`মারাকানাজো` এবং আলসিদেস গিঘিয়া

উৎপল শুভ্র

১৬ জুলাই ২০২১

`মারাকানাজো` এবং আলসিদেস গিঘিয়া

১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই `মারাকানাজো`র মঞ্চ: দর্শক উপচে পড়া মারাকানা স্টেডিয়াম

ম্যাচটি হয়েছিল ১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই। শুধু এই তারিখটাই নয়, দুঃস্বপ্নটা দেখা দেওয়ার সময়টাও প্রায় সব ব্রাজিলিয়ানেরই জানা। বিকেল ৪টা ৩৩ মিনিট। বল পায়ে অনেকটা দৌড়ে ব্রাজিলের বক্সে ঢুকে শট নিলেন গিঘিয়া। গোওওওওওল! `মারাকানাজো`র রচয়িতা উরুগুয়ের সেই গিঘিয়াকে দেখে ব্রাজিলিয়ানদের সেই চিরকালীন দুঃস্বপ্নের বিকেলে ফিরে যাওয়া।

বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কখনোই অলিম্পিকের মতো সাড়ম্বর কোনো আয়োজনের নাম নয়। ২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপে এর ব্যতিক্রম হয়েছিল ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের কারণে। খেলোয়াড়ের ভূমিকায় বিশ্বকাপ জিতেছেন (১৯৭৪ সালে জার্মানিতেই), জিতেছেন কোচ হিসেবেও (১৯৯৩ সালে ইতালিতে) ব্রাজিলের মারিও জাগালো ছাড়া আর কারও এই কীর্তি নেই—বিশ্বকাপজয়ীর মহিমা বেকেনবাওয়ারের চেয়ে বেশি আর কে বুঝবে।

তা বুঝেই বেকেনবাওয়ারের মাথা থেকে এমন এক পরিকল্পনা এসেছে, যা নাচ-গান, স্বাগতিক দেশ ও শহরের সংস্কৃতির প্রতীকী উপস্থাপনা—যেকোনো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিয়মিত এসবের ভিড়েও আলাদা করে দিয়েছে ২০০৬ বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটিকে। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বকাপজয়ী সব খেলোয়াড়কে একসঙ্গে করতে পারার চেয়ে মহত্তম আর কী হতে পারে! ১৯৩০ সাল থেকে ধরলে বিশ্বকাপজয়ীর সংখ্যা চার শ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু তাঁদের অনেকেই যে বিশ্বকাপ-টিশ্বকাপের মতো জাগতিক সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। অনেকে এই জগতে থেকেও নানা কারণে আসতে পারেননি। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হলো, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকবেন ১৫২ জন বিশ্বকাপজয়ী।

শুরুটা হলো ১৯৬৬ বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ডের ১০ খেলোয়াড়কে দিয়ে। এর পর একে একে মাঠে ঢুকল ইংল্যান্ডের মতোই একবার বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স, দুবারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা, তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালি ও জার্মানি। সবশেষে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। সংখ্যাতেও সবচেয়ে বেশি ব্রাজিলিয়ানরাই, ৩৯ জন। সবচেয়ে কম উরুগুইয়ানরা, ২ জন।

১৯৩০ সালে ইতিহাসেরই প্রথম বিশ্বকাপটি জিতেছিল উরুগুয়ে, সেই দলের কেউই বেঁচে নেই। ১৯৫০ সালে উরুগুয়ের দ্বিতীয় বিশ্বকাপজয়ী দলের অনেকেই আছেন, তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এলেন তাঁদের মাত্র দুজন। তাদের একজনকে দেখেই চিনলাম। আলসিদেস এদগার্দো গিঘিয়া। ১৯৫০ বিশ্বকাপের নায়ক। উরুগুইয়ানদের কাছে নায়ক। ব্রাজিলিয়ানদের কাছে অবশ্য চিরন্তন এক খলনায়ক। এই গিঘিয়াই যে ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় জাতীয় ট্র্যাজেডিটির জন্মদাতা।

