নস্টালজিয়ার নাম বেসিন রিজার্ভ

উৎপল শুভ্র

২৬ মার্চ ২০২১

নস্টালজিয়ার নাম বেসিন রিজার্ভ

টেলিভিশনে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড তৃতীয় ওয়ানডে দেখতে দেখতে খুব নস্টালজিক লাগছিল। নতুন ম্যাচ, আগে কখনো দেখার প্রশ্নই আসে না, তা সম্ভবও নয়। তা হলে নস্টালজিয়ার রহস্য কী?

বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ক্রিকেট স্টেডিয়ামের কথা বলতে বললে ব্যতিক্রমী কিছু বলতে পারব না। বাকি প্রায় সবার মতোই আমিও অ্যাডিলেড ওভাল আর কেপটাউনের নিউল্যান্ডসের কথাই বলব। অ্যাডিলেডে অনেকবার গিয়েছি। অ্যাডিলেড ওভালে কাভারও করেছি একাধিক ম্যাচ। কেপটাউনে গিয়েছি একবারই। নিউল্যান্ডসে ম্যাচও কাভার করেছি একটাই। সেটাও আবার প্রায় দেড় যুগ আগে, ২০০৩ বিশ্বকাপে।  

পশ্চাৎপটে টেবল মাউন্টেন নিউল্যান্ডসের সৌন্দর্যে বোনাস পয়েন্ট যোগ করেছে। অ্যাডিলেড ওভালের সৌন্দর্য লুকিয়ে এর এলায়িত ভঙ্গিতে। পাশেই ছোট্ট নদী, নদীর ওপর সুন্দর একটা সেতু পেরিয়ে আসতে হয় মাঠে। টেবিল মাউন্টেনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হয়তো সম্ভব নয়, তবে অ্যাডিলেড ওভালের আরও সুন্দর হয়ে ওঠায় এই পরিপার্শ্বের ভূমিকা তো আছেই। চারপাশের ওই শান্ত সমাহিত ভাবটা আমার খুব ভালো লাগে। নিউল্যান্ডসকে ‘অনারেবল মেনশন’ দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ক্রিকেট স্টেডিয়াম হিসাবে আমি তাই অ্যাডিলেড ওভালকেই বেছে নেব। কে জানে, ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড কোয়ার্টার ফাইনালটারও এতে পরোক্ষ ভূমিকা আছে কি না।

সবচেয়ে সুন্দরের স্বীকৃতি দিচ্ছি অ্যাডিলেড ওভালকে, তবে আমার প্রিয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম কিন্তু এটি নয়। প্রিয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম লর্ডস। জীবনে যতবার লর্ডসে পা রেখেছি, প্রতিবারই অবধারিতভাবে অন্য রকম একটা ভালো লাগায় মন আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। আধুনিকতার (স্পেসশিপ সদৃশ প্রেসবক্সটার কথা ভাবুন) সঙ্গে ঐতিহ্যের (টেরাকোটা প্যাভিলিয়ন আর ফাদার টাইমের কথা ভাবুন) দারুণ এক মেলবন্ধনই হয়তো কারণ।

টেলিভিশনে মাঠ দেখছি, কথনো ওপর থেকে ধরা লং শটে পুরো স্টেডিয়াম, কখনো বা এক পাশের সেই সবুজ ঢাল, প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন স্কোরবোর্ড–আর আমার মন ফিরে ফিরে যাচ্ছে নিকট অতীত থেকে দূর অতীতে।
 

হঠাৎ ক্রিকেট স্টেডিয়াম নিয়ে পড়ার আসল কারণটা্ এবার বলি। টেলিভিশনে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড তৃতীয় ওয়ানডে দেখতে দেখতে খুব নস্টালজিক লাগছিল। নতুন ম্যাচ, আগে কখনো দেখার প্রশ্নই আসে না, তা সম্ভবও নয়। তা হলে নস্টালজিয়ার রহস্য কী? রহস্য ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভ। টেলিভিশনে মাঠ দেখছি, কথনো ওপর থেকে ধরা লং শটে পুরো স্টেডিয়াম, কখনো বা এক পাশের সেই সবুজ ঢাল, প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন স্কোরবোর্ড–আর আমার মন ফিরে ফিরে যাচ্ছে নিকট অতীত থেকে দূর অতীতে। 

