প্রথম ইনিংসে ১৫, দ্বিতীয় ইনিংসে ৫২১!

উৎপল শুভ্র

১৬ জুন ২০২১

প্রথম ইনিংসে ১৫, দ্বিতীয় ইনিংসে ৫২১!

এই দলটাই লিখেছিল অবিশ্বাস্য এক প্রত্যাবর্তনের গল্প। ছবি: হ্যাম্পশায়ার ক্রিকেট

একটা দল প্রথম ইনিংসে অলআউট হয়ে গেল ১৫ রানে, সেই দলটাই দ্বিতীয় ইনিংসে ৫২১ করে জিতে নিল ম্যাচ। এমনিতেই তো ম্যাচটিকে নিয়ে লেখা হয়নি `ক্রিকেটস্ গ্রেটেস্ট কামব্যাক` নামে একটা বইও! হ্যাম্পশায়ার বনাম ওয়ারউইকশায়ারের ওই মহানাটকয়ীয় ম্যাচটি শেষ হয়েছিল এই দিনেই, যাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রং-বেরংয়ের বেশ কিছু গল্পও।

প্রথম প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২০। প্রথম আলো।

না, শিরোনামটায় কোনো ভুল নেই। ঠিকই পড়েছেন। প্রথম ইনিংসে ১৫, দ্বিতীয় ইনিংসে ৫২১!

কী ভাবছেন, তা অনুমান করতে পারি। এ-ও কি সম্ভব!

ক্রিকেট অভিধানে 'অসম্ভব' বলে যে কোনো শব্দ নেই, এটি প্রমাণ করতে চাইলে এর চেয়ে মোক্ষম উদাহরণ আর হয় না। যেখানে একটি দল প্রথম ইনিংসে ১৫ রানে অলআউট হয়ে ফলো অন করতে নেমে ৫২১ রান করে ফেলে এবং সেই ম্যাচ জিতেও যায়! সেটিও যেন-তেন কোনো ম্যাচ নয়। কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ।

ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্ময়কর এই প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখেছিল হ্যাম্পশায়ার। আর বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাওয়া পরাজিত দলের নাম ওয়ারউইকশায়ার। টসে হেরে ব্যাটিং করতে নেমে ২২৩ রান করার পর প্রতিপক্ষকে সেদিনই যারা ১৫ রানে অলআউট করে দেবে। এরপর হ্যাম্পশায়ারের দ্বিতীয় ইনিংসের ৩ উইকেট তুলে নিয়ে প্রথম দিন শেষে মাঠ ছাড়বে 'জয়টা তো শুধুই সময়ের ব্যাপার' তৃপ্তি নিয়ে। তাদের কল্পনাতেও থাকবে না, হ্যাম্পশায়ার পরদিন আরও ৩৭৭ রান তুলে স্কোর নিয়ে যাবে ৯ উইকেটে ৪৭৫ রানে। তৃতীয় দিন অলআউট হওয়ার আগে যা হয়ে যাবে ৫২১। প্রথম ইনিংসে ১৫ রানে অলআউট হয়ে যাওয়া দলটি ছুঁড়ে দেবে ৩১৪ রান করে জেতার চ্যালেঞ্জ। ১৫৮ রানেই অলআউট হয়ে গিয়ে সেই চ্যালেঞ্জে হেরে ভূত হয়ে যাবে ওয়ারউইকশায়ার।নিল জেকিনসনের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ। ছবি: গুডরিডস

হ্যাম্পশায়ারের জয় নিয়ে পরের বছরের উইজডেনে লেখা হবে, 'সার্বিক বিবেচনায় এই জয় ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট ইতিহাসে নজিরবিহীন।' প্রায় শতবর্ষ পরেও যা নজিরবিহীন হয়েই আছে। ১৯২২ সালের ১৪ থেকে ১৬ জুন ওয়ারউইকশায়ারের হোমগ্রাউন্ড এজবাস্টনে মঞ্চস্থ হয়েছিল অবিশ্বাস্য এই নাটক।

অপরাজিত ৬ রানেই সর্বোচ্চ স্কোরার!

