ফুটবলের যে দুই মা!

ফুটবলের যে দুই মা!

দুটিই মহাদেশীয় ফুটবল টুর্নামেন্ট, মিল বলতে শুধু এটুকুই। এর বাইরে সব কিছুতেই অমিল ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ ও কোপা আমেরিকার। শুধু খেলার ধরনেই নয়, দুটি টুর্নামেন্ট যেন দুই মহাদেশের আলাদা আলাদা গল্প। এই লেখাতে সেই গল্পই।

জন্মদাত্রী মা ইউরোপীয়। সম্পন্ন ঘর, সুঠাম স্বাস্থ্য, শিক্ষিতা। সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্বে অনন্যা। সর্বোচ্চ সুবিধে দিয়েছেন ছেলেকে। সেরা পরিকাঠামো, সেরা স্কুলিং, সেরা কোচিং, বিজ্ঞানসম্মত আহার। চেয়ে এসেছেন, ছেলে হবে সুবোধ। মাস্টারমশাইয়ের অবাধ্য হবে না, নির্দেশ মেনে চলবে হাসিমুখে। সময়ানুগ, নিয়মানুবর্তী, শৃঙ্খলাপরায়ণ; ব্যাকরণ বইতে ‘ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য’ রচনায় যেমন আদর্শ ছাত্রকে তুলে ধরা হয়। বেচাল-বেসুর-বেতাল কিছুর অস্তিত্বই নেই। সুন্দর, সুস্থ, স্বচ্ছ জীবনবোধের আদর্শে জারিত। ‘মামা’স বয়’ থেকে ‘কোচেস বয়’–রূপান্তর সহজ, স্বাভাবিক। পরিচর্যায় কোনও ঘাটতি রাখেননি মা। ধারাবাহিক অনুশাসনে সভ্য করে গড়ে তুলেছেন সন্তানকে। শিক্ষক আটটায় আসতে বললে পৌনে আটটায় চলে আসে, বারোটায় বেরোতে বললে সাড়ে বারোটায় বেরোয়। অনুশীলনে ফাঁকি নেই। যা বলা হয়েছে, মেনে চলে হুবহু। ছেলের ফুটবলও তাই ‘ডিসিপ্লিনড’, ‘সিস্টেমেটিক’। শৃঙ্খলায় শৃঙ্খলিত। সবই তাকে শেখানো হয়েছে, নিজে নিজে শেখার সুযোগই যে ছিল না!

ইউরো আর কোপার ট্রফির মধ্যে যেমন পার্থক্য, তেমনি পার্থক্য ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকান ফুটবলেও

ফুটবলের ধাত্রী–মা দক্ষিণ আমেরিকার। দরিদ্র, পৃথুলা, শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, বস্তিবাসী। প্রচুর দায়িত্ব কাঁধে। অনেক সন্তান। তাদের দেখভাল তো বটেই, বেশিরভাগ সময়ই বাড়ির মানুষকেও দেখেশুনে রাখতে হয়, না–হলেই মাতাল হয়ে সন্তান পিটবেন। উদয়াস্ত পরিশ্রম। সন্তানের দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার সময় কই? সংসারটাকে রাখতে হবে তো! প্রথাগত শিক্ষার আলো ঢোকেনি। ছাদের ফুটো চাল দিয়ে সূর্যের আলো আর বৃষ্টির জলের অবাধ আনাগোনা। এক থালায় চার ভাইবোনের খাওয়া। মারামারি, ঝগড়া। আবার একে–অপরকে জড়িয়েমড়িয়ে ঘুম। পারিবারিক একাত্মবোধ।