নিকট অতীত মাত্রই বছর দুয়েক আগে আর দূরতম অতীত প্রায় ২০ বছর আগে। বেসিন রিজার্ভে প্রথম পা রেখেছিলাম ২০০১ সালে। বাংলাদেশের টেস্ট কাভার করতে। যে টেস্টের কথা উঠলেই  সঙ্গে সঙ্গে মাশরাফির প্রথমবারের মতো চোটে পড়ার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ওই টেস্টটা অবশ্য শেষ করতে পেরেছিলেন। তবে ক্যারিয়ার জুড়ে ইনজুরির ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকার বীজটা বোনা হয়েছিল এই বেসিন রিজার্ভেই।মাশরাফিকে মনে পড়ে, মনে পড়ে অকাল প্রয়াত মার্টিন ক্রোকেও। যে মাঠে ২৯৯ রানে আউট হয়ে ব্র্র্যাডম্যানের পাশে বসেছিলেন, সেখানে বসেই মার্টিন ক্রোর ইন্টারভিউ করেছিলাম। ব্র্যাডম্যানের কথাটা মনে ছিল, কিন্তু আমি তা বলার আগেই মার্টিন ক্রো তা বলে ফেলেছিলেন। বিষন্ন একটা হাসি দিয়ে বলেছিলেন, ‘একটা সান্ত্বনা তো আছে। অন্তত একটা জায়গায় তো স্যার ডনের পাশে থাকতে পারলাম।’

এত বোলার থাকতে ২৯৯ রানে কিনা আউট হয়েছিলেন অর্জুনা রানাতুঙ্গার বলে! আসলে তো উইকেটটা নিয়েছিল ট্রিপল সেঞ্চুরির অগ্রিম উত্তেজনা। ‘ভুলটা কোথায় হয়েছিল, জানেন? আমি মনে মনে আগেই উদযাপন করতে শুরু করে দিয়েছিলাম।‘ বলার পর উঠে দাঁড়িয়ে হাতের ভঙিমায় দেখিয়েছিলেন, কীভাবে ব্যাট চালিয়ে কট বিহাইন্ড হয়ে ছিলেন।

দেখেন কাণ্ড, ক্রিকেট স্টেডিয়াম নিয়ে কথা বলতে বলতে কোথায় চলে গেলাম! বেসিন রিজার্ভে ফিরি। যে ঘোষণাট করব বলে লেখাটা শুরু করেছিলাম, তা আগে বলে ফেলি। নিউজিল্যান্ডে আমার সবচেয়ে প্রিয় স্টেডিয়াম এই বেসিন রিজার্ভে। নিউজিল্যান্ডের সব মাঠই সুন্দর। শুধু মাঠের কথা বললে কুইন্সটাউন এক নম্বরে আসবে, কিন্তু এটি তো নির্ভেজাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম নয়, বিশাল খোলা ওই প্রান্তর আসলে একটা ইভেন্ট সেন্টার। শুধু মাঠ বললে ডানেডিনের ইউনিভার্সিটি ওভালও থুব পছন্দের। কিন্তু ক্রিকেট স্টেডিয়াম বললে নিউজিল্যান্ডে বেসিন রিজার্ভের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।

তা শুধু সৌন্দর্য নয়, সব অর্থেই। টেলিভিশনে দেখেও সৌন্দর্যটা কিছুটা অনুমান করা যায়, পুরোটা তো আর সম্ভব নয়। বেসিন রিজার্ভের সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি খোলে ডিসেম্বরে। মাঠের চারপাশে ঝাড়বাতির মতো গাছ। নাম পহুটাকাওয়া। ডালে ডালে খয়েরি রঙের ফুল ফুটে থাকে। ক্রিসমাসের সময় ফোটে বলে এই গাছের আরেক নাম ‘ক্রিসমাস ট্রি’।  