মহা ইন্টারেস্টিং এই ম্যাচের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের গল্পটাও কম ইন্টারেস্টিং নয়। এই ম্যাচ নিয়ে কম তো আর লেখা হয়নি! আস্ত একটা বই-ও। লেখক নিল জেনকিনসন যেটির যথার্থ নামই দিয়েছেন: ক্রিকেটস্ গ্রেটেস্ট কামব্যাক। সে সব পড়েছি পরে। অত্যাশ্চর্য এই ম্যাচের সঙ্গে এর অনেক আগেই পরিচয় এবং সেটির মাধ্যম 'দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ: ক্রনিকল অব ক্রিকেট' নামে আরেকটি বই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে সেই বইয়ের একটা ছবি। লন্ডনের 'দ্য টেলিগ্রাফ' পত্রিকায় সেই শুরু থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য ক্রিকেট রিপোর্টগুলির সারাৎসারের সংকলন এই বই। সেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে ১৯৯৪ পর্যন্ত বছর ধরে ধরে সাজানো। বইটা যেখান থেকে কিনেছি, সেটিকেও একটু ব্যতিক্রমীই বলতে হবে। এয়ারপোর্টে একটু সময় পেলেই বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারাটা চিরদিনের অভ্যাস। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের পরপরই সিঙ্গাপুরে সনাৎ জয়াসুরিয়ার কীর্তধন্য সিঙ্গার সিরিজ কাভার করে ফেরার সময়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ওই ম্যাচটার মতো এই বইটার প্রাপ্তিস্থানও একটা চমক। সিঙ্গাপুরে ক্রিকেট নিয়ে এমন দারুণ একটা বই পেয়ে যাব কল্পনাও করিনি।

ফিল মিডের সেই ছবি। ক্যাপশনটা পড়ুন, অপরাজিত ৬ রান করেই ইনিংসের সর্বোচ্চ স্কোরার! ছবি: দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ: ক্রনিকল অব ক্রিকেট বই থেকেএই বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে ক্রিকেট ইতিহাস। হোক না সেটি 'বনসাই' আকারে। তা উল্টাতে উল্টাতেই চোখ আটকে যায় ১৯২২ সালের একটা রিপোর্টের সঙ্গে মুদ্রিত ফিল মিডের ছবিটাতে। নাম এবং চেহারা দুটিই পরিচিত। ইংল্যান্ডের হয়ে ১৭টি টেস্ট খেলে ৪৯.৩৭ গড়ে ১,১৮৫ রান করেছেন, সেঞ্চুরি ৪টি। এটা এমন কিছু নয় যে, ছবি দেখেই চিনে ফেলতে হবে। ফিল মিডকে চেনার কারণ তাঁর ফার্স্ট ক্লাস রেকর্ড। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তাঁর চেয়ে বেশি রান করেছেন মাত্র তিনজন। তাঁর ১৫৩টি সেঞ্চুরির চেয়ে বেশি সেঞ্চুরিও আছে মাত্র তিনজনেরই। একটা ক্ষেত্রে অবশ্য এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান সবার ওপরে। হ্যাম্পশায়ারের পক্ষে তাঁর ৪৮,৮৯২ রান এখনো নির্দিষ্ট একটি দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড। ১৯২২ সালের ওই ম্যাচে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব অবশ্য ফিল মিডের ছবিটির নয়, ছবির ক্যাপশনের। যেটি এ রকম---ফিল মিড: টপ স্কোরার ইন হ্যাম্পশায়ার'স্ ফার্স্ট ইনিংস-উইথ সিক্স নট আউট!

