ট্রেভর চ্যাপেল এবং আন্ডারআর্ম কেলেঙ্কারি

উৎপল শুভ্র

২১ অক্টোবর ২০২১

ট্রেভর চ্যাপেল এবং আন্ডারআর্ম কেলেঙ্কারি

ট্রেভর চ্যাপেল ও সেই আন্ডারআর্ম বোলিং

ট্রেভর চ্যাপেল নামের সমার্থকই হয়ে গেছে ওই `আন্ডারআর্ম` কথাটা। ১৯৮১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মেলবোর্নের এক রাতে ওয়ার্ল্ড সিরিজের কাপের দ্বিতীয় ফাইনালে দুই চ্যাপেল ভাই মিলে যা করেছিলেন, তা হয়ে আছে ক্রিকেটের মহা এক কেলেঙ্কারি। অধিনায়ক ও বড় ভাই গ্রেগ চ্যাপেলের নির্দেশে ট্রেভর চ্যাপেল আন্ডারআর্ম, মানে গড়িয়ে বল করার পর শুরু সেই বিতর্কের রেশ আছে এখনো।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নতুন কোচ হিসেবে ট্রেভর চ্যাপেলের নাম ঘোষণা করা হলো যে সংবাদ সম্মেলনে, তাতে এক সাংবাদিক করেছিলেন প্রশ্নটা। এমন লোককে কেন কোচ করা হবে, যাঁর নাম আর ক্রিকেটের এক বিতর্কিত অধ্যায় সমার্থক হয়ে আছে? বিসিবি সভাপতি এই প্রশ্নের জবাবে যা করা উচিত, করেছেন তা-ই। হেসে এড়িয়ে গেছেন প্রশ্নটা। এছাড়া আর কিই-বা করতে পারতেন! প্রশ্নকর্তা ওই সাংবাদিকও জানেন, ১৯৮১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মেলবোর্নের এক রাতে যা করেছিলেন ট্রেভর চ্যাপেল, সে জন্য নিশ্চয়ই চ্যাপেলদের ছোটভাই এখনো অনুতাপে ভোগেন; তবে বাংলাদেশ দলের কোচ হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, এমন কোনো অপরাধ নয় তা।

ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপের দ্বিতীয় ফাইনালের শেষ বলে জয়ের জন্য নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন ৬ রান। স্ট্রাইকে আছেন যে কিউই ব্যাটসম্যান, সেই ব্রায়ান ম্যাকেঞ্জির ছক্কা-টক্কা মারার জন্য সুনাম ছিল না কখনোই...তারপরও অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেল বোলার ও নিজের ছোট ভাই ট্রেভর চ্যাপেলকে নির্দেশ দিলেন 'আন্ডারআর্ম’ অর্থাৎ গড়িয়ে বল করতে। আন্ডারআর্ম বল করা তখন ক্রিকেট-আইনে নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু ক্রিকেট খেলাটি চিরদিনই যে অলিখিত কিছু আইনের চর্চা করে এসেছে, সেই চেতনার বিপরীত তো বটেই। এ কারণেই তা নিয়ে এত হইচই। এতটাই যে, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের কূটনৈতিক সম্পর্কে পর্যন্ত ছায়া ফেলেছিল সেটি। নিউজিল্যান্ডের সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মুলডুন কোনোরকম কূটনৈতিক শিষ্টতার ধার না ধেরে সরাসরিই বলে ফেলেছিলেন, ‘এটা একটা কাপুরুষোচিত কাজ।’

ট্রেভর চ্যাপেলের সেই আন্ডারআর্ম কেলেঙ্কারি। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১, এমসিজি

দুই দেশেই তুলকালাম হয়েছে এ নিয়ে। মেলবোর্ন থেকে প্রকাশিত পত্রিকা 'দ্য এজ' ফুটিয়ে তুলেছিল অস্ট্রেলীয় জনগণের মনের কথাটা–'আজ অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের লজ্জার দিন, স্পোর্টিং জাতি হিসেবে দেশের সুনামও আজ নষ্ট হলো অনেকটাই।’ তবে ট্রেভর চ্যাপেলের যতটা 'অপরাধ', তার চেয়ে বেশি তো আসলে গ্রেগ চ্যাপেলের। অধিনায়ক কিছু বললে বোলারের তা না মেনে উপায় কী!