মাঠ আর গ্যালারির মাঝখানে পায়ে হাঁটার বৃত্তাকার পথটাও আমাকে প্রায়ই হাতছানি দিয়ে ডাকে। টেস্ট ম্যাচে অনেকবারই ওই পথে মাঠটা চক্কর দিয়ে এসেছি। গ্যালারি বলছি ঠিকই, আসলে তো একদমই প্রথাগত গ্যালারি নয়। একদিকে কাঠের কিছু বেঞ্চ বসানো, বাকি মাঠের পুরোটাতেই বসার জন্য সবুজ ঘাসের ঢাল। যা দেখলেই শুধু বসতে নয়, গা এলিয়ে দিতে ইচ্ছা করে। অনেক দর্শক তা দেনও। যে পথের কথা বলছিলাম, সেটির আরেকটা বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য কোনো স্টেডিয়ামে দেখিনি। এই মাঠে যত সব ক্রিকেটীয় কীর্তি, রেকর্ড সব খোদিত হয়ে আছে ইস্পাতের বড় বড় চাকতিতে। আকারে বৃত্তাকার। ম্যানহোলের ঢাকনার মতো বললে জিনিসটা আপনি ভালো অনুমান করতে পারবেন।   

এবার তাহলে বেসিন রিজার্ভের ক্রিকেটীয় বিশেষত্বের কথা বলি। নিউজিল্যান্ডে প্রথম টেস্টটি এই মাঠে হয়নি। তার পরও এই বেসিন রিজার্ভই নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট তীর্থ। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্টটি হয়েছিল ক্রাইস্টচার্চের ল্যাংঙ্কাস্টার পার্কে। যেখানে এখন আর ক্রিকেটই হয় না। আগেও তা নির্ভেজাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম ছিল না, খেলা হতো ক্রিকেট আর রাগবির মধ্যে ভাগাভাগি করে। নিউজিল্যান্ডের বাকি সব টেস্ট ভেন্যুতেই যেখানে রাগবিতে ক্ষতবিক্ষত মাঠে ক্রিকেট মৌসুম শুরু হতো, একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে ছিল এই বেসিন রিজার্ভ।

এসব তথ্য তো আপনি বই-টইয়েই পেতে পারেন। বই পড়ার অভ্যাস না থাকলে ওয়েবসাইট ঘাঁটলেও। আমি লেখাটা শুরু করেছিলাম অন্য কিছু লিখব বলে। বেসিন রিজার্ভ দেখে নস্টালজিক হয়ে এই মাঠ নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতির ঝাঁপি খুলে ধরতে। স্মৃতি তো অনেক এবং তা শুধু বেসিন রিজার্ভ নিয়েই নয়, বেসিন রিজার্ভের ঠিক পাশেই মার্কসম্যান মটর ইন মোটেল নিয়েও। টেলিভিশনে বেসিন রিজার্ভ দেখলে তো বটেই, বেসিন রিজার্ভের কথা উঠলেও আমার অবধারিতভাবে যে মোটেলের কথা মনে পড়ে যায়। বলতে পারেন, দুটি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। 

তিন তলা প্যাভিলিয়ন ভবনের উল্টো দিকের যে প্রান্তটা দেখেছেন টিভিতে, তার ঠিক পেছনেই ওই মোটেল। মাঝখানে অন্য হোটেলে থেকেছি, তবে ২০০১ সালে প্রখম ও ২০১৯ সালে সর্বশেষবার থেকেছি ওই মোটেলেই। রাস্তা পেরোলেই মাঠ, মোটেলের বারান্দায় দাঁড়ালেই যে মাঠের প্রায় পুরোটা দৃষ্টিসীমায় চলে আসে। বড় সুবিধাও হয় তাতে। বৃষ্টি-টৃষ্টি থাকলে মাঠে গিয়ে অহেতুক বসে থাকতে হয় না। মোটেলের বারান্দা থেকে উঁকি দিয়েই অনুমান করা যায়, খেলা কতক্ষণে শুরু হতে পারে বা আদৌ শুরু হবে কি না। বেসিন রিজার্ভে যে দুটি টেস্ট কাভার করেছি, দুটিতেই বৃষ্টির প্রবল উৎপাত থাকায় বড় সুবিধা হয়েছিল তাতে। 

বেসিন রিজার্ভের সবকিছুই ভালো, শুধু একটা জিনিস ছাড়া। প্রেসবক্সে উঠতে এমন খাড়া সিঁড়ি ভাঙতে হয় যে, রীতিমতো হাঁসফাঁস লাগে। লিখতে লিখতেও যেন সেই অনুভূতিটা ফিরে এলো মনে। নাকি এর অন্য কারণও আছে? একটু আগে শেষ হ্‌ওয়া নিউজিল্যান্ডের ইনিংসে শেষ ১০ ওভারের ব্যাটিং-তাণ্ডবের কি কোনো ভূমিকা আছে নাকি!

কে জানে, থাকতেও পারে।   
      

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×