আমিনুল ইসলাম বুলবুলের একান্ত সাক্ষাৎকার। পর্ব-৩

`অধিনায়কত্ব আমার ব্যাটিংয়ের ক্ষতি করছে, কথাটা আগে কেন মনে হলো না?`

উৎপল শুভ্র

১২ মে ২০২১

`অধিনায়কত্ব আমার ব্যাটিংয়ের ক্ষতি করছে, কথাটা আগে কেন মনে হলো না?`

মূলত অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরির সৌজন্যে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ২০০০ সালের প্রথম আলো বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের। এই উপলক্ষে নেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের তৃতীয় পর্ব মূলত অধিনায়কত্ব নিয়ে। বাংলাদেশ দলে যেসব অধিনায়কের নেতৃত্বে খেলেছেন, তাঁদের সম্পর্কে মূল্যায়ন, তাঁর নিজের অধিনায়কত্ব দর্শন, বিশ্বকাপে অমন সাফল্যের পরও অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া...এমন সব প্রসঙ্গ।

প্রথম প্রকাশ: ৭ জানুয়ারি ২০০১। প্রথম আলো।

শুভ্র: আপনার অধিনায়কদের কথায় আসি। যাঁদের নেতৃত্বে আপনি খেলেছেন, তাঁদের মূল্যায়ন করতে বলা হলে কী বলবেন?

আমিনুল: আমার প্রথম অধিনায়ক ছিলেন গাজী আশরাফ লিপু। তিনি ছিলেন খুবই ফ্রেন্ডলি। বয়সে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও তিনি আপন করে নিয়েছিলেন আমাকে। অনেক সাহায্য করেছেন আমাকে। এছাড়া তাঁর ছিল দারুণ উপস্থিত বুদ্ধি এবং বাংলাদেশে ওই সময়ের সেরা অধিনায়ক বলব আমি তাঁকেই। মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর অধিনায়কত্বে খুব বেশি দিন জাতীয় দলে খেলিনি। কারণ, তাঁর সময়ে খুব বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলিনি আমরা। তবে মোহামেডানে তাঁকে অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছি বছর তিনেক। মন্তব্য করার মতো তেমন কিছু ঘটেনি তাঁর সময়। আকরাম খান বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়ক। শুধু লাকি নয়, একই সঙ্গে যথেষ্ট পজিটিভ চিন্তাভাবনাও করত সে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে দেখিনি কখনো ওকে। যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। তার আমলে আইসিসি ট্রফি, এসিসি ট্রফি জয়, ভারত ‘এ’ টিমকে হারানোর মতো সাফল্য পেয়েছি আমরা। আবাহনীর অধিনায়ক হিসেবেও সে বেশ সফল। এরপর ফারুক ভাইয়ের কথা বলব। আমার দুঃসময়ে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন আমাকে। আমাকে স্পিনার বানানোর কৃতিত্বও তাঁর। তবে অধিনায়ক হিসেবে ভাগ্য তাঁর সহায় হয়নি। যতটা সময় তাঁর অধিনায়কত্ব করার কথা ছিল, তা তিনি করতে পারেননি। এ ছাড়া বাংলাদেশও খুব একটা ভালো খেলনি তাঁর সময়ে। তবে লিপু ভাইয়ের মতোই তিনি যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করতেন, তাঁর আ্যাপ্রোচও ছিল ইতিবাচক। সার্বিকভাবে যে ক'জন অধিনায়ক আমি পেয়েছি, তাঁদের সবাই ছিলেন ভালো। আমি ভাগ্যবান তাঁদের নেতৃত্বে খেলতে পেরে।

শুভ্র: আপনার অধিনায়কত্বের সময়ে আসি। প্রথম যখন অধিনায়ক হওয়ার খবর পেলেন, কেমন লেগেছিল? এটা কি প্রত্যাশা করেছিলেন তখন?

আমিনুল: অধিনায়ক হওয়াটা আমার কাছে মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। যেহেতু তখন ভাইস ক্যাপ্টেন ছিলাম, তাই পরবর্তী অধিনায়ক হওয়ার কথা আমারই। তবে অধিনায়ক হওয়ার খবরটা যখন পেলাম, সেই মুহূর্তটা উপভোগ করতে পারিনি। কারণ আকরাম ছিল আমার রুমমেট। টেলিফোনে রোকনের (আল-শাহরিয়ার রোকন) কাছ থেকে প্রথম খবরটা পাই যে, আমি অধিনায়ক হয়েছি। ওদিকে আকরাম তখন মুখ ভার করে বসে আছে। অধিনায়কত্বই শুধু যায়নি, ও বাদ পড়েছে দল থেকেও। তাই তাকে সান্ত্বনা দেওয়াটাই সেই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বড় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সব মিলিয়ে খবরটা বড় কিছু ছিল না আমার কাছে।

এই সাক্ষাৎকারের জন্য তোলা বুলবুলের ছবি

শুভ্র: অধিনায়কত্বটা কি আপনি সত্যি উপভোগ করেছেন? পুরো সময়টা তো খুব চাপে ছিলেন?

