ক্রীড়াঙ্গনের কলঙ্কিত এক দিন

দুলাল মাহমুদ

১৫ জুন ২০২১

ক্রীড়াঙ্গনের কলঙ্কিত এক দিন

ফুটবল মাঠে গন্ডগোলের জন্য জেল খাটা! অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমন ঘটনাই ঘটেছিল বাংলাদেশের ফুটবলে। ১৯৮২ সালে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে মারামারির জের ধরে জেল খাটতে হয়েছিল আবাহনীর চার ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন, আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, কাজী আনোয়ার ও গোলাম রব্বানী হেলালকে। ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দেশের ফুটবলের কলঙ্কিত সেই অধ্যায়কে স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেরা ৫০-এর অন্তর্ভূক্ত করার সময় `সেরা` শব্দটা বদলে `আলোচিত` লেখাই ভালো।

১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের গ্রুপ পর্বে একেবারেই ছন্নছাড়া লেগেছে তাঁকে। মাঠে থেকেও তাঁর মন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। উদাসী মেঘের মতো এলোমেলোভাবে ছোটাছুটি করেন। হয়তো দুই বছর ফুটবল খেলার সঙ্গে সম্পর্কহীন থাকার কারণে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না কিংবা সন্তান সম্ভবা প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিল তাঁর হৃদয়। হতেই পারে স্ত্রীকে ছেড়ে আসার বিরহ-যাতনা তাঁকে মোটেও সুস্থির হতে দিচ্ছিল না। একটা গোলও করতে পারেননি তিনি। তাঁর দলও কোনো ম্যাচে জিততে পারেনি৷ বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তি সেই দল তিন ম্যাচ ড্র করেও গোল কম খাওয়ার সুবাদে সৌভাগ্যক্রমে পরের রাউন্ডে উঠেছিল। 

তারপরও কেন যেন দ্বিতীয় রাউন্ডেও ফর্মহীন এই স্ট্রাইকারের ওপরই বাজি ধরেন কোচ। নিজ দলের সব খেলোয়াড়ের নাড়ি-নক্ষত্রের খোঁজ রাখতে হয় একজন কোচকে। এমনকি রাখতে হয় মনের খবরও। তিনি সম্ভবত খেলোয়াড়টিকে উজ্জীবিত করেন এই মন্ত্রে, বাবা হওয়া জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় এক ঘটনা। ভূমিষ্ট হতে যাওয়া তোমার পুত্রকে যদি এই বিশ্বকাপের শিরোপা উপহার দিতে পারো, তুমি হবে জগতের শ্রেষ্ঠ পিতা। কোচের এই জাদুমন্ত্রই বোধ করি তাঁকে অনুপ্রাণিত করে থাকবে। থিতু হয় তাঁর উদাসী মন। দেখা দেন পুরো ভিন্ন চেহারায়। কোচের আস্থার প্রতিদান দেওয়ার পাশাপাশি অনাগত সন্তানের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞায়ও হয়তো শাণিত করে নেন নিজেকে। 

ছবি তো নয়, যেন দেশের ফুটবলের লজ্জা। হাতকড়া হাতে থানায় আবাহনীর ফুটবলার—কাজী আনোয়ার, আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, কাজী সালাউদ্দিন ও গোলাম রব্বানী হেলাল। ছবি: সংগৃহীত

দ্বিতীয় পর্বে এমনভাবে জ্বলে ওঠলেন, কাঁপিয়ে দিলেন ফুটবল দুনিয়াকে। যা ছিল অভাবিত, অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়। ১৯৮২ বিশ্বকাপের ফরম্যাট ছিল একটু ভিন্ন। গ্রুপ পর্বের খেলা শেষে দ্বিতীয় রাউন্ডে আবার তিন দলের গ্রুপ। যে গ্রুপের অন্য দুই দল ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। যাদের টপকে ওই স্ট্রাইকারের দলের সেমিফাইনাল খেলার কোনো সম্ভাবনাই কেউ দেখেননি। অথচ সেই অভাবনীয় ঘটনাই ঘটল, যার নায়ক এর আগ পর্যন্ত নিজেকে হারিয়ে খোঁজা ওই স্ট্রাইকার। 

