এখনো এক এবং অনন্য বক্সার মোশারফ 

দুলাল মাহমুদ

১০ জুলাই ২০২১

এখনো এক এবং অনন্য বক্সার মোশারফ 

এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের স্বর্ণ ও রৌপ্যপদকও আছে। তবে তা দলীয় খেলা ক্রিকেট ও কাবাডিতে। ব্যক্তিগত পদক একটাই, যা জিতে বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন বক্সার মোশারফ হোসেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলার ৫০ সিরিজে আজ এই কীর্তিমানের কথা।

তখন দক্ষিণ এশিয়ান পর্যায়ে কোনো পদক জিততে পারলেই বর্তে যেত বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা। সেটাই ছিল তাঁদের কাছে অনেক বড় সাফল্য। মূলত তাঁদের স্বপ্নের সীমারেখা ছিল এই চৌহদ্দির মধ্যেই। এর বাইরে পদক জিততে চাওয়ার দুঃসাহস ছিল না বললেই চলে। যদিও খুব বেশি না হলেও বড় বড় আন্তর্জাতিক আসরে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। বলতে গেলে সেখানে মূলমন্ত্রই ছিল, জয় নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা। যে কারণে অভিজ্ঞতা সংগ্রহের জন্য নিয়মিতই তাঁরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। তাতে পদক জয়ের আশা থাকত না। সঙ্গত কারণে পদকও মিলত না। এই রীতি ভেঙে দেন বক্সার মোশারফ হোসেন। বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে এশিয়ান গেমসে পদক জয় করেন। যদিও তাঁর আগে নির্দিষ্ট খেলায় এশিয়ান পর্যায়ের কেউ কেউ পদক জিতেছেন। তাঁদের মধ্যে বক্সার আছেন, সাঁতারু আছেন, জুডোকা আছেন। কিন্তু এশিয়ান গেমসে পদক জয়ের সঙ্গে সেসবের তুলনা হয় না। 

১৯৮৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে লাইট হেভিওয়েট ৮১ কেজি বিভাগে ভারতের ধ্যান বাহাদুর গুরুঙের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। ধ্যান বাহাদুর পদক পেয়েছেন ওয়াক ওভার পেয়ে। মোশারফকে লড়াই করে অর্জন করতে হয়েছে। ২৮ সেপ্টেম্বর কোয়ার্টার ফাইনালে নেপালের দুর্বালাল শ্রেষ্ঠকে হারালে তাঁর পদক নিশ্চিত হয়ে যায়। ম্যাচ শুরুর ৩৮ সেকেন্ডের মধ্যে প্রতিপক্ষের ডান চোখের কোণায় তিনি ঘুষি মারেন। তা সামলাতে না পেরে দুর্বালাল পড়ে যান। রেফারি সময় কাউন্ট করতে থাকলে তিনি নির্ধারিত সময়ে উঠতে ব্যর্থ হন। রেফারি মোশারফের হাত উঠিয়ে বিজয়ী ঘোষণা করেন। ২৮ বছর বয়সী বক্সার মোশারফ নতুন এক মাইলফলক গড়েন। দশম এশিয়াডের বক্সিংয়ে এটি ছিল দ্রুততম জয়। কিন্তু সেমিফাইনালে তৃতীয় রাউন্ডে পাকিস্তানের হোসেন শাহ’র কাছে হেরে যাওয়ায় তিনি রৌপ্যপদক জিততে পারেননি। প্রতিপক্ষের একটি ঘুষি আচানক তাঁর মুখে লাগলে তিনি কাহিল হয়ে যান। অথচ ফাইনালে প্রথম রাউন্ডেই কোরিয়ার প্রতিযোগীর কাছে হেরে যান হোসেন শাহ।

বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে এশিয়ান গেমসে মোশারফের পদক জয়ের কীর্তি এখনো জ্বলজ্বল করে। কারণ এরপর কাবাডি ও ক্রিকেট দল পদক জিতলেও ব্যক্তিগতভাবে আর কেউ পদক জিততে পারেননি। এশিয়ান গেমসে মোশারফ হয়ে আছেন আমাদের একমাত্র ধ্রুবতারা। ভীতু হিসেবে বাঙালির বদনাম খানিকটা হলেও ঘুচিয়েছেন তিনি।

শারীরিক শক্তির খেলায় ভেতো বাঙালির বলার মতো তেমন কোনো নেই বললেই চলে। আর বক্সিং বা মুষ্টিযুদ্ধের মতো শারীরিক সংঘাতমূলক খেলায় পারঙ্গমতা বা দক্ষতার কথা খুব একটা জানা যায় না। যদিও ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে, মহাকাব্যে ও পুরাণে এই খেলার উল্লেখ পাওয়া যায়। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে কোনো কোনো মুষ্টিযোদ্ধার সুখ্যাতির কথা শোনা যায়। আধুনিক বক্সিংয়ের প্রবর্তন হওয়ার পর উপমহাদেশের তেমন সাফল্য নেই। ভারত ও পাকিস্তানের কেউ কেউ এশিয়ান এমনকি অলিম্পিক পর্যায়ে পদক পেয়েছেন। সেটাও কালেভদ্রে। সামগ্রিকভাবে বক্সিংয়ে উপমহাদেশের মোটেও জয়জয়কার নেই। আর বাঙালি বক্সারদের দৈন্যদশা তো আরও স্পষ্ট।  

