বিদ্রোহী রানাতুঙ্গার অন্য যুদ্ধ

উৎপল শুভ্র

২০ জুন ২০২১

বিদ্রোহী রানাতুঙ্গার অন্য যুদ্ধ

অর্জুনা রানাতুঙ্গা। ছবি: ব্লুমবার্গ

পুরোনো ক্লাব মোহামেডানের আমন্ত্রণে সস্ত্রীক ঢাকায় এসে তখনো হোটেলে চেক ইন করেননি। এর আগেই পুরোনো পরিচয়ের সুবাদে লবিতে দাাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই অর্জুনা রানাতুঙ্গার এই সাক্ষাৎকার। খেলোয়াড়ি জীবনেও যেটাকে ঠিক মনে রেখেছেন, তা বলতে দুবার ভাবেননি। খেলা ছাড়ার পর বদলানোর তো প্রশ্নই ওঠে না, বরং আইসিসি-আইপিএল-শ্রীলঙ্কান বোর্ড নিয়ে এমন সব বলেছিলেন, সাবেক ক্রিকেটারদের আরও অনেকে এমন ভাবলেও মুখে যা বলেন না।

প্রথম প্রকাশ: ১২ মে ২০১১। প্রথম আলো।

একটু কি মুটিয়ে গেছেন?

প্রশ্নটা শুনে তিনি হাসেন, ‘এই প্রশ্নটা তো সারা জীবনই শুনে আসছি।’

খেলোয়াড়ি জীবনেও ক্রিকেটার বলে মনে হতো না। চিরদিনই নাদুসনুদুস, সুযোগ পেলেই ‘রান’কে ‘ওয়াক’ বানিয়ে ফেলতেন—গ্যালারির দূরতম প্রান্ত থেকেও তাঁকে চিনতে কারও ভুল হতো না। এ নিয়ে অনেক রসিকতাও চালু ছিল।

শেন ওয়ার্ন বলে ফ্লাইট বাড়িয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাঁহাতি ব্যাটসম্যান টোপটা গিলছেনই না। উইকেটের পেছন থেকে ইয়ান হিলি চিৎকার করে বললেন, ‘গুড লেন্থে একটা মারস্ (চকলেট) ফেল্, ও ঠিকই বেরোবে।’

তাঁর ক্যারিয়ারের বড় একটা অংশজুড়ে অস্ট্রেলিয়ানদের সঙ্গে বৈরিতার ইতিহাস। অর্জুনা রানাতুঙ্গার কাছে এখন সে সব অতীতের ছেঁড়াখোঁড়া ছবি। পুরোনো ক্লাব মোহামেডানের উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে কাল সন্ধ্যায় সস্ত্রীক ঢাকায় পা রাখা শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের মহানায়কের চেতনা জুড়ে এখন অন্য এক ‘যুদ্ধ’। ‘আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত’ শ্রীলঙ্কার রাজনীতিকে শুদ্ধ করার যুদ্ধ।

সেটিতে এমনই আচ্ছন্ন যে, ক্রিকেটার পরিচয়টাকেও কখনো কখনো ছাপিয়ে যেতে চায় তাঁর রাজনীতিক সত্তা। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট নিয়ে কথা বলার সময় তাঁকে খুব চিন্তিত দেখায়, তার চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ। ‘শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটকে দুর্নীতি যেভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলছে, এভাবেই চললে শ্রীলঙ্কারও ওয়েস্ট ইন্ডিজ হতে আর বেশি দিন নেই’—বলার পরই সমস্যার আসল জায়গাটায় আঙুল রাখেন, ‘পুরো দেশ উচ্ছন্নে গেলে ক্রিকেট বোর্ড কি আর বাইরে থাকতে পারে? শুধু ক্রিকেট কেন, শ্রীলঙ্কার খেলাধুলাই ধ্বংস করে দিচ্ছে রাজনীতিকেরা।’

পুরোনো ক্লাব মোহামেডানের টানে সস্ত্রীক ঢাকায় এসেছিলেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা। সোনারগাঁও হোটেলের লবিতে। ছবি: শা. হ. টেংকু

‘রাজনীতিকেরা’ বলতে সরকারি দলের দিকেই রানাতুঙ্গার অভিযোগের তর্জনী। একসময় এই দলের অংশ ছিলেন তিনিও। মন্ত্রীও হয়েছিলেন। ‘উপমন্ত্রী হিসেবে তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম। কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতি সহ্য করতে পারিনি। সরকারে থেকেও দলের সমালোচনা করেছি, মন্ত্রীদের সমালোচনা করেছি। দলে থেকে এটা ভালো দেখায় না বলে বেরিয়ে এসে বিরোধী দলে যোগ দিয়েছি।’ মনস্থির করে ফেলেছিলেন আগেই। এলটিটিইর সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন। এরপর যোগ দিয়েছেন জেনারেল শরৎ ফনসেকার ইউনাইটেড ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সে। কারণ ফনসেকা 'সৎ লোক’, ‘তিনি নিজের আখের না গুছিয়ে দেশের ভবিষ্যতের কথা ভাবেন।’

বিরোধী দল থেকেই নির্বাচিত হয়েছেন সংসদে, যেটিকে রানাতুঙ্গা মনে করেন তাঁর ‘জীবনের সবচেয়ে বড় জয়’ বলে; ‘নতুন একটা দল, সেভাবে কেউ চেনে না। তার পরও মানুষ বিশ্বাস করে আমাকে ভোট দিয়েছে। আমি সেই আস্থার প্রতিদান দিতে চাই।’

শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটকে দুর্নীতিমুক্ত করার লড়াই তারই একটা অংশ। সংসদে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলতে যাচ্ছেন বলে জানালেন। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটকে তুলতে যাচ্ছেন আদালতেও। এ কারণেই ম্যাচ পাতানো নিয়ে হাশান তিলকারত্নের ফাটানো ‘বোমা’ প্রসঙ্গে ‘নো কমেন্টস’। সেই অভিষেক টেস্ট থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত খেলেছেন। তিলকারত্নের দাবি অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের শুরু থেকেই ম্যাচ পাতানো চলে এলে তাঁরই তো তা সবচেয়ে বেশি জানা থাকার কথা।

রানাতুঙ্গা আবারও চলে যান বৃহত্তর ছবিটার দিকে, ‘ক্রিকেটারদের দুর্নীতি নিয়ে আইসিসি এত হাঁকডাক করছে, অথচ শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের বর্তমান চেয়ারম্যান সোমাচন্দ্র ডি সিলভার পরিবারই তো বেটিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বোর্ড-প্রধানের বেটিং ব্যবসার সঙ্গে সংযোগ থাকলে খেলোয়াড়দের তো জড়িত করতেই পারেন। অথচ আইসিসি এ ব্যাপারে চোখ বুজে আছে।’

আইসিসির ব্যাপারে এমনই বিরক্ত যে, অনেকবারই ‘নখদন্তহীন বাঘ’ কথাটা ব্যবহার করলেন। কণ্ঠে তীব্র ক্ষোভ ফুটিয়ে বললেন, ‘আইসিসিতে সাবেক ক্রিকেটার কোথায়? আইসিসির কর্তাব্যক্তিরা হয় রাজনীতিক, নয় ব্যবসায়ী। ওদের কাছে ক্রিকেট যত না খেলা, তার চেয়ে বেশি ব্যবসা। অথচ ওরাই খেলাটা নিয়ে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আইসিসিতে কেন ইমরান খান, কপিল দেব, অ্যালান বোর্ডার, ক্লাইভ লয়েড, স্টিভ ওয়াহরা থাকবে না? ওরা খেলাটা খেলেছে, ওরা খেলাটাকে ভালোবাসে।’

আইপিএল নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জগাখিচুড়ি অবস্থার জন্যও আইসিসির বড় দায় দেখেন রানাতুঙ্গা। আইপিএলের ‘মধু’ খেয়ে ক্রিকেটের অনেক রথী-মহারথীই এর গুণগান গেয়ে যাচ্ছেন। রানাতুঙ্গা শুরু থেকেই উচ্চকণ্ঠ। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে নুড্লেসর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন সেই কবেই, এখনো তা-ই মনে করেন, ‘টেস্ট আর ওয়ানডে ক্রিকেট খেলোয়াড়দের “ক্যারেক্টার”টা বের করে আনে। টি-টোয়েন্টি তো গাধায়ও খেলতে পারে।’

শেন ওয়ার্নের সঙ্গে ছবিটাকে দেখনদারি সৌজন্য ভাবলেই ভালো

‘দেশ বনাম আইপিএল’ দ্বন্দ্বে আইপিএলকে গালমন্দ না করে রানাতুঙ্গা দেশগুলোকে দেখতে চান শক্ত অবস্থানে। তা করতে গিয়ে অবশ্য নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছে। ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কান বোর্ডের প্রধান হিসেবে আইপিএলের বদলে ইংল্যান্ড সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বড় ভূমিকা রেখেছিল তাঁর বিদায়ে। ‘খেলোয়াড়েরা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করার পর উনি আর ক্রীড়ামন্ত্রী তাদের আইপিএলে খেলতে দিতে বললেন। পরে নির্বাচনে সব ক্রিকেটারকে ব্যবহার করলেন প্রচারণার কাজে। শ্রীলঙ্কায় তো এই পারস্পরিক পিঠ চুলকানোই চলছে।’ প্রশাসক জীবন দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ার আরেকটা কারণও দেখেন রানাতুঙ্গা, ‘শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট ইতিহাসে ওই একটা বছরেই কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নেই। আমাদের ক্রীড়ামন্ত্রী, রাজনীতিকেরা ক্রিকেট থেকে টাকা নেন। আমি তা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।’

‘আপনার প্রিয় বন্ধু শেন ওয়ার্ন তো এখনো খেলে যাচ্ছেন’ বলে রাজনীতির মাঠ থেকে রানাতুঙ্গাকে ফেরানোর চেষ্টা করা হলো। ব্যঙ্গের হাসি খেলে গেল তাঁর মুখে, ‘খেলবে না, এখানে যে টাকা! আইপিএলের অনেক কোচকে দেখি আর ভাবি, এরাই না উপমহাদেশে খেলতে কত ওজর-আপত্তি তুলত। ইউএস ডলারের নোটের এমন জাদু, এটি দেখলে কোনো কিছুই আর সমস্যা মনে হয় না!’

না, অর্জুনা রানাতুঙ্গা সেই আগের মতোই আছেন। অকপট, বিদ্রোহী...শ্লেষাত্মক!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×