সেই মায়ের সন্তান তাই শৃঙ্খলমুক্ত, ‘ফ্রি’! শাসনমুক্ত চলাফেরা বস্তির রাস্তায়। বাড়িতে সময় কাটানো মানেই ঘ্যানঘ্যানে দারিদ্র‌্, পড়শির অশ্রাব্য খেউড়। তার চেয়ে শতগুণে ভালো ছেঁড়া কাপড়চোপড় বা কাগজের টুকরো দিয়ে বাঁধা গোলাকৃতি বস্তুটি। ‘পায়ে নিয়ে চল্‌’। যে দিকে দু’চোখ যায়। শান্তি নেই তবু। রাস্তা অপরিসর। মানুষের অস্থির পদচারণা। মা দরিদ্র হতেই পারেন, অর্থের অভাব ঢাকেন মমতায়। বাঁচিয়ে রাখেন অনিশ্চিত জীবনের হতাশাগ্রস্ত স্বামীর মারের হাত থেকে। বিপদ আসবে জীবনে, ‘কাটিয়ে নে’ মন্ত্রে দীক্ষা। তার ফুটবলও তেমন। আট থেকে ষাট, সপ্তাহান্তে হাজির বস্তির মাঠে। কাজ শেষ বা বন্ধ, বিনোদনের দুটিই রাস্তা। বিকেলে ফুটবল, সন্ধেয় আকণ্ঠ মদ। বাবা–কাকা–মামাদের অনেকেরই আবার সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষার সময়ও নেই। দু–পাত্তর চড়িয়েই মাঠে–নামা। গোদা পায়ের লাথি এড়াতে ছল–চাতুরি শিখতে হয় ছোটবেলাতেই। পেছন থেকে উদ্যত পা, ছায়া দেখে সরে–যাওয়া। কেউ থাকে না সামনে, বলে–দেওয়ার, পথ দেখানোর। কষ্টার্জিত শিক্ষা, কিন্তু, নিজস্ব। তার ফুটবলেও সেই নিজস্বতার ছোঁয়া। কল্পনার রং। স্কিলের প্রাচুর্য। কিন্তু, পরিমিতিবোধের অভাব, শৃঙ্খলাহীন! তার স্বপ্ন একটা গোটা চামড়ার বল, নিজের। দারিদ্র‌ তার ‘ক্রুসেড’। জয় করতে হবে স্বতস্ফূর্ততায়। ফুটবল খেলেই। ছাড়তে হবে ধাত্রী–মায়ের দেশ, যেতে হবে জন্মদাত্রীর দেশে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তারও যে তাড়া প্রচুর!

বিশ্ব–ফুটবল আসলে এই দুই মায়ের ছেলেদের গল্প। ভদ্র, মার্জিত একদল; অন্য দল বেপরোয়া, বল্গাহীন। ‘ট্রেইনড’ আর ‘র’। প্রশিক্ষিত বনাম কাঁচা। দ্বন্দ্ব আছে, থাকবে। প্রচার, প্রসার বাড়াবে একদল, অন্য দলের বাড়বে প্রভাব। এরোপ্লেনের ওড়া, বোতামের নিয়ন্ত্রণ, এয়ার–বেস থেকে নির্দেশ। ঈগলের স্বাধীন উড়ান, স্বকীয়তায় ভরপুর। অন্য খেলার অন্য দুই ব্যক্তিত্ব — ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান ও ভিক্টর ট্রাম্পার — সম্পর্কে লিখেছিলেন প্রয়াত নেভিল কার্ডাস। অনেক বড় আকারে সাযুজ্য আসলে ফুটবলে। ‘There are two types of football, prose and poetry. European teams are prose, tough, premeditated, systematic, collective. Latin American ones are poetry, ductile, spontaneous, individual, erotic’, লিখেছেন টনি ম্যাসন, ‘প্যাশন অব দ্য পিপল?’ বইতে।

ইউরোপজুড়ে ইউরো মিশেল প্লাতিনির উর্বর মস্তিস্কেরই ফসল। ছবি: গেটি ইমেজেস

সভ্যতার সঙ্গে শৃঙ্খলার সম্পর্ক নিবিড়। শৃঙ্খলার সঙ্গে ইউরোপেরও। তাই অন্তত দশ বছর আগে ঠিক হয়ে যায়, ২০২০-র ইউরো হবে ইউরোপ-জুড়ে। পরিকল্পনা করে দিয়ে যান মিশেল প্লাতিনি, ফরাসি। বিশ্বের বড় বড় প্রতিযোগিতাগুলোর দিকে তাকান একবার। ফরাসিরাই মূল। অলিম্পিক্স-এর ভাবনা পিয়েরে দ্য কুবার্তিনেরর, ফুটবল বিশ্বকাপের পেছনে জুলে রিমে। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, এখন যা ইউরো, ট্রফিতে নাম অঁরি দেলাউঁ-র। সবার ফ্রান্সের পাসপোর্ট। সেই ধারাতেই প্লাতিনিও। মনে হয়েছিল, ২০২০ সালে ইউরো-র ৬০ বছর হবে (শুরু ১৯৬০)। বিশেষ কিছু করা দরকার। এক বা দুই দেশের যৌথ আয়োজনের রীতি ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া মহাদেশ জুড়ে। তাই প্রাথমিকভাবে ঠিক হয়েছিল ১৩ দেশের ১৩ শহরে হবে ইউরো। দশ বছর আগে তখন কোভিড১৯ কোথায়! পরে তাই দুটি শহর বাদ গেলেও, প্লাতিনির সেই বিশেষ ভাবনাকে ছেড়ে দেয়নি উয়েফা, ইউরোপীয় ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা। আখেরে বরঞ্চ লাভই হয়েছে। এই অতিমারির বাজারে একটি দেশে মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা আয়োজন কঠিনতর হতো, নিঃসন্দেহে।

