স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০: ৩৮

আসিফ হোসেন খান: গৌরবের নাম, আক্ষেপের নামও

দুলাল মাহমুদ

১৪ অক্টোবর ২০২১

আসিফ হোসেন খান: গৌরবের নাম, আক্ষেপের নামও

বলতে গেলে কিশোর বয়সেই কমনওয়েলথ গেমসের সোনা জিতে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, অসাধারণ প্রতিভা নিয়েও খুব বেশি দূর যাওয়া হয়নি তাঁর। যা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অনন্ত এক আক্ষেপ হয়ে আছে। `স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০` ধারাবাহিকের এবারের পর্বে শ্যুটার আসিফ হোসেন খান।

আসিফ হোসেন খানতখন তাঁর বয়স সবে ১৫ বা ১৬। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তেমনভাবে পরিচিত ছিলেন না। তবে পাঁচ মাস আগে বাংলাদেশ গেমসে ১৭৭ এয়ার রাইফেলে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। সেই সুবাদে শুটিং অঙ্গনের কেউ কেউ তাঁকে সামান্য চিনতেন। সে সময় তিনি ছিলেন বিকেএসপির ছাত্র। যে কারণে উদীয়মান শুটার হিসেবে খানিকটা সম্ভাবনা তো ছিলই। বাড়তি যেটা ছিল, তা হচ্ছে পারিবারিক ঐতিহ্য। তাঁর বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই কম-বেশি শুটিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। অবশ্য এমন ব্যাকগ্রাউন্ড তো অনেকেরই হয়তো থাকে। তাই বলে এত কম বয়সে জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আলোড়ন সৃষ্টি করবেন! তাও কমনওয়েলথ গেমসের মতো বড় আসরে!

অথচ তিনি পদক জিতবেন, এমন কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। তাঁর নিজেরও এমনটা ভাবনায় ছিল না। তখন তো শুটিংয়ে তাঁর পরিপক্বতাও ছিল না। সেই বয়সে জাতীয় দলের হয়ে বিদেশে সফরে যাওয়াটাই তাঁর কাছে ছিল রোমাঞ্চকর। কিন্তু সব হিসাব-নিকাশ উল্টেপাল্টে দিয়ে তিনি চমক দেখিয়েছেন। এমনই চমক দেখিয়েছেন, তাঁর আগে এককভাবে আর কেউ যা দেখাতে পারেননি। ২০০২ সালের ৩১ জুলাই ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে ১৭তম কমনওয়েলথ গেমসে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল ব্যক্তিগত এককে স্বর্ণপদক জয় করে ইতিহাস গড়েন শুটার আসিফ হোসেন খান। 

যদিও কমনওয়েলথ গেমসে আসিফই প্রথম স্বর্ণপদক জয় করেননি। তাঁর আগে এই গেমসে সাফল্যের পথ চিনিয়েছেন দুই শুটার আতিকুর রহমান এবং আবদুস সাত্তার নিনি। ১৯৯০ সালে যৌথভাবে স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন তাঁরা দুজন। বলতে গেলে তখন পর্যন্ত এটাই ছিল বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। কিন্তু এককভাবে সাফল্যের দিক দিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে যান আসিফ।

পাবনার মতো একটা জেলা শহর থেকে এসে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আসিফ যেভাবে উঠে আসেন, তার পেছনে একটা কার্যকরণ আছে। তাঁর দাদা ও নানার পরিবারের সবাই শুটিংয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। পাবনার পুলিশ লাইন সংলগ্ন বাসা থেকে খুবই কাছে পাবনা রাইফেল ক্লাব শুটিং রেঞ্জ। এই ক্লাব আয়োজিত বিভিন্ন শুটিং প্রতিযোগিতায় নিয়মিতই অংশ নিতেন দুই পরিবারের সদস্যরা। আসিফ তাই শুটিংয়ের একটা আবহের মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছেন। 

পরিবারের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণাতেই শুটিং রেঞ্জে তাঁর দীক্ষা হয়। ছোটবেলায় খুব দুরন্ত প্রকৃতির আসিফকে শুটিংই কিছুটা সুস্থির হতে সহায়তা করে। শুটিং তাঁর কাছে এমন নেশার মতো হয়ে যায় যে, কখনো কখনো স্কুল পালিয়েও ছুটে যেতেন শুটিং করতে। ২০০০ সালে জাতীয় শুটিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য খালার সঙ্গে ঢাকায় আসেন। কোনো পদক না পেলেও প্রতিশ্রুতির ঝিলিক দেখান। তারপর বিকেএসপিতে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে নবম শ্রেণিতে শুটিংয়ে ভর্তি হন। এটা তাঁর জন্য হয়ে উঠে সোনায় সোহাগা। তিনি ছিলেন শুটিংয়ে প্রথম ব্যাচের ছাত্র। বিকেএসপিতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে নিজেকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মনোযোগী হন।

