শক্তি ও সৌন্দর্যের খেলায় আইডল আজাদ আবুল কালাম

দুলাল মাহমুদ

২৫ জুন ২০২১

শক্তি ও সৌন্দর্যের খেলায় আইডল আজাদ আবুল কালাম

স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০-এ এমন সব ঘটনার কথা আসছে, অনেকেরই হয়তো তা অজানা। এমন সব ক্রীড়াবিদের কথাও, যাঁরা এক সময় নায়কের মর্যাদা পেয়েছেন, কিন্তু এখন তাঁদের স্মৃতিতে কালের ধুলো পড়েছে। আজকের পর্বটা এমনই একজনকে নিয়ে। ভারোত্তোলন আর শরীরগঠনে বছরের পর বছর অপ্রতিদ্বন্দ্বী আজাদ আবুল কালাম হয়ে উঠেছিলেন অনেকেরই `আইডল`।

সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ক্রীড়াবিদদের একজন আজাদ আবুল কালাম। সে সময়ের তারকা খেলোয়াড়দের যে মানদণ্ড ছিল, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ছিলেন অল্প কয়েকজনের মধ্যে একজন। ফুটবলের সেই রমরমা যুগে তিনি আলাদাভাবে নিজের অবস্থান গড়ে নেন। তখন তো মূলত দেশীয় ক্রীড়াঙ্গনে যাঁরা দাপট দেখাতে পারতেন, তাঁরাই ক্রীড়ানুরাগীদের হৃদয় জয় করে নিতেন। দেশের মানুষ তাঁদের এক নামে চিনতেন। তিনি ভারোত্তোলনের মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসলেও শরীরগঠনেও অন্য উচ্চতায় তুলে নেন নিজেকে। 

বলা যায়, বিপরীতধর্মী দুই খেলায় তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শক্তি ও সৌন্দর্যের খেলায় তাঁর পারদর্শিতা ছিল প্রশংসনীয়। সে সময় শারীরিক কসরত প্রদর্শন করে সবার নজর কাড়ার একটা হিড়িক পড়ে যায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম দৈহিক শক্তি, পেশী, সৌষ্ঠব ও সৌন্দর্য দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করতে চাইতেন। এলাকায় সমীহ আদায় কিংবা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ভারোত্তোলন ও শরীরগঠন চর্চার চল বেড়ে যায়। আর এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনেকের আইডল। বডিবিল্ডিং বা শরীরগঠন প্রতিযোগিতায় তাঁর ভঙ্গিমা, লালিত্য ও সুষমা দেখার জন্য ভিড় করতেন দর্শক।

শরীরগঠন, ভারোত্তোলনের মতো দৈহিক শক্তির খেলাগুলোর প্রচলন হওয়ার পিছনে জড়িয়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। ব্রিটিশ বিরোধী বৈপ্লবিক আন্দোলনের সময় গড়ে তোলা হয় শরীরচর্চার আখড়া। ব্রিটিশদের বিপক্ষে লড়াই করার জন্য সেই আখড়ায় শারীরিক কসরত ও লাঠি খেলা শেখানো হয়। তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে যুব সমাজকে শক্তি-সামর্থ্যে গড়ে তোলার জন্য শরীরচর্চার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সরকার সমর্থিত সন্ত্রাসী ও পেটোয়া বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য কুস্তি, শরীরগঠন, ভারোত্তোলনের মতো খেলার অনুশীলন, চর্চা ও পরিচর্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এর একটা নিবিড় সম্পৃত্ততা ছিল। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবেও শারীরিক ফিটনেস অটুট রাখার জন্য শক্তির খেলাগুলোর দিকে রাজনৈতিকভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়। ষাট দশকের সদর্থক এই প্রবণতা তরুণ প্রজন্মকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করে। পরবর্তীকালেও সেই রেশ রয়ে যায়।

আজাদ আবুল কালাম ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে খুলনায় বসবাসের সময় ছিলেন লাজুক কিশোর। সে সময় গ্রামের আখড়ার মস্তান ছেলেদের কাছে লাঞ্ছিত হন। দুর্বল শরীরের কারণে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এর প্রতিশোধ একদিন নেবেনই। বাংলা সিনেমায় সাধারণত যেমনটা দেখা যায়। তিনি প্রতিশোধ না নিলেও ঠিকই নন্দিত নায়ক হয়ে ওঠেন। তাঁর উত্থান অনেকটাই 'এলাম, দেখলাম, জয় করলাম'-এর মতো। ১৯৭৪ সালে জীবনে প্রথম ঢাকায় এসে তিন দিন অনুশীলন করে জাতীয় ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় খুলনার হয়ে অংশ নিয়ে বাজিমাত করেন। ৬৭.৫ কিলো বিভাগ লাইট ওয়েটে রেকর্ডসহ স্বর্ণপদক জয় করেন। তারপর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য নিরন্তর অনুশীলন চালিয়ে যান। 