এই ক্যাপশন দেখে কার না কৌতুহল হবে! ৬ রানে অপরাজিত থেকে ইনিংসের সর্বোচ্চ স্কোরার হওয়াটাই যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। এর চেয়েও বড় প্রশ্ন, সে জন্য ছবি দিতে হবে কেন? এই কৌতূহল থেকেই লেখাটা পড়া এবং অবিশ্বাস্য সেই ম্যাচের সঙ্গে পরিচয়।

হ্যাম্পশায়ারের ১৫ রানের ওই ইনিংসে ফিল মিড ছাড়া রান করেছিলেন আর মাত্র দুজন। অধিনায়ক লর্ড টেনিসন ৪, উইলিয়াম শার্লি ১। ব্যাট থেকে ১১ রানের সঙ্গে অতিরিক্ত খাতে ৪। বাকি আট ব্যাটসম্যানই শূন্য, যেটি এখনো ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি শূন্যের রেকর্ড (সঙ্গীসাথী অবশ্য আছে)। সময়ের হিসাবে হ্যাম্পশায়ারের ইনিংস স্থায়ী হয়েছিল ৪০ মিনিট, ওভারের হিসাবে ৮.৫। ওয়ারউইকশায়ারের দুই ওপেনিং বোলার ছাড়া আর কেউ বোলিং করার সুযোগ পাননি। হ্যারি হাওয়েল ৪.৫ ওভার বোলিং করে ৭ রানে ৬ উইকেট নেন। অধিনায়ক ফ্রেডি ক্যালথ্রপ ৪ রানে ৪ উইকেট।

লর্ড টেনিসনের বাজি

হ্যাম্পশায়ারের প্রথম ইনিংসে অপরাজিত ফিল মিড অপরাজিত প্রথম দিন শেষে ফলো অন ইনিংসেও। তাঁর সঙ্গী অধিনায়ক টেনিসন। হাতে ৭ উইকেট আছে, কিন্তু ওয়ারউইকশায়ারকে আবার ব্যাট করাতেই লাগে আরও ১২০ রান। প্রথম দিনের খেলা শেষে মাঠ থেকে বেরোনোর সময় দুই অধিনায়কের মানসিক অবস্থা তাই অনুমান করাই যায়। 

ওয়ারউইকশায়ার অধিনায়ক ফ্রেডি ক্যালথর্প সেটি প্রকাশও করে ফেললেন। ম্যাচ তো পরদিনই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ম্যাচের যেটি তৃতীয় দিন হওয়ার কথা, সেদিনের করণীয়ও ঠিক করে ফেলেছেন। গলফ খেলতেও প্রায় ক্রিকেটের মতোই পছন্দ করেন। ক্রিকেটার্স গলফ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাও তাঁর হাত ধরেই। টেনিসনকে তিনি বললেন, 'ভালোই হলো, কাল খেলা শেষ হয়ে যাবে। পরশু দুই দলের অ্যামেচাররা মিলে আমরা গলফ খেলতে যাব।'

অবিশ্বাস্য সেই ম্যাচের দুই অধিনায়ক লর্ড টেনিসন ও ফ্রেডি ক্যালথর্প। ছবি: সংগৃহীত

শুধু অ্যামেচাররা কেন? কারণ ক্রিকেটে তখন শ্রেণিভেদের যুগ। ক্রিকেটাররা অ্যামেচার আর প্রফেশনাল দুই ভাগে বিভক্ত। তাদের ড্রেসিংরুম আলাদা, এমনকি মাঠে ঢোকার গেটও। কাউন্টি দলে মিলেমিশে খেললেও পেশাদার আর অপেশাদারদের মধ্যে জেন্টলম্যানস বনাম প্লেয়ার্স ম্যাচও খেলা হয় প্রতি বছর। অভিজাত শ্রেণিভুক্ত যাঁরা শখে খেলেন, তাঁরা জেন্টলম্যান। আর খেলে টাকা পান, তাঁরা প্লেয়ার। প্রফেশনালদের তো আর গলফ খেলতে যাওয়ার বিলাসিতা মানায় না। চাইলেও তখন তারা তা পারতেন কি না, এটাও একটা প্রশ্ন।

কাউন্টির অধিনায়কত্বটাও তখন অভিজাতদের জন্যই সংরক্ষিত। সেটিই যথেষ্ট নয়, নামের আগে কোনো না কোনো খেতাবও থাকতে হবে। এই ম্যাচের দুই অধিনায়ক ভালো বন্ধুও বটে। তা বন্ধুর খোঁচাই তো মনে বেশি লাগে। ক্যালথ্রপের কথা শুনে টেনিসন তাই খুবই অপমানিত বোধ করেন। রেগেমেগে ঘোষণা করে দেন, তাঁর দলই জিতবে এই ম্যাচ। সেখানেই থেমে না গিয়ে হ্যাম্পশায়ারের জয়ের পক্ষে অসম্ভব বাজিতে ১০ পাউন্ডও লাগিয়ে দেন। উইজডেনে তাঁর অবিচুয়ারি অনুযায়ী অবশ্য একটি নয়, টেনিসন একাধিক বাজিই ধরেছিলেন।

