দেবাচা মুলগা! অর্থ? ঈশ্বরের পুত্র!

উৎপল শুভ্র

১৬ নভেম্বর ২০২১

দেবাচা মুলগা! অর্থ? ঈশ্বরের পুত্র!

শচীন টেন্ডুলকার

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ও শেষবারের মতো ব্যাটিং করতে নেমেছেন দুই যুগ আগে-পরের একই তারিখে। মোট আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা ৬৬৪, স্কুল ক্রিকেটে বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে যে পার্টনারশিপ দিয়ে প্রথম লাইম লাইটে, সেটিও তো ৬৬৪-ই ছিল! অবাক করা এমন আরও অনেক ঘটনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শচীন টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারে।

১০০
৬৬৪
১৫ নভেম্বর

দুর্বোধ্য কোনো সংকেত মনে হচ্ছে? নাকি প্রশ্নটাকেই মনে হচ্ছে দুর্বোধ্য! শচীন টেন্ডুলকারকে লেখা, এটা  জানা থাকায় প্রথম দুটি সংখ্যার রহস্যভেদ এমন আর কঠিন কি! ২০০ মানে ২০০ টেস্ট। আর ১০০ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরির সংখ্যা।

৯৯.৯৪ বললেই যেমন চোখের সামনে ভেসে ওঠেন ডন ব্র্যাডম্যান, ভাবীকালে ওই ২০০ আর ১০০-ই হয়তো হয়ে যাবে শচীন টেন্ডুলকারের পরিচয় । ঠিক আছে, প্রথম দুটি বোঝা গেল । পরের দুটি? ভাবুন, ভাবুন!

ভাবতে ভাবতে যদি ২০০ টেস্টের সঙ্গে ৪৬৩টি ওয়ানডে আর একটি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি যোগ করে ফেলেন, তাহলেই হয়ে গেল। পেয়ে গেলেন ‘৬৬৪’ ধাঁধারও সমাধান। এটি শচীন টেন্ডুলকারের খেলা মোট আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা। কিন্তু সংখ্যাটা কি আর কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে না? শারদাশ্রম বিদ্যামন্দির...বিনোদ কাম্বলি...বিশ্ব রেকর্ড পার্টনারশিপ...। স্কুল ক্রিকেটে বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে রেকর্ড যে পার্টনারশিপে ক্রিকেট-বিশ্ব প্রথম জেনেছিল শচীন টেন্ডুলকারের নাম, সেটিও ৬৬৪-ই ছিল না!

৬৬৪ রানের জুটির তাঁরা দুজন, বিনোদ কাম্বলি ও শচীন টেন্ডুলকার। শচীনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যাও ৬৬৪!

কাকতালীয় তো বটেই । তার পরও কীভাবে এমন মিলে গেল ভেবে একটু বিস্ময় জাগেই।

১৫ নভেম্বর ‘একটু’ নয়, আরও বেশিই তা জাগাতে বাধ্য। ১৯৮৯ সালের ১৫ নভেম্বর শচীন টেন্ডুলকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ব্যাটিং করতে নেমেছিলেন। কী আশ্চর্য, ২৪ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শেষবারের মতো তাঁর ব্যাটিং দেখল সেই ১৫ নভেম্বরেই! এবার শুধু কাকতালীয় বললেই চলছে না। কেমন যেন ভুতুড়ে-ভুতুড়ে লাগছে। এ কীভাবে সম্ভব! পরিসংখ্যানের ছাত্রকে প্রবাবিলিটি হিসাব করতে দিলেই বুঝবেন, দুই যুগ আগে-পরে একই দিনে শুরু আর শেষ কেন প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে!

৬৬৪ না হয় মেলানোর জন্য মেলানো। ২০০ আর ১০০ সংখ্যা দুটিও দেখুন না! কল্পনার ঘোড়া ছোটানো ঔপন্যাসিকও কোনো ক্রিকেটারকে নায়ক করে বই লিখলে বেশি নাটকীয় হয়ে যায় ভেবে সংখ্যা দুটি হয়তো এদিক-ওদিক করে দেবেন। একই দিনে শুরু আর শেষের কথা তো মাথায়ই আনবেন না।

বিদায়বেলায় ‘গ্রেটেস্ট’ কি না—এই আলোচনায় সরগরম হয়েছে ক্রিকেট-বিশ্ব যাতে অংশ নিতে হয়েছে টেন্ডুলকারের শেষ সিরিজে আমন্ত্রিত ব্রায়ান লারাকেও। লারা উত্তরটা দিয়েছেন ঘুরিয়ে, ‘হি হ্যাজ স্ক্রিপ্টেড দ্য গ্রেটেস্ট এভার ক্যারিয়ার।' কিন্তু এমন একটা 'স্ক্রিপ্ট' লিখল কে?

