বাংলাদেশে গ্রিনিজের প্রথম দিনে লিপুকে চমকে দিয়েছিলেন জালাল আহমেদ চৌধুরী
উৎপলশুভ্রডটকম
২২ সেপ্টেম্বর ২০২১
ক্রিকেটার, ক্রিকেট কোচ, ক্রীড়া লেখক, সাংবাদিক...অনেক পরিচয় তাঁর। সব কিছু মিলিয়ে `ক্রিকেট দার্শনিক` কথাটাই মনে হয় তাঁর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যায়। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে নানা ভূমিকায় জড়িয়ে থাকা জালাল আহমেদ চৌধুরীর চলে যাওয়ার দিনে উৎপলশুভ্রডটকমের শুভ্র.আলাপে এসে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করলেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, গোলাম নওশের প্রিন্স ও নাজমূল আবেদীন ফাহিম। তারই নির্বাচিত অংশ এখানে।
শারদ প্রভাতটা বিষাদের চাদরে মুড়ে গিয়েছিল একটি সংবাদে, 'জালাল আহমেদ চৌধুরী আর নেই'। ক্রিকেট কোচ, খেলোয়াড়, ক্রীড়ালেখক থেকে শুরু করে সদ্য সদ্য ক্রিকেট বুঝতে শিখেছেন যে মানুষটা, খবরটা শোকবার্তা বয়ে এনেছিল সব মহলেই। জালাল আহমেদ চৌধুরী তো সর্বজন শ্রদ্ধেয়।
উৎপল শুভ্রের আমন্ত্রণে জালাল আহমেদ চৌধুরীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেই বুধবার রাতে শুভ্র.আলাপে অতিথি হয়ে এসেছিলেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, নাজমূল আবেদীন ফাহিম আর গোলাম নওশের প্রিন্স। জালাল আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁদের চারজনেরই সম্পর্ক দীর্ঘকালের। তাই, অনুষ্ঠানের কোনো এক পর্যায়ে তাঁদের গলাটা যে ভারী হয়ে আসবে, তা অনুমিতই ছিল। তবুও নিজেদের যথাসম্ভব সামলে রেখে তাঁরা দর্শকদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন জালাল আহমেদ চৌধুরী নামের মহীরূহ দর্শনের অভিজ্ঞতার খানিকটা।
শুরুটা করে দিয়েছিলেন উৎপল শুভ্রই। এর আগে জালাল আহমেদ চৌধুরীর বহুমাত্রিক পরিচয়কে এক শব্দে বর্ণনা করতে আশ্রয় খুঁজেছিলেন 'দার্শনিক' শব্দে। আর দুজনের সম্পর্কটা যে লেখক-পাঠকের সীমানা ছাড়িয়ে বহু আগেই ভ্রাতৃতুল্য সম্পর্কে উন্নীত, জানিয়েছিলেন সেটাও। গতকাল আরও একবার স্মরণ করলেন তাঁর সাংবাদিকতা জীবনে জালাল আহমেদ চৌধুরীর অবদান,'১৯৯৫ সালে আমার প্রথম বই বেরোচ্ছে। ষোল জন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের সাক্ষাৎকার নিয়ে "ষোল তারকার মুখোমুখি"। হঠাৎ মাথায় এলো, ব্যাক কভারে বই এবং লেখক সম্পর্কে অন্য কারও লেখা থাকলে কেমন হয়! "ভালোই হয়" সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পর সেই লেখাটা কে লিখতে পারেন, সেই সিদ্ধান্ত নিতেও একদমই সময় লাগল না। কিন্তু বললেই কি তিনি রাজি হবেন? শুধু রাজিই হলেন না, সেই লেখা এমন সব প্রশংসাবাণীতে ভাসিয়ে দিলেন যে, আর কেউ না বুঝলেও আমি ঠিকই বুঝলাম, লেখার গুণের চেয়ে অনুজের প্রতি স্নেহের ভূমিকাই এখানে প্রধান।'