এই লর্ড টেনিসন, যাঁর পুরো নাম লায়োনেল হ্যালাম টেনিসন, বিখ্যাত কবি আলফ্রেড টেনিসনের নাতি। বিশ্বযুদ্ধে তিনবার আহত হয়েও বেঁচে যাওয়ার পর বাকি জীবনটা প্রাণভরে উপভোগ করার মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছেন। 'খাও, পিও, জিও'-এর সঙ্গে যোগ করে নিয়েছেন জুয়া খেলাটাও। সুযোগ পেলেই বাজি ধরে ফেলেন। বরং বলা ভালো, সব সময়ই বাজি ধরার সুযোগ খোঁজেন। এর আগের বছর (১৯২১) তাঁর ধরা একটা বাজি খুব আলোচিত হয়েছে। লন্ডনের এক বারে পার্টি করছিলেন। গভীর রাতে খবর পেলেন, পরদিন শুরু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লর্ডস টেস্ট ম্যাচে খেলতে হবে। যা শুনে কোথাও মানসিক প্রস্তুতির অভাবের কথা বলবেন, তা না, টেনিসন উল্টো বলেন, আগে জানলে আরও এক-দুইটা সিগার বেশি টানা যেত। এই টেস্টে কমপক্ষে ফিফটি করবেন বলে এক বন্ধুর সঙ্গে ৫০ পাউন্ড বাজিও ধরে ফেলেন। অপরাজিত ৭৪ রানের ঝোড়ো এক ইনিংস খেলে সেই বাজি তো জেতেনই, পরের টেস্টে ইংল্যান্ডের অধিনায়কও হয়ে যান।

ব্রাউন-লিভসির কীর্তি

বন্ধু ক্যালথর্পকে উপযুক্ত জবাব দিয়েছিলেন টেনিসন, জিতেছিলেন বাজিতেও, সেটি তো আপনি এরই মধ্যে জেনে গেছেন। মূল কৃতিত্বটা অবশ্য তাঁর নয়। সেটি জর্জ ব্রাউনের। সঙ্গে আসবে আরেকটি নাম। উইকেটকিপার ওয়াল্টার লিভসি। রূপকথা লেখা হয়েছিল এই দুজনের ব্যাটেই।এই সেই লিভসি। একমাত্র ফার্স্ট ক্লাস হান্ড্রেডেই যিনি নিশ্চিত করেছেন অমরত্ব। ছবি: হ্যাম্পশায়ার ক্রিকেট

পরদিন ৪৫ রানেই আউট হয়ে গেছেন টেনিসন। হ্যাম্পশায়ার তখনো ৫৬ রানে পিছিয়ে। হাতে উইকেট আর ৫টি, কারণ ফিল মিড আগেই ফিরে গেছেন। ১৮৬ রানে ৬ উইকেট পড়ার পর তো ম্যাচের ফল ও স্থায়িত্ব দুটিই মোটামুটি চূড়ান্ত হয়ে গেছে। ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টির সেক্রেটারি অধিনায়ক ক্যালথর্পকে বার্তা পাঠিয়েছেন, নতুন বল পাওনা হলেও সেটি যেন না নেওয়া হয়। হ্যাম্পশায়ার আরেকটু ব্যাটিং করুক। এমনিতেই তিন দিনের ম্যাচ দুই দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে, দর্শকদের অন্তত আরও কিছুক্ষণ খেলা দেখার সুযোগ দেওয়া উচিত।