শুরু করেন ব্রাজিলের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক দিয়ে! কোন ব্রাজিল? সক্রেটিস, জিকো, জুনিয়র, ফ্যালকাওয়ের যে দলকে শুধু ব্রাজিলের ইতিহাসেরই নয়, বিবেচনা করা হয় সর্বকালের সেরা দলেরই একটি হিসেবে। সেমিফাইনালে পোল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি আর ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে এক গোল দিয়ে ‘গোল্ডেন বুট’ আর সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ‘গোল্ডেন বল’ দুটিই জিতে নেন ওই স্ট্রাইকার। যাঁর নাম পাওলো রসি। অথচ মাস দুয়েক আগেও তাঁর ওই বিশ্বকাপে খেলার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। ইতালির ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাঁকে তিন বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। শেষ অব্দি তাঁর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ কমিয়ে দুই বছর করা হয় এবং অনেকটাই বরাত জোরে জেল খাটা থেকে অব্যাহতি পান। ১৯৭৮ বিশ্বকাপেও তিন গোল করেছিলেন সত্যি, কিন্তু ১৯৮২ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়া অনেকটাই কোচ এনজো বিয়ারজোতের জোরাজুরিতে। সেই পাওলো রসিই ইতালিকে চ্যাম্পিয়ন করে ইতিহাস হয়ে যান।

কেন এই প্রসঙ্গ? এর মাস দুয়েক পরের ঘটনা। বিশ্বকাপের রেশ তখনও মিলিয়ে যায়নি। এর উল্টো ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। সামনে ছিল ভারতের দিল্লিতে নবম এশিয়ান গেমস। এই গেমসে তো দেশের সেরা দলটির অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গেমস শুরুর মাস দুয়েক আগে ঘটে যাওয়া এক কলঙ্কিত ঘটনা সব ওলটপালট করে দেয়। ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগের শেষ ম্যাচে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের মুখোমুখি হয়েছিল আগের বছরের চ্যাম্পিয়ন আবাহনী ক্রীড়াচক্র। মোহামেডান আগেই শিরোপা নিশ্চিত করায় এ ম্যাচটি ছিল শুধুই মর্যাদার লড়াই। যদিও শিরোপা জয়ের চেয়ে চির প্রতিদ্বন্দ্বী এই দলের লড়াইয়ে জয়ী দলের গৌরব কোনো অংশে কম ছিল না। যে কারণে শিরোপা নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পরও এ ম্যাচের আকর্ষণ একটুখানিও টাল খায়নি। এ ম্যাচকে কেন্দ্র করে যথারীতি উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে পুরো দেশ।

খেলা দেখার জন্য যথারীতি সেদিনও ঢাকা স্টেডিয়ামে উপচে পড়া দর্শক। উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছে গ্যালারি। শিরোপা জয়ের উৎসবকে পরিপূর্ণ করে তোলাই ছিল মোহামেডানের লক্ষ্য। আর শিরোপা জিততে না পারলেও সাদা-কালোদের হারাতে পারলে একটু সান্ত্বনা পাবে রানার্সআপ আবাহনী। এমন সমীকরণ সামনে রেখে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধের ২৬ মিনিটে কোহিনুরের দেওয়া গোলে এগিয়ে যায় মোহামেডান। তিন মিনিট পর আবাহনীর কাজী আনোয়ারের করা গোল নিয়ে মাঠে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়। রেফারি মুনীর হোসেন লাইন্সম্যান মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা করে আবাহনীর গোলের আবেদন নাকচ করে দেন। এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি আবাহনীর খেলোয়াড়রা। 

খেলোয়াড়দের কেউ কেউ ঘিরে ফেলেন মহিউদ্দিন চৌধুরীকে। সে সময় ধস্তাধস্তি হয়। এ থেকেই সূত্রপাত ঘটে গণ্ডগোলের। তার রেশ ধরে তখনকার ‘রীতি’ অনুসারে মাঠের উত্তেজনা গ্যালারিতে, তারপর আশেপাশে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। মাঠে ও মাঠের বাইরে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, পুলিশের কাঁদানে গ্যাস সে সময়ে এটা নতুন কোনো বিষয় ছিল না। এমনকি অতীতে এই দু’দলের খেলাকে কেন্দ্র করে নিভে গেছে একাধিক জীবনও। এসব তখন এমনই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল যে, এ খেলায় কোনো গণ্ডগোল না হলে সেটাই বরং অস্বাভাবিক মনে হতো। ওই দিনের খেলা ১১ মিনিট বাকি থাকলেও বাইলজ অনুযায়ী মোহামেডানকে ২-০ গোলে জয়ী ঘোষণা করা হয়। 

হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফুটবলারদের। ছবি: সংগৃহীত

সবাই ভেবেছিলেন, খেল খতম পয়সা হজম। কিন্তু খেলার পরেও যে গোপন খেলা হয়, সেটা এর আগে বাংলাদেশের মানুষের এমনভাবে অন্তত জানা ছিল না। খেলা শেষে ক্লান্তি, বিষণ্নতা ও ব্যর্থতা নিয়ে আবাহনীর ফুটবলাররা ফিরে যান স্ব স্ব গন্তব্যে। কেউ ক্লাবে, কেউ বাসায়, কেউবা দিল্লি এশিয়ান গেমস উপলক্ষে জাতীয় দলের ক্যাম্পে। তখন গভীর রাত। সবাই গাঢ় ঘুমে অচেতন। এমন সময় পুলিশ বিভিন্ন স্থানে হানা দিয়ে মোহামেডানের বিপক্ষে খেলায় অংশ নেওয়া আবাহনীর প্রথম একাদশের ফুটবলারদের সবাইকে জোরপূর্বক ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। তারপর সাধারণ আসামির মতো রমনা থানায় নিয়ে যায়। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও কাজ হয়নি। এমনকি জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (বর্তমানে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ)-এর জাতীয় দলের ক্যাম্প থেকেও আটক করা হয় কাউকে কাউকে। এমনভাবে ফুটবলারদের নিয়ে যাওয়া হয়, যেন তাঁরা ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধী। 

খেলোয়াড়দের রমনা থানায় সারা রাত রাখা হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন অতিথি ফুটবলার শ্রীলঙ্কার পাকির আলী, অশোকা রবীন্দ্রও। এ দুজনকে পরের দিন দুপুরে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় শ্রীলঙ্কান দূতাবাস। থানায় থেকে যাওয়া বাকি নয় জন—কাজী সালাউদ্দিন, আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, কাজী আনোয়ার, গোলাম রব্বানী হেলাল, আবদুল মোতালেব, আশিষ ভদ্র, খোরশেদ আলম বাবুল, মজিদুল ইসলাম মনি ও ইমতিয়াজ সুলতান জনি। এঁদের মধ্যে হেলাল ছাড়া আটজনই এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছেন। উৎসুক মানুষের ভিড় ও ক্ষোভ বাড়তে থাকলে খেলোয়াড়দের নিয়ে যাওয়া হয় শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। সেখানে তাঁদের সঙ্গে বেশ দুর্ব্যবহার করা হয়। গরমের মধ্যে ছোট্ট একটি কক্ষে সবাইকে গাদাগাদি করে রাখা হয়। বৈদ্যুতিক কোনো ফ্যান ছিল না। খেলোয়াড়রা কাহিল হয়ে পড়েন। রাত ৮টার দিকে তাঁদেরকে মিন্টু রোডের এক নম্বর সামরিক আদালতে নেওয়া হয়। রাত ৯টার দিকে সামরিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। খেলার মাঠে অন্যায় করে থাকলে তার বিচার হওয়ার কথা ফুটবলের আদালতে, সামরিক আদালতে কেন? সে প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিল না।  

প্রাথমিকভাবে খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁরা নাকি সামরিক সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। এমন অভিযোগের কারণ, মাস ছয়েক আগে এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন হয়েছে সামরিক বাহিনী। সে কারণে সর্বত্রই অতি উৎসাহী মনোভাব পরিলক্ষিত হয়৷ সর্ষের মধ্যে ভূত দেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র হতে পারে, অভিনব এ অভিযোগ শুনে সবাই হতবাক হয়ে যায়। রাতে বেইলি রোডে মার্শাল ল কোর্টে খেলোয়াড়দের নেওয়া হয়। জনমতের কথা বিবেচনা করে পরে অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদেরকে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়নি। ‘ক’ অঞ্চল ঢাকার ১ নং সংক্ষিপ্ত সামরিক আইন আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হন চার ফুটবলার। বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩২৩ ধারায় তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়। এই অভিযোগে অধিনায়ক কাজী আনোয়ারকে এক বছর, হেলালকে ছয় মাস আর সালাউদ্দিন ও চুন্নুকে এক মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। মামলায় বাদী পক্ষের হয়ে পাঁচ জন সাক্ষী দেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রেফারি মুনীর হোসেন, লাইন্সম্যান মহিউদ্দীন চৌধুরী, আবদুর রশিদ, চতুর্থ রেফারি আবদুল আজিজ প্রমুখ।

বাংলাদেশের ফুটবলের কলঙ্কিত এক অধ্যায়কেই ধরে রেখেছে এই ছবি। বাঁ থেকে: হেলাল, সালাহউদ্দীন, চুন্নু ও আনোয়ার। ছবি: সংগৃহীত

এই রায় শোনার পর খেলোয়াড়রা কান্নায় ভেঙে পড়েন। গভীর রাতে এই রায় সংবাদ সংস্থা বাসস-এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। রাত ১২টার পর অভিযুক্ত ফুটবলারদের হাতে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে ঢাকা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে তাঁদের রাখা হয়। মেঝেতে ছালা বিছিয়ে তাঁরা রাত্রি যাপন করেন। ভোর ৬টার আগে ঘুম থেকে তোলা হয়। এরপর অন্য কয়েদিদের মতো হাঁটু গেড়ে ডিআইজি প্রিজনের সামনে হাজিরা দিতে হয়। জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের ফুটবলের কারণে দণ্ডিত আসামির মতো নতজানু হতে হয়। এরচেয়ে দুর্ভাগ্য আর লজ্জাজনক আর কী হতে পারে? 

