক, সেটি না-ই বলি। ‘খোলা চিঠি' এত খোলামেলা হওয়ার জায়গা নয়।

কিছু প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমি এখনো খুঁজে বেড়াই, অ্যাশ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তোমার যে ফিক্সিং সংশ্লিষ্টতার কথা বলেছ, তিনটিই স্পট ফিক্সিং। তোমার পারফরম্যান্স নিয়ে কি কোনো বেটিং হয়নি কখনো। সেই বেটিংকে নিজেদের পক্ষে আনতে বুকিরা কোনো প্রস্তাব দেয়নি তোমাকে? অধিনায়ক হওয়ার পর বুকিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেছ বলেই দাবি করেছিলে। অথচ অধিনায়কই তো সব সময় বুকিদের প্রিয় টার্গেট। যাকে হাতে রাখতে পারলে অনেক কিছু করাই সহজ হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ফিক্সিংয়ের জগতে কি পিক অ্যান্ড চুজের কোনো সুযোগ থাকে? ওই অন্ধকার জগতে একবার ঢুকলে কি আর বেরোনো যায়?

শাস্তি ভোগ করে আবার তুমি ক্রিকেটে ফিরেছ। স্বপ্ন দেখছ বাংলাদেশ দলে ফেরারও। তোমার দিক থেকে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই প্রশ্নগুলো কি বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের মনেও নেই? যারা তোমার টিমমেট ছিলেন, তাঁদের মন থেকে প্রতারিত হওয়ার বোধ কি এত সহজেই মুছে যাওয়ার মতো! আমি নিজেই যেখানে প্রতারিত বোধ করি। কখনো কখনো হাস্যস্পদও লাগে নিজেকে। কে জানে, হয়তো কোনো ইনিংসে তোমার আউট হওয়া নিয়ে দুঃখ করে কিছু লিখেছি, খুঁজে বেরিয়েছি কারণ। যা পড়ে তুমি হয়তো মনে মনে হেসেছ!

আবারও বাংলাদেশ দলে ফেরার স্বপ্ন তুমি দেখতেই পারো। তবে আমি কী মনে করি, জানো? জীবনে সবারই একটা দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়া উচিত, এই দাবি যেমন যৌক্তিক; আবার জীবনে এমন কিছুও থাকে, যেটি একবার হারিয়ে ফেলার পর হাজার চাইলেও আর ফিরে পাওয়া যায় না।

তুমি ভালো থেকো। দুঃখ যেমন দিয়েছ, আনন্দও তো কম দাওনি। আমি না হয় সেসবই মনে রাখার চেষ্টা করব।

ইতি,

শুভ্র ভাই।

(লেখকের 'এগারো' বই থেকে)

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×