উৎপল শুভ্রের কাছে তিনি লেখক হলেও মাশরাফি বিন মুর্তজা তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন কোচ হিসেবে। ক্রিকেটারদের কাছে তাঁর মূল পরিচয় তো সেটাই। বাংলাদেশের ক্রিকেটের হাঁটি হাঁটি পা পা সময়ে যে জনাকয়েক কোচ ছিলেন জালাল আহমেদ চৌধুরী তাঁদেরই একজন। শুভ্র.আলাপে গাজী আশরাফ হোসেন লিপু জানালেন কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরীকে নিয়ে তাঁর অসংখ্য স্মৃতির একটি। তা ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফির জন্য বিকেএসপিতে বাংলাদেশ দলের প্রস্তুতির সময়কার। যে প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল জালাল আহমেদ চৌধুরীর হাতেই। সেই দলের ম্যানেজার লিপু গ্রিনিজের সঙ্গে দলের পরিচয়পর্বের দিনটিতে ফিরে গেলেন জালাল আহমেদ চৌধুরীকে বোঝাতে, 'গর্ডন গ্রিনিজ আসার পর আমাদের প্রথম দিনের অনুশীলন ছিল বুয়েটের মাঠে। তো সবার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য, আজকে গ্রিনিজ মাঠে আসবে। শুরুতে আমি একটা স্বাগত বক্তব্য দিয়ে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। তারপর জালাল ভাইকে কিছু বলতে বললাম। উনি (কথা) শুরুর পরই একটা জিনিস বলে আমাদের সবাইকে চমকে দিলেন।
'জিনিসটা হলো, তিনি যখন ১৯৭৯ সালে পাতিয়ালায় কোচ হতে যান, আমি তাঁকে একটা কাগজে আমার ব্যাটিংয়ের ২৩টা প্রবলেম লিখে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, "আপনি এই সমস্যাগুলোর সল্যুশন নিয়ে আসবেন।" গর্ডন গ্রিনিজের সামনে উনি সেই কাগজটা বের করে বললেন, "তোমাদের সামনে এমন একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন, যে তোমাদের মুহূর্তের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান পাবে। তোমাদের লিপুর মতো ১৭ বছর অপেক্ষা করতে হবে না। আমি অবাক হয়ে গেলাম, উনি ১৭ বছর ধরে আমার দেওয়া একটা কাগজ সযত্নে রেখে দিয়েছেন!'
নাজমূল আবেদীন ফাহিম জানালেন জালাল আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর প্রথম স্মৃতির গল্প, '১৯৭৭ সালে সেকেন্ড ডিভিশনের কিছু খেলোয়াড়কে নিয়ে একটা দল করা হয়েছিল, যেটার দায়িত্বে ছিলেন জালাল ভাই। এখন আমার ভাবতে খুব ভালো লাগে, জালাল ভাই আমাকে সেই দলের একজন উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। এখনো মনে পড়ে, হকি স্টেডিয়ামের পাশে যে মাঠটা, তার সিঁড়িতে জালাল ভাই বসে আছেন, আমাদের খেলা দেখছেন। আর প্রথম ম্যাচেই আমাদের ওই দলটা ফার্স্ট ডিভিশনের একটা টিমকে হারিয়ে দিয়েছিল। সেটা নিয়ে জালাল ভাইয়ের সে কী গর্ব!'