কোপার ইতিহাস দেখুন। ২০১১-র পর নিয়ম মেনে ২০১৫। তারপর হঠাৎ ২০১৬, ২০১৯ এবং ২০২০! কেন হঠাৎ, কারণ অবশ্যই আছে। কিন্তু মহাদেশীয় প্রতিযোগিতার চার বছরের ঐতিহ্যশালী ব্যবধান ধরে রাখার ঘোষণা হয়েছিল ২০০৬ নাগাদ। ২০০৭-২০১১-২০১৫, তিনবার হয়েই ২০১৬-য় ইতিহাসে ফিরে-যাওয়া। কোপা আমেরিকার শতবর্ষপূর্তিতে (শুরু ১৯১৬)। সে না হয় বোঝা গেল, যুক্তিগ্রাহ্য কারণ। কিন্তু ২০১৬-র পরই ২০১৯ এবং আবারও কুড়িতে, এক বছরের মধ্যেই? কনমেবল যুক্তি দিয়েছিল, বিজোড় নয় জোড়সংখ্যক বছরে নিয়ে যেতে চায়। তো, ২০২০-র আসর যখন অতিমারির কারণে পিছিয়ে দিতেই হল, দুই আয়োজক দেশ কলম্বিয়া এবং আর্জেন্টিনা পিছিয়ে এল সভয়, কেনই বা জোর করে ব্রাজিলকে আয়োজক হিসাবে আবার টেনে আনা, সেই বিজোড় সংখ্যক বছরেই? এবং, আরও যা গুরুত্বপূর্ণ, অতিমারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশটার নামও যে ব্রাজিল! ২০১৬-তে কোপা হওয়ার পরই জোড়সংখ্যার এই থিওরিটা মাথায় এলেই তো সরাসরি কুড়িতে হতে পারত, মাঝের ২০১৯ বাদ দিয়ে, তাই না?

সমস্যা আরও অনেক। প্রতিযোগিতা ২০২২-এ নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, জোড়সংখ্যক বছরের যুক্তি টিকিয়ে রাখতে। কাতারে বিশ্বকাপ আছে ২০২২-এ, অপরিবর্তনীয়। কোভিড অতিমারির ঢেউ তত দিন পর্যন্ত টিকে থাকবে না, মানবসভ্যতার অগ্রগতির স্বার্থেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। একই বছরে বিশ্বকাপ আর কোপা হলে বাড়তি চাপ। কোনও সংস্থার পক্ষেই নেওয়া সম্ভব নয়। ফিফাও চাইবে না। তাই বাধ্য হয়েই এবার। পরের কোপা ২০২৪, এখনই ঘোষিত। এবং ২০১৬, ২০২১-এর পর ২০২৪ থেকে চার বছর অন্তর একই সঙ্গে ইউরো আর কোপা হবে, আপাতত এ-ও নিশ্চিত। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমাদের এশীয় উপমহাদেশে তাই নাকাল হতেই হবে আন্তর্জাতিক ফুটবলের রাতজাগা পাখিদের – সন্ধে সাতটা থেকে পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত টেলিভিশনের সামনে ঠায় বসে থাকা যায়, ঘুমহীন?