এই রায়ের প্রতিবাদে মিছিল বের করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ক্রমান্বয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ক্ষোভ। পরিস্থিতি যাতে উত্তপ্ত না হয়ে ওঠে, সেজন্য সালাউদ্দিন ও চুন্নুকে যশোর এবং আনোয়ার ও হেলালকে ট্রেনে রাজশাহী কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফুটবলারদের হাতকড়া পরিয়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। ফুটবল অনুরাগীরা এ খবর পেয়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বড় ধরনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কায় ফুটবলারদের পুনরায় রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। থানার আশেপাশে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। রাত ১০টার দিকে দ্বিতীয় দফায় খেলোয়াড়দের কমলাপুর স্টেশনে নেওয়া হলে তখনো বিপুলসংখ্যক মানুষ ভিড় জমায়। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য মোতায়েন করা হয় কয়েক প্ল্যাটুন পুলিশ। যে সব স্টেশন হয়ে ট্রেন যায়, খবর পেয়ে খেলোয়াড়দের এক নজর দেখার জন্য সর্বস্তরের লোকজন সেখানে ছুটে যান। কিন্তু সর্বত্রই ছিল পুলিশের কড়া প্রহরা। সাজাপ্রাপ্ত ফুটবলারদের মধ্যে তিনজন ছিলেন এশিয়ান গেমসগামী জাতীয় দলের খেলোয়াড়। কিন্তু বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ তো দূরে থাক, তারা যেন পুরো বিষয়টি উপভোগ করে।  

পাওলো রসিকে দিয়ে লেখাটা শুরু করার একটাই কারণ। একই বছরের দুটি ঘটনার বৈপরীত্য বোঝাতে। ম্যাচ পাতানোর মতো গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় দলের প্রয়োজনে পাওলো রসিকে বিশ্বকাপে খেলানো হয়েছে। আর জাতীয় দলের ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের ফুটবলারদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে কারাগারে। দেশের সেরা ফুটবলারদের না নিয়ে খণ্ডিত জাতীয় দল অংশ নেয় এশিয়ান গেমসে। বিশেষ করে স্ট্রাইকার সালাউদ্দিন, লেফট আউট চুন্নু আর রাইট আউট আনোয়ারের অনুপস্থিতির কারণে জাতীয় দলের জার্মান কোচ গেরহার্ড স্মিথ তাঁর রণকৌশল সাজাতে হিমসিম খেয়ে যান। তা না হলে সেই গেমসে বাংলাদেশ দলের আরও ভালো ফলাফল করার সম্ভাবনা ছিল। সেটা নিয়ে কার আর এমন মাথাব্যথা? বরং জাতীয় দলের সম্মানের চেয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন করে খেলোয়াড়দের দেখে নেওয়ার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। 

ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় গোলাম রব্বানী হেলাল। ছবি: সংগৃহীত

কারাগারে অন্তরীণ ফুটবলারদের প্রতি তাঁদের অনুরাগীরা দেখিয়েছেন ভালোবাসার চমৎকার নিদর্শন। বাড়িয়ে দিয়েছেন সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত। কারাগারে গিয়ে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ করেন। পৌঁছে দেন পছন্দসই খাবার। খেলোয়াড়রা কারাগারেই উদযাপন করেন ঈদুল আজহা। তবে দেশব্যাপী ক্ষোভের সঞ্চার হলে বিশেষ বিবেচনায় ১৭ দিন জেল খাটার পর ৮ অক্টোবর মুক্তি পান ফুটবলাররা। কিন্তু এই সাজা ভেঙে দেয় তাঁদের মনোবল। পাওলো রসি মারাত্মক অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়ে খেলতে নেমে বিশ্বকাপ ফুটবলকে রাঙিয়ে দিলেও বাংলাদেশ জাতীয় দলের এই ফুটবলারদের কেউ কেউ আগের মতো সেভাবে আর জ্বলে ওঠতে পারেননি। ফুটবল খেলার জন্য নাজেহাল হতে হবে, অপমানিত হতে হবে, জেল খাটতে হবে, এটা তাঁরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। এটি তাঁদের মানসিকভাবে অনেকটাই ভঙ্গুর করে দেয়। তাতে ক্ষতি হয়েছে দেশের ফুটবলের।

বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে আছে এই ঘটনা। অনেকেই যেটিকে বলেন ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ ।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×