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি)-এর হয়ে ১৯৭৬ সালে একই ওয়েটে শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন রাখেন। ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৮৬ সালে ৭৫ কেজি বিভাগ মিডল ওয়েটে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এর মধ্যে ১৯৮১, ১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৮৪ সালে বছরের শ্রেষ্ঠ লিফটার হিসেবে বিবেচিত হন। অসংখ্যবার রেকর্ড গড়েছেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে ৭০ কেজি মিডলওয়েটে এবং ১৯৮৭ সালে তৃতীয় সাফ গেমসে ৬৭.৫ কেজি লাইটওয়েটে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন।

জাতীয় শরীরগঠন প্রতিযোগিতায়ও তাঁর ওজন শ্রেণিতে আজাদ আবুল কালাম ছিলেন অপ্রতিম। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত লাইটওয়েট ৭০, মিডলওয়েট ৮০, ওয়াল্টার ওয়েট ৭৫ কেজি ক্যাটাগরিতে নয়বার ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ হওয়ায় গৌরব অর্জন করেন। বাটা শরীরগঠন প্রতিযোগিতায়ও যথারীতি সাফল্য পেয়েছেন। ১৯৭৭ সালে ভারতের কলকাতায় ১৩তম এশিয়ান শরীরগঠন প্রতিযোগিতায় লাইটওয়েট বিভাগে বেসরকারিভাবে চতুর্থ স্থান লাভ করেন। নির্ধারিত সময়ে প্রতিযোগিতায় নাম এন্ট্রি করতে না পারার কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়নি। কিন্তু দর্শকভর্তি নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে তাঁর দৈহিক কমনীয়তা, গঠন ও সৌন্দর্য দিয়ে সবাইকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেন। ১৯৭৯ সালে ফিলিপাইনে অনুষ্ঠিত ১৫তম এশিয়ান শরীরগঠন প্রতিযোগিতায়ও তিনি অংশ নেন। 

বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ১৯৭৭ সালে শরীরগঠনে, ১৯৮০ সালে ভারোত্তোলনে এবং ১৯৮১ সালে বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে তাঁকে নির্বাচিত করে। ২০০৬ সালে পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। খুলনায় তিনি গড়ে তুলেছেন আজাদ বডিবিল্ডিং অ্যান্ড ওয়েটলিফটিং জিমনেশিয়াম। এই জিমনেশিয়ামে তাঁর কাছে তালিম নিয়ে গড়ে ওঠছে নতুন প্রজন্মের বডিবিল্ডার ও ওয়েটলিফটার। তাঁর স্ত্রী বিটিএমসির সাবেক অ্যাথলেট শাহীন বেগম। তিনি জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ডিসকাস থ্রোতে বেশ কয়েকবার স্বর্ণপদক জয়ের পাশাপাশি শটপুটেও সাফল্য পেয়েছেন। ছোট ভাই সাবেক ফুটবলার সালাম মুর্শেদী। এসবই বাহ্য। আজাদ ছিলেন নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। সেই উজ্জ্বলতা দিয়ে আলোকিত করছেন পরিপার্শ্বকে।

দৈহিক গড়ন, শক্তি ও সৌন্দর্য দিয়ে আজাদ আবুল কালাম তরুণ প্রজন্মকে যেভাবে বিমোহিত ও আকৃষ্ট করেন, তা তুলনারহিত। তবে তিনি এমন সময় শরীরকে সৌন্দর্য সাধনা ও উপাসনার অর্ঘ্য করে তোলেন, যখন চারপাশে শারীরিক শক্তি দিয়ে সব কিছু অর্জনের একটা ঝোঁক সমাজকে পীড়িত করছিল। শক্তিমত্তা ও দাপট দিয়ে প্রতিপক্ষকে হয়তো ভয় দেখানো যায়, কিন্তু শরীরের পেশী ও সৌন্দর্য দিয়েও যে তাঁদের মন জয় করা যায়, এটা তিনি বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন। তাঁর ছিল মানুষের মন জয় করার জীবনদর্শন। সেটা তিনি যথাযথভাবে করতে পেরেছিলেন। এ কারণেও বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে তাঁর নামটা আলাদাভাবে উচ্চারিত হয়।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×