১৯৫০ বিশ্বকাপের ওই শেষ ম্যাচ নিয়ে এত পড়েছি, গিঘিয়ার এত ছবি দেখেছি যে, তারায় তারায় খচিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের মার্চপাস্টের সময় আমার চোখ আটকে থাকল গিঘিয়ার ওপরই। বয়স আর দারিদ্র্য ভালোই ছাপ ফেলেছে; অবাক হয়ে ভাবছিলাম, মুখে ভাঁজ, ছোটখাটো এই লোকটিই স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন মারাকানার প্রায় দুই লাখ দর্শককে। ওই ম্যাচের কিছুদিন পর গিঘিয়া নিজেই বলেছিলেন, 'মাত্র তিনজন লোকই মুহূর্তের মধ্যে মারাকানাকে নীরব করে দিতে পেরেছে। ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, পোপ দ্বিতীয় জন পল আর আমি।'

১৯৫০ বিশ্বকাপটি হয়েছিল অদ্ভুত নিয়মে। ইতিহাসে এই একটিই বিশ্বকাপ, যাতে কোনো ফাইনাল ছিল না। বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর প্রথম এই বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল ১৩টি দল। টুর্নামেন্টের ওই অভূতপূর্ব ও অনন্য ফরম্যাট হয়েছিল আয়োজক ব্রাজিলের পীড়াপীড়িতেই। চার গ্রুপে খেলা হওয়ার পর চার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন খেলবে চূড়ান্ত রাউন্ডে। সেখানে চার দল পরস্পরের সঙ্গে খেলার পর চ্যাম্পিয়ন হবে শীর্ষে থাকা দলটি। ব্রাজিল ও উরুগুয়ের সঙ্গে চূড়ান্ত পর্বে উঠেছিল সুইডেন ও স্পেন। এই দু দলকে ৭-১ ও ৬-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে রীতিমতো অপরাজেয় রূপে দেখা দিল ব্রাজিল।

অন্য দিকে উরুগুয়ে স্পেনের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করার পর সুইডেনকে ৩-২ গোলে হারাল বটে, তবে সেটি শেষ ১৪ মিনিটে দু গোল করে। ১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই মারাকানায় ব্রাজিল ও উরুগুয়ে যখন শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হলো, ফাইনাল না হয়েও সেটি হয়ে গেল অলিখিত ফাইনাল। পার্থক্য হলো, শিরোপা জিততে ব্রাজিলের ড্র করলেই চলে, উরুগুয়ের চাই জয়। সেদিন বিকেলে টিকিট কেটে যে ১,৭৩,৮৫০ জন দর্শক মারাকানায় এসেছিল (যেকোনো খেলাতে এটি এখনো বিশ্ব রেকর্ড, সাংবাদিক-সংগঠক-অতিথি মিলিয়ে স্টেডিয়ামে ছিল প্রায় দুই লাখ লোক), তারা উৎসবের প্রস্তুতি নিয়ে নয়, উৎসব করতে করতেই ঢুকেছিল। জয়ের ব্যাপারে ব্রাজিলিয়ানরা এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, পত্রপত্রিকাগুলোও নিয়ম ভেঙে আগাম খবর ছেপে ফেলেছিল। ফাইনালের আগের দিনই সাও পাওলোর গাজেতা এসপোর্তিভার প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম হয় 'টুমরো উই উইল বিট উরুগুয়ে!' রিও'র পত্রিকা ও মুন্দো ম্যাচের দিন ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়দের ছবি ছেপে ঘোষণা দিয়ে দেয় 'দিজ আর দ্য ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নস'। রিও'র মেয়র ম্যাচের আগেই 'বিজয়ী' বীরদের স্যালুট জানিয়ে ফেলেন।

১৯৫০ বিশ্বকাপে মারাকানায় শেষ ম্যাচের আগে দুই অধিনায়ক ব্রাজিলের অগাস্তো (বাঁয়ে) ও উরুগুয়ের অবদুলিও ভারেলা। ছবি: অ্যালেক্স বেলোসের `ফুটেবল` বই থেকে

গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ফ্রিয়াকা ব্রাজিলকে এগিয়ে দিলে সবকিছু পাণ্ডুলিপি অনুযায়ীই এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল। মারাকানায় তখন উৎসব শুরু হয়ে গেছে। ৬৬ মিনিটে গিঘিয়ার ক্রস থেকে শিফিয়ানো গোল করে সমতা আনার পর স্তব্ধতা নেমে এল স্টেডিয়ামে। তবে সব শেষ হয়ে যাওয়ার মতো কোনো অনুভূতি তখনো জাপটে ধরেনি দর্শকদের। ব্রাজিলের যে ড্র হলেই হয়। এই ম্যাচটি হয়েছিল ১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই। শুধু এই তারিখটাই নয়, দুঃস্বপ্নটা দেখা দেওয়ার সময়টাও প্রায় সব ব্রাজিলিয়ানেরই জানা। বিকেল ৪টা ৩৩ মিনিট। বল পায়ে অনেকটা দৌড়ে ব্রাজিলের বক্সে ঢুকে শট নিলেন গিঘিয়া। গোওওওওওল!

সম্ভবত বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত গোল। আর ব্রাজিলের ইতিহাসে ফুটবল ছাপিয়ে সর্বজনীন এক জাতীয় ট্র্যাজেডি। এই গোল নিয়ে ব্রাজিলিয়ান ক্রীড়া লেখক জোয়াও ম্যাক্সিমোর লেখার এই অংশটা মনে গেঁথে আছে: ‘Gigghia's goal was received in silence by al the stadium. But it's strength was so great, it's impact so violent, that the goal, one simple goal, seemed to divide Brazilian life in two distinct phases before it and after it. (.....গিঘিয়ার গোলকে নীরবতা দিয়ে বরণ করল পুরো স্টেডিয়াম। কিন্তু এমনই এর শক্তি, এমনই বিধ্বংসী এর প্রভাব যে, একটি গোল, শুধুই একটি গোল যেন ব্রাজিলের ইতিহাসকে পরিষ্কার দুটি ভাগে বিভক্ত করে দিল এর আগে ও পরে)। এই ম্যাচ নিয়ে ব্রাজিলে কত লেখা হয়েছে তার তো কোনো হিসাবই নেই। এ নিয়ে ছোটগল্প আছে, সেই ছোটগল্প অবলম্বনে শর্ট ফিল্ম হয়েছে।

বইও লেখা হয়েছে বেশ কটি, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত পাওলো পারডিগাও’র এনাটমি অব ডিফিট। এতে গিঘিয়ার গোলটি যে শুধুই একটি গোল নয়, সেটির চমৎকার ব্যাখ্যা আছে, 'It continues being the most famous goal in the history of Brazilian football...because none other transcended its status as a sporting fact...converting itself into a historic moment in the life of a nation."

ব্রাজিলিয়ান ঔপন্যাসিক কার্লোস হেইটর কনি তো গোলটির স্মরণে স্মৃতিসৌধের মতো কিছু গড়ার প্রস্তাবও রেখেছিলেন, 'Survivors of that cruel afternoon believed they would never be able to be happy...what happened on July 16 1950 deserves a collective monument, like the Tomb of the Unknown soldier. These are the things that build nations, a people drenched in their own pain.

গিঘিয়ার শট, গোল এবং বারবোসার নারকীয় এক জীবনের শুরু। ছবি: অ্যালেক্স বেলোসের `ফুটেবল` বই থেকেসেই বেদনা ব্রাজিলিয়ানরা এখনো ভোলেনি। ওই ম্যাচের সময় যাদের জন্ম হয়নি, তারাও না! ২০০০ সালে রিওতে গিয়েছিলেন গিঘিয়া। বিমানবন্দরে কাস্টমস চেকের জন্য পাসপোর্ট দেওয়ার পর তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে অ্যালেক্স বেলোসের 'Futebol' বইয়ে। ঘটনাটা গিঘিয়ার জবানিতেই শোনা যাক : মেয়েটির বয়স ২৩-২৪ হবে। সে আমার পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে বারবার আমার দিকে তাকাতে লাগল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কোনো সমস্যা?'

