একদিন গ্যারি গিলমোরের দিন...

উৎপল শুভ্র

১৮ জুন ২০২১

একদিন গ্যারি গিলমোরের দিন...

হেডিংলির সেমিফাইনালে ডেনিস অ্যামিসকে এলবিডব্লিউ করে ধ্বংসযজ্ঞের শুরু করেছিলেন গ্যারি গিলমোর। ছবি: গেটি ইমেজেস

ওয়ানডে ক্যারিয়ার মাত্র ৫ ম্যাচের। তবে এতেই গড়েছিলেন এমন এক কীর্তি, অনেকে যা গড়তে পারে না ২০০ ওয়ানডে খেলেও। একবার বোলিং ফিগারটায় চোখ বুলিয়ে দেখুন না: ১২ ওভার, ৬ মেডেন, ১৪ রান, ৬ উইকেট। ১৯৭৫ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলীয় পেসার গ্যারি গিলমোরের এই রোলিং বিশ্বকাপে তো বটেই ওয়ানডের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা বোলিং হয়ে আছে। ৭০ বছর আগে ঠিক আজকের দিনেই জন্মেছিলেন গ্যারি গিলমোর। জন্মদিনে গ্যারি গিলমোরের ওই বিস্ময়কর বোলিং-কীর্তি স্মরণ করাই যায়।

প্রথম প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি, ১৯৯৬। ভোরের কাগজ।

দর্শকরা লুফে নিয়েছিলই, ক্রিকেটের বিশ্বকাপের ব্যাপারটা প্রকৃতিরও পছন্দ হয়েছিল খুব। এ কারণেই ইংল্যান্ডে ’৭৫-এর জুন ছিল ব্যতিক্রমী, রোদ্রালোকে উজ্জ্বল। ইংল্যান্ডে দিনের পর দিন সূর্য এমন তীব্রভাবে নাকি বহুদিন জ্বলেনি। সচরাচর ইংল্যান্ডে যা হয়, উইকেট থাকে নরম, বল মুভ করে প্রচুর, তা হয়নি সেবার। বরং রোদে পুড়ে উইকেট হয়ে উঠেছিল শক্ত, স্ট্রোক প্লের উপযোগী এবং গ্রুপ ম্যাচগুলোতে ব্যাটসম্যানরা তার ফায়দাটাও তুলেছেন ভালোমতোই।

ইংলিশ কন্ডিশনের সঙ্গে বিশ্বকাপের প্রথম পরিচয় ঘটল সেমিফাইনালে এসে। দুটো সেমিফাইনালই হয়েছিল একই দিন, ১৮ জুন। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া লিডসের হেডিংলিতে প্রথম সেমিফাইনাল খেলতে এসে দেখতে পেল, উইকেট সবুজ ঘাসে ঢাকা, আকাশেও সেদিন মেঘ। বল যে অস্থিরভাবে নেচে বেড়াবে তা ছিল পরিষ্কার। টসটা ছিল তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হারল ইংল্যান্ড। ব্যাট করতে নেমে পড়ল তারা গ্যারি গিলমোরের তোপের মুখে। বাঁহাতি এই পেস বোলার বল সুইং করালেন ইচ্ছেমতো। তাতে ইংল্যান্ডের প্রথম সাত ব্যাটসম্যানের ৬ জনই পরিণত হলেন তাঁর শিকারে। ১২ ওভার, ৬ মেডেন, ১৪ রানে ৬ উইকেট—এমন অসাধারণ বোলিং এনালাইসিস গিলমোরের।

সে সময় এটাই ছিল ওয়ানডে ক্রিকেটে সেরা বোলিং পারফরম্যান্স। প্রায় আনপ্লেয়েবল হয়ে ওঠা গিলমোরের কারণে ৩৭ রানে ৭ উইকেট হারানো ইংল্যান্ড শেষ পর্যন্ত ৩৬.২ ওভারে অলআউট হয়ে যায় মাত্র ৯৩ রানে। মাইক ডেনেস (২৭) ও জন স্নো (১৮) ছাড়া আর কোনো ব্যাটসম্যান দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেননি। উইকেটের অবস্থাটা পরিষ্কার করে দিতে এই ৯৪ রানের টার্গেট তাড়া করতে নামা অস্ট্রেলিয়াও পড়ে ভয়াবহ বিপদে। মাত্র ৩৯ রানে পড়ে যায় তাদের ৬ উইকেট। আসলে এই দিনটি নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল গিলমোরের জন্য। তাই অসম দুর্দান্ত এক বোলিং পারফরম্যান্সের পর দুদলে এত ব্যাটসম্যানের ভিড়ের মধ্যেও ম্যাচের সর্বোচ্চ ইনিংস ৮ নম্বরে নামা গিলমোরের (অপরাজিত ২৮)। ডগ ওয়াল্টার্স (অপরাজিত ২০) ও গিলমোরের অসমাপ্ত সপ্তম উইকেটে ৫৫ রান তুলে টার্গেট ছুঁলেন মাত্র ২৮.৪ ওভারে। একটি ম্যাচকে কোনো নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের নামে চিহ্নিত করতে যাঁদের আপত্তি, তাঁরাও বোধ হয় এই ম্যাচটিকে ‘গিলমোরের ম্যাচ’ বললে কিছু মনে করবেন না!