বক্সিং রিংয়ের লড়াইয়ে সাহসের পরিচয় দিতে না পারলেও বাইরে থেকে গলা ফাটাতে বাঙালির জুড়ি নেই। বক্সিংয়ের প্রতি রয়েছে তাঁদের তীব্র আকর্ষণ। কোথাও খেলা হলে তো বটেই, নতুবা টেলিভিশনে এই খেলাটির দর্শক নেহাৎ কম নয়। তবে এ অঞ্চলে বক্সিংকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে বক্সার মোহাম্মদ আলীর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। ষাট ও সত্তর দশকে তাঁর লড়াই ও লড়াকু ভূমিকার জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হন। জো ফ্রেজিয়ার, জো বাগনার, জর্জ ফোরম্যান, লিওন স্পিংকস প্রমুখ বক্সারের সঙ্গে আলোচিত লড়াইগুলো টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হলে তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছয়। ১৯৭৮ সালে সপরিবারে বাংলাদেশ সফরে আসার পর তিনি এ দেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন। অনেক কিশোর-তরুণের আইডল হয়ে ওঠেন তিনি৷ বক্সিংয়ের প্রতি অনেকেই আকৃষ্ট হন। তাঁদের একজন মোশারফ। অবশ্য আলী এ দেশে পা রাখার আগেই টেলিভিশনে তাঁর লড়াই দেখে তিনি উদ্বুদ্ধ হন। ১৯৭৪ সালে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন জর্জ ফোরম্যান এবং মোহাম্মদ আলীর মধ্যেকার 'দ্য রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল' খ্যাত ঐতিহাসিক বক্সিং ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। বিংশ শতকের আলোচিত এই লড়াইয়ে বিস্ময়করভাবে জয়ী হন মোহাম্মদ আলী। টেলিভিশনে দেখা সেই লড়াই মোশারফকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। তারপর থেকে মোহাম্মদ আলী হয়ে ওঠেন তাঁর আইকন।

আশির দশকের গোড়ায় বক্সিংয়ে দীক্ষা নেন রাজশাহীর সন্তান মোশারফ। অনেকটা জেদের বশে এ খেলাটিকে বেছে নেন। একটা গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ায় আত্মরক্ষা ও নিজেকে শক্তিমান হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যম হয়ে ওঠে বক্সিং। তারপর সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ায় তাঁর এগিয়ে যাওয়ার পথ আরেকটু সুগম হয়। বুকের মধ্যে ভরসা হয়ে উৎসাহ যোগান মোহাম্মদ আলী। ১৯৮১ সালে আমন্ত্রণমূলক বক্সিং টুর্নামেন্টে লাইট হেভিওয়েট ১৭৮ পাউন্ড দিয়ে শুরু হয় জয়যাত্রা। তাতে প্রথম হন। ১৯৮২ সাল থেকে জাতীয় বক্সিং প্রতিযোগিতায় আধিপত্য বিস্তার করেন। লাইট হেভিওয়েট ১৭৮ পাউন্ডে জয় করেন স্বর্ণপদক। ১৯৮৪ সালে লাইট হেভিওয়েট ৮১ কেজি, ১৯৮৫ সালে লাইট হেভিওয়েট ১৭৮ পাউন্ড, ১৯৮৬ সালে লাইট হেভিওয়েট ৮১ কেজি, ১৯৮৭ সালে লাইট হেভিওয়েট ১৭৯ পাউন্ড, ১৯৮৮ সালে লাইট হেভিওয়েট ১৭৮ পাউন্ডে স্বর্ণপদক জয় করেন। 

মোশারফ প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেন ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে। তাতেই বাজিমাত করেন। ২৪ ডিসেম্বর হেভিওয়েট ৯১ কেজি ক্যাটাগরিতে পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইউসুফকে প্রথম রাউন্ডে পাঞ্চ করলে তিনি পড়ে যান। পুনরায় উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নকআউট করে জয় করেন স্বর্ণপদক। এটি ছিল কোনো বাঙালি বক্সারের প্রথম স্বর্ণপদক জয়। ১৯৮৭ সালে কলকাতা এবং ১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদের সাফ গেমস লাইট হেভিওয়েট ক্যাটাগরিতে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন তিনি।  

১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা বক্সার ও ১৯৮৬ সালে বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ, ১৯৮৭ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এবং ১৯৯৯ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন মোশারফ।

প্রায় ৩৫ বছর আগে এশিয়ান গেমসে পদক জয় করে মোশারফ হোসেন বাংলাদেশকে যে উচ্চতায় নিয়ে যান, এরপর আর কেউ ব্যক্তিগতভাবে তা অতিক্রম করতে পারেননি। এমন গৌরব নিশ্চয়ই তাঁকে পীড়া না দিয়ে পারে না। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনেও এটা হয়ে আছে অনন্ত এক আক্ষেপ।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×