সে উত্তর দিল: 'আপনি কি সেই গিঘিয়া?'

'আমিই সে' বিস্মিত হয়ে বললাম আমি। মেয়েটি এত কমবয়সী! তাকে বললাম, '১৯৫০ তো অনেক দিন আগের কথা।'

সে তার বুকে হাত রেখে আমাকে বলল, 'ব্রাজিলে প্রতিদিনই আমরা এটি হৃদয়ে অনুভব করি।'

এরপর গিঘিয়া যা বলেছেন, সেটিই বোধ হয় সত্যি—'মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি বোধ হয় ব্রাজিলের ভূত। ওদের স্মৃতিতে আমি সব সময়ই হাজির।'

গিঘিয়ার সঙ্গে একটু কথা বলার ইচ্ছে ছিল। বিষয় হতো অবশ্যই ১৯৫০ সালের ওই ম্যাচ। তবে শুনেছি, গিঘিয়া এ নিয়ে কথা বলতে উৎসাহী নন। আগ্রহী শ্রোতাদের বলেন, ‘সারা জীবন তো এ নিয়েই কথা বলে গেলাম। আর কত?' ১৯৫০ বিশ্বকাপের পর ইতালিতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে খেলেছেন রোমা ও মিলানে। ইতালি জাতীয় দলের পক্ষেও খেলেছেন ৪টি ম্যাচ। ১৯৭০ সালে উরুগুয়েতে ফিরেই অবশ্য খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানেন। তখন তাঁর বয়স ৪২। ওই একটি গোলই ফুটবল ইতিহাসে অমরত্ব দিয়েছে তাকে, তবে অবসর-পরবর্তী স্বচ্ছন্দ জীবনের নিশ্চয়তা দেয়নি বলেই পড়েছি কোথাও। কে জানে, গিঘিয়ার কাছে তা ব্রাজিলিয়ানদের অভিশাপের ফল বলে মনে হয় কি না!

অভিশাপ সবচেয়ে বেশি দেওয়ার কথা বারবোসার। গিঘিয়ার ওই গোলের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী যে তিনিই। ওই একটা গোলই দুর্বিষহ করে তুলেছিল ১৯৫০ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের গোলরক্ষকের বাকি জীবন। সাংবাদিকদের ভোটে ওই বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষকের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, অথচ এরপর জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র একবার। ১৯৫০ আমৃত্যু তাড়া করে বেড়িয়েছে তাঁকে। সতীর্থরাও একরকম বর্জনই করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে ব্রাজিল দলের ক্যাম্পে গিয়েছিলেন খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলতে, 'দুর্ভাগ্য বয়ে আনবেন' বলে তাঁকে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি।

২০০০ সালের এপ্রিলে কপর্দকহীন অবস্থায় মারা যাওয়ার আগে বারবোসা জানান, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনাটি ঘটেছিল ওই ফাইনালের বিশ বছর পর। একটা দোকানে তাঁকে দেখে এক ভদ্রমহিলা তার ছেলেকে বলেন, 'লোকটিকে দেখো। এই লোকটিই পুরো ব্রাজিলকে কাঁদিয়েছে।' বারবোসা সব সময়ই দুঃখ করে বলতেন, 'ব্রাজিলিয়ান আইনে কারও সর্বোচ্চ ত্রিশ বছর জেল হয়। আর আমার জেল হয়েছে পঞ্চাশ বছরের।'

(লেখকের 'বিশ্ব যখন ফুটবলময়' বই থেকে)

আরও পড়ুন:

৭-১ গোলের সেই 'মিনেরেইজো'
অবিশ্বাসে আচ্ছন্ন ব্রাজিল

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×