ফিফা আবার রীতিমতো ভাবছে, বিশ্বকাপ প্রতি দু-বছর অন্তর করা যায় কিনা! চার বছরের ব্যবধান ইনফান্তিনোদের কাছে মনে হচ্ছে, বড্ড বেশি। বিশ্বকাপের উদ্দীপনা, উত্তেজনা, উন্মাদনা আরও বাড়াতে ইনফান্তিনো বরাবরই সংখ্যাতত্ত্বে জোর দিচ্ছেন। ৩২ থেকে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা ৪৮-এ নিয়ে যাওয়ার মতো।

যদি তা সত্যি হয়, মহাদেশীয় প্রতিযোগিতাগুলোর কী হবে? বিশ্বকাপের পর দ্বিতীয় বছরে ইউরো আর কোপা হওয়ার যে সিদ্ধান্ত উয়েফা আর কনমেবল নিয়েছে, মাঠে মারা যাবে। আবার ফিরিয়ে আনতে হবে বিজোড় সংখ্যক বছরগুলোকে–কেঁচে গণ্ডুষ!

তার চেয়ে বরং এটা ভালো। একই বছরে ইউরো আর কোপা। বিশ্ব ফুটবলের দুটি গোলার্ধকে মিলিয়ে এমনিতেই তো ফুটবলের বিশ্ব-দর্শন হয়েই যাচ্ছে! ইউরো আর কোপা মানে একসঙ্গে মিলিয়ে বিশ্বকাপই তো, শুধু সেখানে সরাসরি ইউরোপ বনাম দক্ষিণ আমেরিকা নেই, বা, সেই অর্থে অন্যান্য মহাদেশগুলোর প্রতিনিধিরা নেই, বিশেষ করে আফ্রিকা এবং এশিয়া। কিন্তু ক্যালেন্ডারের একই মাসে ইউরো আর কোপা মানে বিশ্বকাপের তুলনায় কোন অংশে কম? ইতালি-জার্মানি-ফ্রান্স-স্পেন-পর্তুগাল-ইংল্যান্ডের পাশাপাশি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ে-চিলে-কলম্বিয়া। চলুক না!

কোপায় মেসিরা খেলেন বলে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগও। ছবি: গেটি ইমেজেস

ইউরো নিয়ে তবু একটা খটকা থেকেই গিয়েছে। অশিক্ষিত-অমার্জিত এমনকি অসভ্যও বলতে চায় যাদের ইউরোপ, সেই দক্ষিণ আমেরিকা যদি ১৯১৬ সালে মহাদেশীয় প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে, ইউরোপকে কেন সেই মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা প্রথম আয়োজন করতে হলো ১৯৬০ সালে? নিজেরা শ্রেষ্ঠ এই মতবাদে বিশ্বাস কি এতটাই গভীর ছিল যে, নিজেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা আলাদা করে আয়োজন অর্থহীন মনে হয়েছিল? তা-ই বা কী করে মেনে নেওয়া সম্ভব? নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি থেকেই তো দু-দু’টি বিশ্বযুদ্ধও বিশ্বকে দিয়েছিল জার্মানি তথা ইউরোপই, তাই না?

বরঞ্চ আসুন বাঙালির সাধের ‘লাতিন’ আমেরিকাতেই নয় ঘুরে আসা যাক খানিক, যেখানে সভ্যতার শৃঙ্খল বেড়ি পরায়নি ততটা এখনো। বয়স বড়জোর ১২–১৩। বস্তিতে খেলে একটু–আধটু পরিচিতি। পথচলতি মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ছে হঠাৎ। পায়ের কাজে ভাললাগার আবেশ। ক্ষণিকের বিশ্রাম নিজের পা–দুটিকে, একটু চোখের আরাম নিয়ে আবার দৌড়। বয়ঃসন্ধিতে পা দিতে–চলা মাঠের কিশোরের ভাবারই সময় নেই। আবার একটা ম্যাচ আছে এরপর। বাড়তি কিছু পেসো, যা দিয়ে কেনা যাবে একটা বড় পিৎজা। বন্ধুদের বলা আছে, সন্ধেয় পাড়ার ঠেক–এ হাজিরা দিতে। চমকে দিতে হবে! মায়ের কাছে চাওয়া মানেই তো বাবার বকুনি, মেজাজ খারাপ থাকলে পিটুনিও। কী দরকার? আর একটা ম্যাচ খেললেই পিৎজা-পূরণ। ওই দ্যাখ, আবার আসছে রে গোদাটা, ইনসাইড দেখা, ওর মাথায় একটুও বুদ্ধি নেই, সহজ ছলও বুঝবে না, হেলে যাবে, আউটসাইড ডজটা করে বেরিয়ে যা, এগো –

চল্, কাটিয়ে নে!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×