শুধু ফাহিমই নন, জালাল আহমেদ চৌধুরীর হাত ধরে উঠে এসে এরকম আরও কতজনই নাম করেছেন ঢাকার ক্রিকেটে। আর গোলাম নওশের প্রিন্সকে তো জালাল আহমেদ চৌধুরীর একরকম শিষ্যই বলা যায়। ক্রিকেটে তাঁর এগিয়ে চলার শুরুটা হয়েছিল জালাল আহমেদ চৌধুরীর হাতেই। যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন থেকে শুভ্র.আলাপে যোগ দিয়ে ধরা গলায় সেই গল্পটাই বললেন জাতীয় দলের সাবেক বাঁহাতি পেসার, 'তাঁকে আমি '৭৬ থেকে চিনি। আজিমপুরে গ্যারেজ ফিল্ডের পাশে যে পেগাসাস মাঠে খেলা হতো, সেখানে বোলিং-টোলিং করে আমরা দেখানোর চেষ্টা করতাম (নিজেদের), যদি একটু দলে সুযোগ-টুযোগ মেলে। আমার তখন ১৩ বছর বয়স, সেকেন্ড ডিভিশনও খেলি নাই। জালাল ভাই ওই সিজনেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "শোনো, তোমার বাবা-মা কি তোমাকে বাইরে যেতে দিবে? সিলেটে?" আমি বললাম, 'আপনি আমাদের বাসায় চলেন। বাবার সঙ্গে কথা বলেন 'রাতের বেলাই উনি আমাদের বাসায় গিয়ে বাবাকে বললেন, 'চাচা, আমি গিয়ে ওকে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ খেলাব।'
তখন পর্যন্ত ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না প্রিন্সের। তবে জালাল আহমেদই তাঁকে সিলেটে নিয়ে গিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নশিপে খেলাতে, সেখানে আখালিয়া মাঠে প্রথম ম্যাচ পড়েছিল নোয়াখালীর সঙ্গে। 'তখন পর্যন্ত আমি কোনো তিন দিনের ম্যাচ খেলি নাই, সেবারই প্রথম। তো বোলিং করে বাড়ি এসেছি; বাবা বললেন, "কাদের সাথে খেলেছ, জানো? রকিবুল হাসান, এ এস এম ফারুক, দৌলতুজ্জামান….। কত বড় বড় প্লেয়ারের সঙ্গে খেলে এসেছ।"
এরপর গোলাম নওশের প্রিন্স প্রথম বিভাগে খেলেছেন, পেগাসাসে সাত বছর কাটিয়ে মোহামেডানে গিয়েছেন। তবে জালাল আহমেদ চৌধুরী তাঁর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে ছিলেন সব সময়ই। প্রিন্সই জানালেন, ভোর পাঁচটায় বিছানা ছেড়ে উঠে প্র্যাকটিসে যাওয়ার যে রুটিন ধরিয়ে দিয়েছিলেন জালাল চৌধুরী, সে ধারা বজায় আছে এখনো।
প্রিন্সদের অনুশীলন করিয়ে জালাল আহমেদ চৌধুরীর কোনো প্রাপ্তিযোগ ঘটেনি কখনো। তখনো তিনি কোচ হননি, স্রেফ বড় ভাইয়ের দায়িত্ববোধ থেকেই অনুশীলন করিয়ে গেছেন। ওই দায়িত্ববোধ থেকেই পাতিয়ালা থেকে আসার সময় কেডস, মোজা, গ্লাভস কিংবা ক্রিকেটের বই নিয়ে আসতেন প্রিন্সদের জন্য।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ছিল তাঁর হৃদয়জুড়ে। কোচ হিসেবে কয়েকটি প্রজন্মের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি, তাঁর হাতে তৈরি হয়েছে কত বড় বড় ক্রিকেটার। কিন্তু তা নিয়ে বড়াই করা দূরে থাক, তাঁর মুখে কখনো তা শোনাও যায়নি। আর শিষ্যদের তো শুধু ক্রিকেটই শেখাননি, শিখিয়েছেন জীবনবোধ। তাঁর কাছে ক্রিকেট ছিল শুদ্ধতার প্রতীক, সেই বোধটাই যে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, এ কথা বারবার উঠে এলো শুভ্র.আলাপে চারজনের প্রায় সোয়া ঘণ্টার আলাপচারিতায়।
জালাল আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুতে শোকে কাতর হয়ে পড়ার কারণও তো সেটাই। কারও কাছে ভাই, কারও কাছে চাচা কিংবা কারও কাছে স্যার…জালাল আহমেদ চৌধুরী তো কম মানুষের অভিভাবক ছিলেন না!