এই ক্যারিয়ার শুধু ‘গ্রেটেস্ট’-ই তো নয়, আধিদৈবিকও বটে! ২০০তম টেস্টই শেষ—এই সিদ্ধান্ত না হয় শচীন টেন্ডুলকার নিজেই নিয়েছিলেন। কিন্তু সেঞ্চুরি ঠিক ১০০ আর একই দিনে টেস্টে প্রথম আর শেষবারের মতো ব্যাটিং তো আর তাঁর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল না। এই চিত্রনাট্য কি তাহলে ক্রিকেট-বিধাতারই লেখা?

সবচেয়ে বড় বিস্ময়টা এখনো ঝুলি থেকে বের করতে বাকি। মুম্বাইয়ে শেষবারের মতো যখন ব্যাট করতে নামছেন, ঘড়িতে সময়টা দেখে রেখেছিলাম। ভারতীয় সময় বিকেল তিনটা বেজে ৩৪ মিনিট। শুরু আর শেষের তারিখটা মিলে গেছে দেখে কৌতূহল, নিছকই কৌতূহলভৱে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ব্যাটিং করতে নামার সময়টাও উদ্ধার করার চেষ্টায় নামলাম। সেই টেস্ট কাভার করেছেন, এমন ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছ থেকে 'তিনটা নাগাদ’-এর চেয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু পাওয়া গেল না। তবে ‘তিনটা নাগাদ’ যা করল, তা হলো কৌতূহলটা আরও বাড়িয়ে দেওয়া। বইপত্র-ম্যাগাজিন খুঁজতে খুঁজতে বৈভব পুরান্ডারের লেখা শচীন টেন্ডুলকারের জীবনীতে সময়টা পেলাম এবং বিস্ময়ে যাকে বলে হতবাক হয়ে গেলাম। করাচিতে টেন্ডুলকার ব্যাট করতে নেমেছিলেন ৩টা ৪ মিনিটে। ভারতীয় না পাকিস্তানি সময় লেখা নেই। তবে স্থানীয় সময় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তা-ই যদি হয়, তা হলে তো শচীন টেন্ডুলকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম আর শেষবারের মতো ব্যাটিং করতে নেমেছেন শুধু একই দিনে নয়। একই দিনের একই সময়ে! এ তো দেখছি রীতিমতো ভুতুড়ে ব্যাপারস্যাপার।

দৈব নির্ধারিত বলেই হয়তো ওয়ানডেতে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটাও সেরা সময় পেরিয়ে আসা শচীন টেন্ডুলকারের

যত ভাবি, ততই মনে হয় অতুল রানাডের কথাটাই বোধ হয়। ঠিক। সেই কিন্ডারগার্টেন থেকে টেন্ডুলকারের বন্ধু। বাল্যবন্ধুকে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরির প্রথম কীর্তি গড়তে দেখার পর রানাডের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল—দেবাচা মুলগা! মারাঠি ভাষার যে শব্দযুগলের অর্থ 'ঈশ্বরের পুত্র'।

ব্যাখ্যাতীত কিছুর ব্যাখ্যা বোধ হয় এমনই হয়। এতজন এত বার কাছাকাছি এসেছেন। ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি একদিন না একদিন অবশ্যম্ভাবীই ছিল। কিন্তু প্রথমটি শচীন টেন্ডুলকারই করবেন, এটা যেন নিয়তি নির্ধারিতই ছিল। সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছেন। বিদায়ের রাগিণী বাজতে শুরু করেছে। গোয়ালিয়রে দিবা-রাত্রির ওই ম্যাচ শুরুর আগে যদি একটি জরিপ করা হতো, ওয়ানডেতে সম্ভাব্য প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে ৩৭ ছুঁই-ছুঁই টেন্ডুলকারের নাম আদৌ আসত কি না সন্দেহ। তার পরও টেন্ডুলকারই তা করবেন ।

কারণ তিনি ‘দেবাচা মুলগা!'

আরেকটি অদ্ভুত মিলের কথাও বলি। ওয়ানডেতে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির ইতিহাস গড়লেন ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। 'কাকতালীয় শব্দটা বেশি ব্যবহার করা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু না করে উপায়ও নেই। ৬৬৪ রানের যে পার্টনারশিপে তাঁকে বিশ্ব চিনেছিল, সেটিও ২২ বছর আগের এক ২৪ ফেব্রুয়ারিতেই!

দেবাচা মুলগা!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×