ম্যাচের প্রথমার্ধ শেষে মাঠ ছেড়ে আসার সময গিলমোরের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন ডেনিস লিলিছ ছবি: গেটি ইমেজেস

তবে এই গ্যারি গিলমোর বোলারটি কিন্তু রীতিমতো এক রহস্য। বিশ্বকাপে মাত্র দুটো ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই সেমিফাইনালটি ছিল তাঁর প্রথম। ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয়টিতে তাঁর বোলিং ফিগার: ১২-২-৪৮-৫। বিশ্বকাপের ২ ম্যাচে ২৪ ওভার বোলিং করে ২৪ ওভার বোলিং করে ৬২ রান খরচে তাঁর অর্জন মোট ১১ উইকেট। মানতেই হবে, খুব একটা খারাপ নয়! বিস্ময়কর হলো, বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে এমন বোলিং করা বোলারটি ওয়ানডে খেলেছেন মাত্র ৫টি। ৫ ম্যাচে তাঁর অর্জন ১৬ উইকেট, উইকেটপ্রতি রান খরচা মাত্র ১০.৩১ রান। অস্ট্রেলিয়ার জন্য তো বটেই, ক্রিকেটের জন্যও  এ এক এমন ট্র্যাজেডিই বলতে হবে, অমিত প্রতিভাবান এই বোলারের ক্যারিয়ারের অকাল সমাপ্তি টেনে দেয় ইনজুরি।

গিলমোরের কথা বলতে বলতে আরেকটি সেমিফাইনালের কথা ভুলে যাওয়ার দশা হয়েছে। ওভালে অনুষ্ঠিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ-নিউজিল্যান্ড সেমিফাইনালটি নিয়ে অবশ্য বলারও খুব বেশি কিছু নেই। দু'দলের শক্তিতে যে বিশাল ব্যবধান, ফলাফলেও প্রতিফলিত হয়েছে তা। প্রায় ২০ ওভার অব্যবহৃত রেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জেতে ৫ উইকেটে। ম্যাচ শেষ হয়ে যায় প্রথমার্ধেই। ক্যারিবীয় পেসের সামনে ১৫৮ রানেই শেষ কিউই ইনিংস। ৮ রানে প্রথম উইকেট পড়ার পর গ্লেন টার্নার (৩৬) ও জিওফ হাওয়ার্থ (৫১) ৯০ রানের জুটি গড়ে একটা পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এরা দুজন আউট হয়ে যাওয়ার পর ব্যাটিংয়ে আর বলার মতো তেমন কিছু ঘটেনি। জুলিয়েন ২৭ রানে ৪ উইকেট নেন, হোল্ডার ৩০ রানে ৩টি। অ্যান্ডি রবার্টস ১৮ রানে ২টি এবং তখন প্রায় নিয়মিত বোলিং করা ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড নেন বাকি উইকেটটি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসে স্কোরবোর্ডে ৮ রান উঠতেই বাঁহাতি ওপেনার রয় ফ্রেডরিকসকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রিচার্ড হ্যাডলির বড় ভাই ডেড হ্যাডলি। কিন্তু এরপর সাফল্য পেতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নিউজিল্যান্ডকে। গর্ডন গ্রিনিজ (৫৫) ও অলভিন কালীচরনের (৭২) গড়া ১২৮ রানের পার্টনারশিপের প্রতিটি মুহূর্তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে লর্ডসের ফাইনাল। বাঁহাতি পেস বোলার রিচার্ড কলিঞ্জ অবশ্য দারুণ বোলিং করেচিলে, তাঁর কারণেই ১ উইকেটে ১৩৩ থেকে ৫ উইকেটে ১৫১ রানে পরিণত হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে শেষ পর্যন্ত কলিঞ্জের ২৮ রানে ৩ উইকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়টা একটু বিলম্বিত করা ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×