আমিনুল: আসলে জাতীয় দলের চেয়ে আমি বেশি চাপে ভুগেছি মোহামেডানের অধিনায়ক হিসেবে। পাঁচ বছর মোহামেডানে অধিনায়কত্ব করেছি, যার মধ্যে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছি দুবার। সমর্থক-দর্শকদের বিশাল চাপ আমাকে ক্লাব পর্যায়ে যতটা চাপে ফেলেছে, জাতীয় পর্যায়ে ততটা ফেলেনি। তবে শেষের দিকে এসে যখন রান পাচ্ছিলাম না, তখন কিন্তু অধিনায়কত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবছিলাম। হয়তো ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছি না, অধিনায়ক বলেই হয়তো খারাপ ফর্ম নিয়েও নিয়মিত খেলার সুযোগ পাচ্ছি--এ ধরনের ব্যাপারগুলো আমাকে বেশ ভোগাতে লাগল মানসিকভাবে। তবে একজন ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করতে পেরেছি, এটা আমার জন্য একটা বিরাট পাওনা। সব মিলিয়ে আমার অধিনায়কত্বের সময়টা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট।

শুভ্র: অধিনায়কত্ব হারানোটা নিশ্চয়ই কষ্ট দিয়েছে আপনাকে?

আমিনুল: আসলে আমি যখন আরও ম্যাচিউরড হচ্ছিলাম, তখনই অধিনায়কত্বটা হারালাম। আত্মবিশ্বাস বলেন কিংবা একটা দল নিয়ে নাড়াচাড়া করা বা দায়িত্ব পালন করার কথা বলেন, সব মিলিয়ে আমি আরও বেশি পরিপূর্ণ হচ্ছিলাম, পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা বাড়ছিল--ঠিক তখনই আমার অধিনায়কত্ব চলে গেল। এজন্য আমার ফর্মই দায়ী, তবে পুরো ব্যাপারটা আসলে বোর্ডের সিদ্ধান্ত।

শুভ্র: বোর্ডের যুক্তি, তারা ব্যাটসম্যান বুলবুলকে ফিরে পেতে আপনার ওপর থেকে অধিনায়কত্বের চাপটা সরিয়ে নিয়েছে। অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরির পর তাঁদের এই মতটাই তো মোটামুটি সত্যি বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আপনিও কি তাই মনে করেন?

আমিনুল: আমি তা মনে করি না, প্রায় দুই বছরের মতো অধিনায়ক ছিলাম আমি। এর মধ্যে সাফল্যও আছে, ব্যর্থতাও আছে। কিন্তু অধিনায়কত্ব আমার ব্যাটসম্যান সত্তার ক্ষতি করছে, এটা যদি মনে হয়--তা আরও আগে কেন হলো না? সেটা আমার দায়িত্ব নেওয়া ছয় মাস না হোক, এক বছরের মাথায় ধরা পড়া উচিত ছিল। এই ব্যাপারটা আসলে আমার কাছে ধাঁধার মতো। বিশ্বকাপের আগেও তো মেরিল টুর্নামেন্টে আমি রান পাইনি। তখন কেন ব্যাপারটা বোঝা গেল না যে, অধিনায়কত্ব আমার ব্যাটিংয়ে প্রভাব ফেলছে? সময়টা একটু বেশি লাগল না এটা বুঝতে? অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশকে আরও কিছু আমি মনে হয় দিতে পারতাম, যা দেওয়ার সুযোগ আমি হারিয়েছি। তবে যেহেতু সিদ্ধান্তটা বোর্ডের, তাই আমি কোনো বিতর্কে যেতে চাই না। তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি পুরো সমর্থন রেখে বলছি, আমার কথার মানে এই নয় যে, আমাকে আরও কিছুদিন অধিনায়ক রেখে দেওয়া উচিত ছিল বা আমি নেতৃত্ব ফিরে পেতে চাই। আমার আপত্তি একটাই, অধিনায়কত্ব কেড়ে নিয়ে ব্যাটসম্যান বুলবুলকে ফিরিয়ে আনা যাবে, এই যুক্তি আমার কাছে পুরো ঠিক বলে মনে হয় না।

১৯৯৯ বিশ্বকাপের সময় বাকিংহাম প্যালেসে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশ দলের। সামনে দেখা যাচ্ছে হাস্যোজ্জ্বল অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে। ছবি: বুলবুলের ফেসবুক পেজ থেকে

শুভ্র: অধিনায়কত্ব হারানোর খবরটা কীভাবে পেয়েছিলেন?