টেস্ট ব্যাটসম্যান জর্জ ব্রাউন তখনো আছেন। কিন্ত অন্য প্রান্তে যে উইকেট পড়েই যাচ্ছে! ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান লিভসি যখন নামলেন, হ্যাম্পশায়ার মাত্র ৬৬ রানে এগিয়ে। এই ম্যাচের আসল গল্পটা শুরু এরপরই। নবম উইকেটে ব্রাউন ও লিভসির ‌১৭৭ রানের জুটিতে আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকল ম্যাচের রং। ব্রাউন ১৭২ রান করে আউট হয়ে গেলেও দিন শেষে লিভসি অপরাজিত ৮১ রানে। হ্যাম্পশায়ারের স্কোর ৯ উইকেটে ৪৭৫। পরদিন ৫২১ রানে হ্যাম্পশায়ারের ইনিংস শেষ হয়ে যাওয়ার সময়ও লিভসি অপরাজিত। রান ১১০। সেই মৌসুমে একমাত্র পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস। এই পারফরম্যান্সের পর টেনিসন লিভসির বেতন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কি না, সেটি জানা যায় না। সেটি অবশ্য তাঁর হাতেই ছিল। টেনিসনের প্রাসাদোপম বাড়িতে বাটলারের কাজ করতেন লিভসি।

নাম তাঁর জর্জ ব্রাউন

লিভসির সাহায্য না পেলে ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর কামব্যাকের গল্প লিখতে পারতেন না সত্যি, তবে এই ম্যাচের অবিসংবাদিত নায়ক অবশ্যই জর্জ ব্রাউন। ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া বর্ণময় এক চরিত্র। ইংল্যান্ডের পক্ষে উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসাবে যে ৭টি টেস্ট খেলেছেন, তাতে রেকর্ড এমন আহামরি কিছু নয়। ২৯.৯০ গড়ে ২৯৯ রান, ২টি হাফ সেঞ্চুরি, সর্বোচ্চ ৮৪। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংসটি ১৯২১ অ্যাশেজ সিরিজে ওয়ারউইক আর্মস্ট্রংয়ের পরাক্রান্ত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। প্রমত্ত দুই ফাস্ট বোলার জ্যাক গ্রেগরি ও টেড ম্যাকডোনাল্ডের সামনে থরহরিকম্পমান ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ধারাবাহিকতার গান ছিল একমাত্র তাঁর ব্যাটেই।

নাম তাঁর জর্জ ব্রাউন, অপরাজিত ১৭৬ রানে ম্যাচের নায়ক তিনিই। ছবি: হ্যাম্পশায়ার ক্রিকেট

টেস্টে বোলিংই করেননি। তবে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে রেকর্ড তাঁকে সেই সময়ের কাউন্টি ক্রিকেটে সেরা অলরাউন্ডারদের একজন হিসাবে চিনিয়ে দেয়। শুরু করেছিলেন ফাস্ট বোলার হিসাবে। পরে বলের গতি কমে এলেও উইকেট নেওয়ায় ভাটা পড়েনি। সংখ্যাটা ৬২৬-এর বেশি না হওয়ার কারণ ৬১২ ম্যাচের ১১২টিতে উইকেটকিপিং করেছেন। রান করেছেন ২৫,৬৪৯। হ্যাম্পশায়ারের হয়ে ষষ্ঠ উইকেট ছাড়া বাকি সব উইকেটেই সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ ছিল তাঁর। দু'তিনটি জুটির রেকর্ড এখনো সম্ভবত টিকে আছে। ফিল্ডার হিসাবেও ছিলেন দুর্দান্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব ক্রিকেটে (ক্যারিয়ার শুরু ১৯০৮ সালে) কাউন্টি ক্রিকেটে সেরা থ্রো তাঁর হাত থেকেই বেরোত। প্রাত:স্মরণীয় ক্রিকেট লেখক ও ধারাভাষ্যকার তাঁর সম্পর্কে যা বলেছিলেন, সেটি পড়ার পর আপনার মনে হতে বাধ্য, নিশ্চয়ই স্যার গ্যারি সোবার্সকে নিয়ে কথা হচ্ছে। 'খেলাটিতে এমন কিছু নেই, জর্জ ব্রাউন যা করতে পারতেন না...সেটিও করতেন দুর্দান্তভাবে।'