হ্যারল্ড লারউডের কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এই কথাটাই। ইংল্যান্ড অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বাহন হয়ে বডিলাইন সিরিজে খলনায়কে পরিণত লারউডকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, ট্রেভর চ্যাপেলের জায়গায় তিনি বোলার হলে এটা কি করতেন, লারউড উত্তর দিয়েছিলেন, 'আমার মনে হয়, আমাকেও তা করতে হতো। তবে আমি খুব অপমানিত বোধ করতাম।' 

ট্রেভর চ্যাপেলও তা করেছিলেন কি না, সেটি তাঁকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয়েছিল। ট্রেভর জানিয়েছিলেন, প্রথমে তিনি বুঝতেই পারেননি, গ্রেগ তাঁকে এমন কিছু করতে বলছেন। তবে বুঝতে পারার পরও প্রতিবাদ করেননি। অধিনায়ক করতে বলেছেন তো কী করা!

দুই চ্যাপেল ভাই মাঠে যখন এই কাণ্ড করছেন, চ্যানেল নাইনের কমেন্ট্রি বক্সে চ্যাপেলদের বড় ভাই ইয়ান চ্যাপেল রাগে-দুঃখে বলছেন, ‘আমাদের চ্যাপেল পরিবারের সুনাম আজ ধুলায় মিশে গেল।’

সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল আরও তীব্র। এর মধ্যে কিথ মিলারের প্রতিক্রিয়াটা শুধু তুলে দিই। কারণ তা আরও অনেকের অনুভূতি বুঝিয়ে দেবে। ক্যারিশম্যাটিক এই অলরাউন্ডার বলেছিলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল, অন্ধকার একটা গুহায় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছি। মনে হচ্ছিল, এই খেলাটি কোনোদিন না খেললেই ভালো করতাম।’

বড় প্রতিবেশী হলে যা হয়, অস্ট্রেলিয়ার দিকে সব সময়ই অন্যরকম একটা ঈর্যার চোখে তাকায় নিউজিল্যান্ড। জাতীয় পতাকায় যতই মিল থাক, দুই দেশের মধ্যে রেষারেষিও সেরকম। এই ঘটনার পর নিউজিল্যান্ডে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সেটি তাই অনুমান করাই যায়। 'অজি’দের নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করার এই সুযোগ কিউইরা ছাড়বে কেন? সেটি তাই ভালোই হয়েছিল।

ওয়েলিংটনের এক রেডিও অনুষ্ঠানে উপস্থাপক যেমন শ্রোতাদের জিজ্ঞেস করলেন, নতুন একটা ডিওডোরেন্টের নাম তারা অনেছেন কি না। শ্রোতাদের কাছ থেকে সঙ্গে সঙ্গে তো আর উত্তর পাওয়ার সুযোগ নেই। তাই উত্তরটাও বলে দেওয়া হলো—'এটির নাম চ্যাপেল এবং এটি দুর্গন্ধ ছড়ায়।’ অকল্যান্ডের মার্কেটে দেখা গেল নতুন কিছু টি-শার্ট। সেগুলোর গায়ে লেখা দুরকম বাণী। এর একটি—'অজিস হ্যাভ অ্যান আন্ডারআর্ম প্রব্লেম (বাংলা কী হবে— 'অস্ট্রেলীয়দের বগলে সমস্যা'?)। অন্যটি আরো সরাসরি ট্রেভর চ্যাপেলস্ আন্ডারআর্ম স্টিংকস' ('ট্রেভর চ্যাপেলের বগল থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়')। এসবই সিরিয়াস একটি বিষয় নিয়ে উচ্চমানের রসিকতা। তবে সিরিয়াস প্রতিক্রিয়াও ছিল। ওই ঘটনার পর ওয়েলিংটনে একটি বড় অস্ট্রেলীয় বীমা কোম্পানির ভবনে জাতীয় পতাকা উড়েছে অর্ধনমিত হয়ে!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×