আমিনুল: মনে আছে, যেদিন খবরটা পাই, সেদিন সেঞ্চুরি করেছিলাম আমি (আমিনুল তখন ইংল্যান্ডে লিগ ক্রিকেট খেলছেন), তাই বেশ সেলিব্রেশন হচ্ছিল। হঠাৎ আলী আহসান বাবুর ফোন এলো। তার কাছেই জানলাম খবরটা। টেস্ট খেলাকে সামনে রেখে বোর্ড নাকি নতুন অধিনায়ক করার সিদ্ধান্ত নিযেছে। দুর্জয়কে অধিনায়ক এবং পাইলটকে তার ডেপুটি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে নাকি পারফরম্যান্সের জন্য নয়, ব্যাটসম্যান হিসেবে আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই একটু খারাপ লেগেছিল। আমি ইংল্যান্ডে যে বাসায় থাকতাম, মেরিডিয়া টিভির এক সাংবাদিক সেই বাড়ির মালিক। তিনি সব শুনে ইয়ান বোথামের কতগুলো ক্যাসেট এনে আমাকে দেখতে বললেন। বোথাম ক্যাপ্টেনসি হারানোর পর দারুণ খেলে অ্যাশেজ জিতিয়েছিলেন ইংল্যান্ডকে, এটা দিয়েই উনি অনুপ্রাণিত করতে চাইছিলেন আমাকে। এখনও ভাবলে ভালো লাগে, আমার মন খারাপ দেখে উনি বাইরে গিয়ে ক্যাসেট কিনে এনেছিলেন। তবে এ নিয়ে আর দুঃখ করার কিছু নেই, আমার এখন দায়িত্ব দলের জন্য খেলা, তারপর ভালো খেলা। যতদিন দায়িত্বে ছিলাম চেষ্টা করেছি দেশকে কিছু দিতে।

শুভ্র: এটা কি এখনও কষ্ট দেয় আপনাকে?

আমিনুল: না। আমি এখন পুরোপুরি নিজের খেলার দিকে মন দিয়েছি। এছাড়া আমাদের নতুন অধিনায়ক বেশ ভালো করছে, খুবই কো-অপারেটিভ। তার সবচেয়ে বড় গুণ ধৈর্য। বোলার একটি বা দুটি চার খেলেই ও উত্তেজিত হয়ে পড়ে না। খুব কুল, ও খুবই ভালো করছে।

১৯৯৯ বিশ্বকাপের অধিনায়কেরা। সামনের সারিতে ডান থেকে তৃতীয় বুলবুল

শুভ্র: প্রথম টেস্টে সার্বিকভাবে দলের পারফরম্যান্সকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? সব মিলিয়ে কীরকম মনে হলো টেস্ট ক্রিকেট?

আমিনুল: টেস্ট ক্রিকেটের মেজাজই আলাদা। শুধু দৈর্ঘ্যের কারণেই নয়, তিনদিন-চারদিনের ম্যাচ থেকেও এটা পুরোপুরিই আলাদা, ম্যাচের তৃতীয় দিন পর্যন্ত আমরা দারুণ খেললাম। খেলা বাকি আরও ১৮০ ওভার। সন্ধ্যায় আমরা ধরে বসে আছি, মাচ ড্র হয়ে গেছে। অথচ দু-তিনটি উইকেট পড়লেই ম্যাচ ঘুরে যেতে পারে টেস্ট ক্রিকেটে। এই যে শেষ পর্যন্ত খেলার ধৈর্য, এটাই আমাদের ঘাটতি ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। এটা আমাদের কাছে শিক্ষার মতো। এটা যদি কাজে লাগাতে পারি তো ভালো, না হলে দেখা যাবে চতুর্থ দিন থেকে নিয়মিত ম্যাচ হারছি আমরা। তবে আমরা অনেক কিছুই শিখেছি।

শুভ্র: নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিগত লক্ষ্য আছে আপনার?

আমিনুল: ব্যাটসম্যান হিসেবে এখনও অনেক কিছু শেখার আছে আমার, আরও অনেক দূর যেতে চাই আমি। ১৪৫ করার আগে আমার যে প্রত্যয় ছিল, তা এখনও একই আছে। আমি প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারি, আর এভাবেই আমি চাই সামনে এগোতে। আমার বয়স এখন ৩২ পেরিয়ে গেছে। আমার ইচ্ছা, আরও বছর তিনেক বাংলাদেশকে সার্ভিস দেওয়া, আর পরিসংখ্যানগত দিক থেকে যদি বলেন, তাহলে ১৫-২০টা টেস্ট খেলতে চাই বাংলাদেশের হয়ে। ওয়ানডে এর মধ্যে চল্লিশের কাছাকাছি হয়ে গেছে। ৬০ থেকে ৬৫টা ওয়ানডেও খেলতে চাই।

শুভ্র: কিন্তু টেস্ট ম্যাচে আপনার এখন যে অ্যাভারেজ (৭৫.৫০), সেটি কি আর ধরে রাখা সম্ভব?

আমিনুল: (হাসি) অসম্ভব কিছু নয়, পারতেও পারি। দেখি কী হয়!

প্রথম পর্ব: 'এটা ছিল একটা স্বপ্ন এবং স্বপ্নটা সত্যি হয়েছে'

দ্বিতীয় পর্ব: 'আইসিসি ট্রফি জয়ে গ্রিনিজের চেয়ে লিপু ভাইয়ের অবদান বেশি'

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×