তবে শুধু রান, উইকেট আর ক্যাচ নয়, জর্জ ব্রাউন বেঁচে আছেন তাঁকে নিয়ে প্রচলিত অসংখ্য গল্পগাথায়ও। মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে সে সবে একটু রং চড়ে থাকতে পারে, তবে সেই 'খাদ'টুকু বাদ দিলেও 'সোনা'র পরিমান কম হবে না। কয়েকটি তাহলে বলেই বলি।

১৯১৩ সালে জর্জ ব্রাউন ২৬ বছরের টগবগে যুবক। পোর্টসমাউথে কেন্টের ফাস্ট বোলার আর্থার ফিল্ডারের সঙ্গে একটা কিছু নিয়ে লেগেছে। ফিল্ডার তখন কাউন্টির দ্রুততম বোলারদের একজন। বাউন্সারেই তাঁর জবাব দেওয়ার কথা। তা-ই দিলেন। আর জর্জ ব্রাউন কী করলেন? হাত থেকে ব্যাট ফেলে আর্থার ফিল্ডারের দিকে মুখ করে সটান দাঁড়িয়ে গেলেন। বল বুকে এসে লাগার পর ঘোষণা করলেন, 'হি ইজ নট ফাস্ট!' বাড়তি তথ্য হলো, সেই ইনিংসে ব্রাউন ৭১ রান করেছিলেন। পরের ইনিংসে ৫০।

যে ওয়ারউইকশায়ারের বিপক্ষে জর্জ ব্রাউনের সবচেয়ে বিখ্যাত ওই পারফরম্যান্স, আরেকবার সাউদাম্পটনে তাদের বিপক্ষেই ম্যাচ। অধিনায়ক লর্ড টেনিসন রাগ করেই হোক বা অন্য কোনো কারণে, তাঁকে ১০ নম্বরে ব্যাটিং করতে পাঠিয়েছেন। ক্ষুব্ধ ব্রাউন নামলেন ভাঙাচোরা একটা ব্যাট নিয়ে। ফাস্ট বোলার হ্যারি হাওয়েলের প্রথম বলেই সেটি এমনভাবে চালালেন যে, বল উইকেটকিপারের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পেছনের সাইট স্ক্রিনে গিয়ে পড়ল। ভাঙাচোরা ওই ব্যাট কতক্ষণ আর ওই তাণ্ডব সইবে! এক সময় তা ভেঙে দুই টুকরো। ব্রাউন নিচের অংশটা আম্পায়ারের হাতে দিয়ে বাকিটা দিয়েই ব্যাটিং করতে শুরু করলেন। বিশ্বাস করা একটু কঠিন, কিন্তু এতজনের কথায়/লেখায় তা পাচ্ছি যে, না করে উপায় কি!

জর্জ ব্রাউনের চেহারা-ছবির বর্ণনাটা সবার লেখাটাতেই অভিন্ন। লম্বায় ছয় ফুটের বেশি, উন্নত নাসা, যেন পাথরে খোদাই করা শরীর, দুই হাতে প্রচণ্ড শক্তি। এতই যে, এক প্যাকেট তাস নাকি খালি হাতেই ছিঁড়ে ফেলতে পারতেন। একবার কী নিয়ে ঝামেলা বাঁধায় ইয়র্কশায়ারের নামকরা এক ক্রিকেটারকে জ্যাকেট মুঠো করে ধরে এক হাতে শূন্যে তুলে ফেলেছিলেন। সেটিও খোলা প্যাঁচানো সিঁড়ির ছয় তলার মুখে। সেখান থেকে ফেলে দেওয়ার হুমকিতে দ্রুতই কলহ মিটে যায়।

প্রথাগত কিপিং গ্লাভসের পরিবর্তে উইকেটকিপিং করতেন মোটরসাইকেল চালানোর গ্লাভস পরে। আরও অদ্ভুত সব ব্যাপার ছিল তাঁর মধ্যে। মৃত্যুর পরও যেটির রেশ থেকে যায়। তাঁর দেহভস্ম ছড়িয়ে দেওয়া হয় হ্যাম্পশায়ারের মাঠ সাউদাম্পটনে। জর্জ ব্রাউন যে তা-ই চেয়েছিলেন!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×