২০০২ সালে বাংলাদেশ গেমসে ১৭৭ এয়ার রাইফেলে ব্রোঞ্জ পদক পেলেও প্রতিভা ও মেধার বিবেচনায় জাতীয় দলের ক্যাম্পে সুযোগ পান আসিফ। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি কমনওয়েলথ গেমসের চূড়ান্ত দলে স্থান করে নেন। তারপর তো অভূতপূর্ব সেই সাফল্য। যেটির কথা তিনি নিজেও ভাবতে পারেননি। তাঁর চেয়ে অভিজ্ঞ ও খ্যাতিমানদের হারিয়ে দিয়ে লেখেন নতুন ইতিহাস। শেষ শটে ভারতের অভিনব বিন্দ্রাকে টপকে স্বর্ণপদক জয় করেন। সেটিও নতুন রেকর্ড গড়ে। 

এই কৃতিত্বের পর বয়স, সম্ভাবনা ও প্রতিভার দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁকে ঘিরে আশার আলো জ্বলে ওঠে। তাঁকে ঘিরে আরও বড় সাফল্যের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। মাস দুয়েক পর দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে এশিয়ান গেমসে অংশ নিলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। তবে ২০০৪ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ এস এ গেমসে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল ৬০ শটসে জয় করেন স্বর্ণপদক। এছাড়াও মো. শোয়েবুজ্জামান ও আনোয়ারুজ্জামানকে নিয়ে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল ৬০ শটস টিম ইভেন্টে রৌপ্য এবং মো. সেলিম ও তৌফিকুর রহমানকে নিয়ে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। 

২০০৪ সালে এথেন্স অলিম্পিক গেমসে অংশ নেওয়াটা আসিফের জন্য বড় একটা স্বপ্ন পূরণের মতো ছিল। কিন্তু সেখানে গিয়েই বুঝতে পারেন, বিশ্ব মঞ্চে সাফল্য পেতে আরও কত বেশি পরিশ্রম, কত সাধনা, কত সুযোগ সুবিধার প্রয়োজন। সাফল্য কিন্তু টুকটাক আসছিল। ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন কমনওয়েলথ গেমসেই যেমন অঞ্জন কুমার সিংহকে নিয়ে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল পেয়ার্সে রৌপ্যপদক জয় করেন। একই বছর শ্রীলঙ্কার কলম্বো এস এ গেমসে ইমাম হোসেন ও অঞ্জন কুমারকে নিয়ে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল টিম ইভেন্টে লাভ করেন রৌপ্যপদক।

২০০৬ সালের ২ অক্টোবর দিনটি আসিফের ক্যারিয়ার এবং সম্ভবত জীবনও বদলে দেয়। দেশসেরা শুটার হয়েও সেদিন তিনি যে পরিস্থিতির শিকার হন, তা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্যও গ্লানিকর। শুটিং ফেডারেশনে পুলিশের গাড়ি রাখাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট গণ্ডগোলে পুলিশ তাঁকেসহ কয়েকজনকে বেধড়ক পিটুনি দেয়। এমনকি দেশের গৌরব এই শুটারকে মামলার আসামি করে আদালতে চালান করে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় তাঁকে দীর্ঘ দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকতে হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে তিনি যে আঘাত পান, তাতেই তাঁর শুটিং ক্যারিয়ারের অবসান ঘটার উপক্রম হয়। 

তারপরও সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলে নিজেকে তিনি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যান। তাতে কিছুটা হলেও সফল হন। ২০১০ সালে ঢাকায় এস এ গেমসে আবদুল্লাহ হেল বাকী ও শোভন চৌধুরীকে নিয়ে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল টিম ইভেন্টে জয় করেন স্বর্ণপদক। এছাড়া ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের ব্যক্তিগত ইভেন্টে রৌপ্যপদক লাভ করেন। একই বছর ভারতের দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসে আবদুল্লাহ হেল বাকীকে নিয়ে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল পেয়ার্সে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন।

আসিফ হোসেন খানকে নিয়ে বড় ধরনের সাফল্য আশা করা হলেও তা পূরণ হয়নি। অথচ তিনি ভারতের অভিনব বিন্দ্রাকে হারিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে নিজের পদচ্ছাপ রাখেন। সেই বিন্দ্রা পরবর্তীকালে ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০০৬, ২০১০, ২০১৪ কমনওয়েলথ গেমস, ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক গেমসে স্বর্ণপদকসহ অসংখ্য পদক জয় করে বিশ্বের অন্যতম একজন সেরা শুটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। 

আর আসিফ অসাধারণ প্রতিভা নিয়েও খুব বেশি দূর যেতে পারেননি। যা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অনন্ত এক আক্ষেপ হয়ে আছে। অবশ্য সমর্থন, সহযোগিতা আর সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিন্দ্রার সঙ্গে তাঁর যে দুস্তর ব্যবধান, তাতে আক্ষেপ করার অবকাশ নেই। তারপরও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে তিনি এককভাবে যে সাফল্য অর্জন করেন, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে তেমনটা আর কারও নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁকে অনুসরণ করে অনেক শুটার সাফল্য অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই ধারায় কমনওয়েলথ গেমসে আবদুল্লাহ হেল বাকী দুইবার এবং শাকিল আহমেদ একবার রৌপ্যপদক জয় করেন। আরও অনেকেই হাঁটছেন সেই স্বপ্নের পথে। 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×